ঢাকা ০৯:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

শেয়ার বাজার মাছের বাজার নয়, তাই গবেষণা জরুরি

  • আপডেট সময় : ০৭:৪৯:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ৩ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

সাইফুল হোসেন

শেয়ারবাজার মাছের বাজার নয়- এ বাক্যটি যতটা সরল। এর অন্তর্নিহিত বার্তা ততটাই গভীর। মাছের বাজারে মানুষ যায় দরদাম করে তাজা মাছ কিনতে, বিক্রেতা উচ্চৈঃস্বরে ডাকে, ক্রেতা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়—মুহূর্তের আবেগই সেখানে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু শেয়ারবাজার এমন নয়।

এখানে আবেগ, তাড়াহুড়া, হুজুগে সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীকে মুহূর্তেই ক্ষতির দিকে ঠেলে দেয়। কারণ শেয়ারবাজার কোম্পানির অংশীদারিত্বের জায়গা, যেখানে মূল্য নির্ধারিত হয় কোম্পানির আয়, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সেক্টরের অবস্থাসহ নানা গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে অনেকেই শেয়ারবাজারে আসে দ্রুত লাভের আশায়, গবেষণা ছাড়া, তথ্য না জেনে। ফলে বাজার যখন নেমে যায়, আতঙ্ক তৈরি হয়, ক্ষতির বোঝা বাড়ে, আবার যখন দাম বাড়ে তখন সবাই হুড়াহুড়ি করে কিনে ভবিষ্যৎ পতনের মুখে পড়ে। তাই ২০১০ সালের ভয়াবহ পতনের পর প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও বাজার মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী স্থিতিশীল হয়নি—যে বাজারে গবেষণা কম, সেখানে টেকসই উন্নতি ধীরই হবে, এটা স্বাভাবিক।

২০১০ সালের ধসে দেশের লাখো বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সারাদেশে শেয়ারবাজার নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছিল, অনেক পরিবার সঞ্চয় হারিয়েছিল। সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও মানুষের আস্থায় ধস নামে। অথচ একই সময়ে যারা মৌলিক বিশ্লেষণ করেছে, শক্তিশালী কোম্পানির শেয়ার ধরে রেখেছে, তারা দীর্ঘমেয়াদে লাভ পেয়েছে- এ বাস্তবতাও অস্বীকার করা যায় না।

ধসের পর গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বেক্সিমকো ফার্মাসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি ডিভিডেন্ড ও ক্যাপিটাল গেইনে বাজারের তুলনায় ভালো রিটার্ন দিয়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘ধসের সময় সবাই বিক্রি করছিল, আমি তখন গবেষণা করে ভালো শেয়ার সংগ্রহ করেছি। সময়ের সাথে লাভ পেয়েছি।’ তাদের অভিজ্ঞতা বলে, বাজার পতনেই আসল সুযোগ লুকিয়ে থাকে—যদি বিনিয়োগের ভিত্তি জ্ঞান হয়, গুজব নয়।

বিদেশি বাজারের ইতিহাস আরো বড় উদাহরণ হিসেবে দাঁড়ায়। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দায় ঝ্চ ৫০০ সূচক প্রায় ৫০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। ওয়াল স্ট্রিটে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, হাজারো কোম্পানি দেউলিয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছু প্রজ্ঞাবান বিনিয়োগকারী সেই সময় গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় কোম্পানি চিহ্নিত করে কিনেছিল।

ওয়ারেন বাফেট এই সময় ব্যাংক অফ আমেরিকা, গোল্ডম্যান স্যাকসসহ গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগে নজীর স্থাপন করেন। দশ বছর পর সেই শেয়ারের মূল্য বহু গুণ বেড়ে যায়। তার বিখ্যাত উক্তি- জরংশ পড়সবং ভৎড়স হড়ঃ শহড়রিহম যিধঃ ুড়ঁ ধৎব ফড়রহম অর্থাৎ জ্ঞানের অভাবই আসল ঝুঁকি।

বিনিয়োগের আগে কোম্পানিকে বুঝতে না পারলে শেয়ার কেনা মানে অচেনা জগতে চোখ বেঁধে হাঁটার মতো। বেঞ্জামিন গ্রাহাম—যাকে ভ্যালু ইনভেস্টিংয়ের জনক বলা হয়—বলেছেন, বাজার যখন অতিশয় আশাবাদী হয়ে ওঠে তখন সতর্ক থাকা উচিত, আর সবাই যখন ভয় পায় তখন সুযোগ তৈরি হয়।

বাংলাদেশের বিনিয়োগ সংস্কৃতিতে বড় সমস্যা হয় গুজব ভিত্তিক ট্রেডিং। অনেকেই “ফলান কোম্পানি শিগগিরিই স্প্লিট দেবে, বোনাস দেবে, দাম বাড়বে”—এমন কথায় বিনিয়োগ করে ক্ষতির মুখে পড়ে। গবেষণা করলে দেখা যেত হয়তো কোম্পানির মুনাফা কমছে, ঋণ বাড়ছে, সেক্টর দুর্বল। আবার যেসব কোম্পানি নিয়মিত ডিভিডেন্ড দেয়, আয়ের স্থিতিশীলতা রয়েছে, ব্যবসার পরিধি বাড়ছে- এসগুলোই দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ।

বিদেশে অনেক দেশে বিনিয়োগকারীদের গবেষণা ও বিশ্লেষণ শেখানোর সিস্টেম রয়েছে, স্কুল-কলেজ পর্যায়েই ফাইন্যান্স লিটারেসি শেখানো হয়। ফলে সাধারণ মানুষও জানে কীভাবে ঝুঁকি কমিয়ে লাভ নিতে হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের জ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো শুরুতে। শেয়ারবাজার নিয়ে বই, প্রশিক্ষণ, গবেষণাধর্মী আলোচনা বাড়ানো জরুরি। মিডিয়াতে বাজারের ওঠানামা নিয়ে রোমাঞ্চ নয়, বিশ্লেষণ প্রচার হওয়া উচিত।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, বিশ্বের যে-কোনো শেয়ারবাজারের সাফল্য নির্ভর করে কোম্পানির উন্নয়ন, কর্পোরেট গভর্ন্যান্স, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং বিনিয়োগকারীদের জ্ঞানচর্চার ওপর। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুর-সবখানেই খারাপ সময় এসেছে, বাজার ভেঙেছে, আবার সময়ের সঙ্গে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

ভারতে ২০০৪-০৮ সালে যখন সেনসেক্স দ্রুত বাড়ছিল, তারপর আসে বড় পতন। কিন্তু যারা গবেষণার মাধ্যমে ঞঈঝ, ওহভড়ংুং, ঐউঋঈ-এর মতো শক্তিশালী কোম্পানিতে ধরে রেখেছিল, তারা পরবর্তী দশকে বহুগুণ রিটার্ন পেয়েছে। বাজার তাদের পুরস্কৃত করেছে। কারণ তারা জ্ঞানের ওপর ভরসা করেছে, গুজবের নয়।

বাংলাদেশেও সেই সম্ভাবনা অগাধ। জনসংখ্যাগত সুবিধা, ডিজিটাল অগ্রগতি, ব্যাংকিংবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, কর্পোরেট সংস্কৃতি ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। নতুন অনেক কোম্পানি আইপিওতে আসছে, উৎপাদন খাত বিস্তৃত হচ্ছে। সামনে ট্রেন্ড হতে পারে রিনিউয়েবল এনার্জি, আইটি সার্ভিস, এগ্রো-প্রসেসিং, হেলথকেয়ার সেক্টর। তাই এখন বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গবেষণা শেখা। আর্থিক বিবরণী পড়া, পিই রেশিও বিশ্লেষণ করা, ক্যাশফ্লো বোঝা, সেক্টরের ভবিষ্যৎ মূল্যায়ন করা। এই দক্ষতা অর্জন করা গেলে শেয়ারবাজার ভয় নয়, সম্পদ বৃদ্ধির জায়গা হয়ে উঠবে।

শেয়ারবাজারে সফল হতে হলে সমুদ্রপথের নাবিকের মতো হতে হয়। সাগর কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। নাবিক যদি ঢেউ দেখেই ভয় পায়, তবে সে কখনোই দূরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। কিন্তু যদি সে মানচিত্র পড়ে, বাতাস বোঝে, ঢেউয়ের গতি চিনে নেয়—তবে ঝড় থেমে গেলে আবার যাত্রা শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। বিনিয়োগও একই।

বাজার পতন সাময়িক। কিন্তু সুযোগ চিরস্থায়ী নয়। গবেষণা ছাড়া বিনিয়োগ করলে ক্ষতি হতেই পারে, কিন্তু গবেষণা-ভিত্তিক বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে ফল দেয়। আজ যদি আমরা ধৈর্য নিয়ে শিখি, বিশ্লেষণ করি, কোম্পানির ভবিষ্যৎ দেখি, তাহলে আগামী দশকে আমাদের লাভের গল্প অন্য রকম হবে।

তাই মনে রাখতে হবে, শেয়ারবাজার মাছের বাজার নয় যে দামদামি করে দ্রুত কিনে বিক্রি করলেই লাভ হবে। এটি হলো ব্যবসায় অংশীদার হওয়ার জায়গা। ব্যবসার ভাষা বুঝতে হয়, হিসাব বুঝতে হয়। আবেগ নয়, যুক্তি সিদ্ধান্ত দেবে। ভালো কোম্পানি কখনো তাড়াহুড়া করে দৌড়ে পালায় না: কিন্তু খারাপ কোম্পানির ঝলকানি লোভ দেখায়। বিনিয়োগকারীর জ্ঞানই তখন তাকে পথ দেখায়।

আজ বাজার যেমনই থাকুক, গবেষণার অভ্যাস করলে আগামী দিনের বাজার হবে সম্ভাবনার দ্বার। ধসের ইতিহাস ভুল নয়, কিন্তু উত্থানের ইতিহাসও কম না। যারা জ্ঞান নিয়ে টিকে থাকে, তাদের প্রতিদান দেয় সময়। শেয়ারবাজারও একদিন নিশ্চিতভাবে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াবে—প্রশ্ন শুধু আমরা তখন প্রস্তুত থাকব কি-না।

লেখক: দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট, আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না, দ্য সাকসেস ব্লুপ্রিন্ট ইত্যাদি বইয়ের লেখক; করপোরেট ট্রেইনার; ইউটিউবার এবং ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/ কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

খুঁটিতে বেঁধে কুপিয়ে তরুণের হাত-পা প্রায় বিচ্ছিন্ন, জামায়াতের দুই কর্মী গ্রেফতার

শেয়ার বাজার মাছের বাজার নয়, তাই গবেষণা জরুরি

আপডেট সময় : ০৭:৪৯:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

সাইফুল হোসেন

শেয়ারবাজার মাছের বাজার নয়- এ বাক্যটি যতটা সরল। এর অন্তর্নিহিত বার্তা ততটাই গভীর। মাছের বাজারে মানুষ যায় দরদাম করে তাজা মাছ কিনতে, বিক্রেতা উচ্চৈঃস্বরে ডাকে, ক্রেতা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়—মুহূর্তের আবেগই সেখানে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু শেয়ারবাজার এমন নয়।

এখানে আবেগ, তাড়াহুড়া, হুজুগে সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীকে মুহূর্তেই ক্ষতির দিকে ঠেলে দেয়। কারণ শেয়ারবাজার কোম্পানির অংশীদারিত্বের জায়গা, যেখানে মূল্য নির্ধারিত হয় কোম্পানির আয়, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সেক্টরের অবস্থাসহ নানা গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে অনেকেই শেয়ারবাজারে আসে দ্রুত লাভের আশায়, গবেষণা ছাড়া, তথ্য না জেনে। ফলে বাজার যখন নেমে যায়, আতঙ্ক তৈরি হয়, ক্ষতির বোঝা বাড়ে, আবার যখন দাম বাড়ে তখন সবাই হুড়াহুড়ি করে কিনে ভবিষ্যৎ পতনের মুখে পড়ে। তাই ২০১০ সালের ভয়াবহ পতনের পর প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও বাজার মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী স্থিতিশীল হয়নি—যে বাজারে গবেষণা কম, সেখানে টেকসই উন্নতি ধীরই হবে, এটা স্বাভাবিক।

২০১০ সালের ধসে দেশের লাখো বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সারাদেশে শেয়ারবাজার নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছিল, অনেক পরিবার সঞ্চয় হারিয়েছিল। সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও মানুষের আস্থায় ধস নামে। অথচ একই সময়ে যারা মৌলিক বিশ্লেষণ করেছে, শক্তিশালী কোম্পানির শেয়ার ধরে রেখেছে, তারা দীর্ঘমেয়াদে লাভ পেয়েছে- এ বাস্তবতাও অস্বীকার করা যায় না।

ধসের পর গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বেক্সিমকো ফার্মাসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি ডিভিডেন্ড ও ক্যাপিটাল গেইনে বাজারের তুলনায় ভালো রিটার্ন দিয়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘ধসের সময় সবাই বিক্রি করছিল, আমি তখন গবেষণা করে ভালো শেয়ার সংগ্রহ করেছি। সময়ের সাথে লাভ পেয়েছি।’ তাদের অভিজ্ঞতা বলে, বাজার পতনেই আসল সুযোগ লুকিয়ে থাকে—যদি বিনিয়োগের ভিত্তি জ্ঞান হয়, গুজব নয়।

বিদেশি বাজারের ইতিহাস আরো বড় উদাহরণ হিসেবে দাঁড়ায়। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দায় ঝ্চ ৫০০ সূচক প্রায় ৫০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। ওয়াল স্ট্রিটে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, হাজারো কোম্পানি দেউলিয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছু প্রজ্ঞাবান বিনিয়োগকারী সেই সময় গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় কোম্পানি চিহ্নিত করে কিনেছিল।

ওয়ারেন বাফেট এই সময় ব্যাংক অফ আমেরিকা, গোল্ডম্যান স্যাকসসহ গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগে নজীর স্থাপন করেন। দশ বছর পর সেই শেয়ারের মূল্য বহু গুণ বেড়ে যায়। তার বিখ্যাত উক্তি- জরংশ পড়সবং ভৎড়স হড়ঃ শহড়রিহম যিধঃ ুড়ঁ ধৎব ফড়রহম অর্থাৎ জ্ঞানের অভাবই আসল ঝুঁকি।

বিনিয়োগের আগে কোম্পানিকে বুঝতে না পারলে শেয়ার কেনা মানে অচেনা জগতে চোখ বেঁধে হাঁটার মতো। বেঞ্জামিন গ্রাহাম—যাকে ভ্যালু ইনভেস্টিংয়ের জনক বলা হয়—বলেছেন, বাজার যখন অতিশয় আশাবাদী হয়ে ওঠে তখন সতর্ক থাকা উচিত, আর সবাই যখন ভয় পায় তখন সুযোগ তৈরি হয়।

বাংলাদেশের বিনিয়োগ সংস্কৃতিতে বড় সমস্যা হয় গুজব ভিত্তিক ট্রেডিং। অনেকেই “ফলান কোম্পানি শিগগিরিই স্প্লিট দেবে, বোনাস দেবে, দাম বাড়বে”—এমন কথায় বিনিয়োগ করে ক্ষতির মুখে পড়ে। গবেষণা করলে দেখা যেত হয়তো কোম্পানির মুনাফা কমছে, ঋণ বাড়ছে, সেক্টর দুর্বল। আবার যেসব কোম্পানি নিয়মিত ডিভিডেন্ড দেয়, আয়ের স্থিতিশীলতা রয়েছে, ব্যবসার পরিধি বাড়ছে- এসগুলোই দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ।

বিদেশে অনেক দেশে বিনিয়োগকারীদের গবেষণা ও বিশ্লেষণ শেখানোর সিস্টেম রয়েছে, স্কুল-কলেজ পর্যায়েই ফাইন্যান্স লিটারেসি শেখানো হয়। ফলে সাধারণ মানুষও জানে কীভাবে ঝুঁকি কমিয়ে লাভ নিতে হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের জ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো শুরুতে। শেয়ারবাজার নিয়ে বই, প্রশিক্ষণ, গবেষণাধর্মী আলোচনা বাড়ানো জরুরি। মিডিয়াতে বাজারের ওঠানামা নিয়ে রোমাঞ্চ নয়, বিশ্লেষণ প্রচার হওয়া উচিত।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, বিশ্বের যে-কোনো শেয়ারবাজারের সাফল্য নির্ভর করে কোম্পানির উন্নয়ন, কর্পোরেট গভর্ন্যান্স, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং বিনিয়োগকারীদের জ্ঞানচর্চার ওপর। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুর-সবখানেই খারাপ সময় এসেছে, বাজার ভেঙেছে, আবার সময়ের সঙ্গে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

ভারতে ২০০৪-০৮ সালে যখন সেনসেক্স দ্রুত বাড়ছিল, তারপর আসে বড় পতন। কিন্তু যারা গবেষণার মাধ্যমে ঞঈঝ, ওহভড়ংুং, ঐউঋঈ-এর মতো শক্তিশালী কোম্পানিতে ধরে রেখেছিল, তারা পরবর্তী দশকে বহুগুণ রিটার্ন পেয়েছে। বাজার তাদের পুরস্কৃত করেছে। কারণ তারা জ্ঞানের ওপর ভরসা করেছে, গুজবের নয়।

বাংলাদেশেও সেই সম্ভাবনা অগাধ। জনসংখ্যাগত সুবিধা, ডিজিটাল অগ্রগতি, ব্যাংকিংবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, কর্পোরেট সংস্কৃতি ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। নতুন অনেক কোম্পানি আইপিওতে আসছে, উৎপাদন খাত বিস্তৃত হচ্ছে। সামনে ট্রেন্ড হতে পারে রিনিউয়েবল এনার্জি, আইটি সার্ভিস, এগ্রো-প্রসেসিং, হেলথকেয়ার সেক্টর। তাই এখন বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গবেষণা শেখা। আর্থিক বিবরণী পড়া, পিই রেশিও বিশ্লেষণ করা, ক্যাশফ্লো বোঝা, সেক্টরের ভবিষ্যৎ মূল্যায়ন করা। এই দক্ষতা অর্জন করা গেলে শেয়ারবাজার ভয় নয়, সম্পদ বৃদ্ধির জায়গা হয়ে উঠবে।

শেয়ারবাজারে সফল হতে হলে সমুদ্রপথের নাবিকের মতো হতে হয়। সাগর কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। নাবিক যদি ঢেউ দেখেই ভয় পায়, তবে সে কখনোই দূরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। কিন্তু যদি সে মানচিত্র পড়ে, বাতাস বোঝে, ঢেউয়ের গতি চিনে নেয়—তবে ঝড় থেমে গেলে আবার যাত্রা শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। বিনিয়োগও একই।

বাজার পতন সাময়িক। কিন্তু সুযোগ চিরস্থায়ী নয়। গবেষণা ছাড়া বিনিয়োগ করলে ক্ষতি হতেই পারে, কিন্তু গবেষণা-ভিত্তিক বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে ফল দেয়। আজ যদি আমরা ধৈর্য নিয়ে শিখি, বিশ্লেষণ করি, কোম্পানির ভবিষ্যৎ দেখি, তাহলে আগামী দশকে আমাদের লাভের গল্প অন্য রকম হবে।

তাই মনে রাখতে হবে, শেয়ারবাজার মাছের বাজার নয় যে দামদামি করে দ্রুত কিনে বিক্রি করলেই লাভ হবে। এটি হলো ব্যবসায় অংশীদার হওয়ার জায়গা। ব্যবসার ভাষা বুঝতে হয়, হিসাব বুঝতে হয়। আবেগ নয়, যুক্তি সিদ্ধান্ত দেবে। ভালো কোম্পানি কখনো তাড়াহুড়া করে দৌড়ে পালায় না: কিন্তু খারাপ কোম্পানির ঝলকানি লোভ দেখায়। বিনিয়োগকারীর জ্ঞানই তখন তাকে পথ দেখায়।

আজ বাজার যেমনই থাকুক, গবেষণার অভ্যাস করলে আগামী দিনের বাজার হবে সম্ভাবনার দ্বার। ধসের ইতিহাস ভুল নয়, কিন্তু উত্থানের ইতিহাসও কম না। যারা জ্ঞান নিয়ে টিকে থাকে, তাদের প্রতিদান দেয় সময়। শেয়ারবাজারও একদিন নিশ্চিতভাবে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াবে—প্রশ্ন শুধু আমরা তখন প্রস্তুত থাকব কি-না।

লেখক: দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট, আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না, দ্য সাকসেস ব্লুপ্রিন্ট ইত্যাদি বইয়ের লেখক; করপোরেট ট্রেইনার; ইউটিউবার এবং ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/ কেএমএএ