ঢাকা ০৪:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫
আন্ডারওয়ার্ল্ডে সেনা অভিযান

শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ চারজন গ্রেফতার

  • আপডেট সময় : ০৯:১১:০৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫
  • ৫২ বার পড়া হয়েছে

সেনাবাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার চারজন (বাঁ থেকে) শ্যুটার আরাফাত, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও শরীফ -ছবি আইএসপিআর

নিজস্ব প্রতিবেদক: শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ চারজনকে ঢাকা ও কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর- আইএসপিআর।

মঙ্গলবার (২৭ মে) বিকালে ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য দেয় আইএসপিআর। আইএসপিআর সংবাদ সম্মেলন করার আগেই অবশ্য সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে আসে। খবরে বলা হয়, মঙ্গলবার ভোরে কুষ্টিয়ার একটি বহুতল ভবন থেকে সুব্রত বাইনসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সুব্রত বাইনের সঙ্গে গ্রেপ্তার আরেকজন কে, সেটা তখন জানা যায়নি।

ওই খবরের বিষয়ে কুষ্টিয়া সদর মডেল থানার ওসি মোশাররফ হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, শোনা যাচ্ছে, একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এটা আমাদের অফিসিয়ালি কেউ জানায়নি।

এর মধ্যে বিকালে সংবাদ সম্মেলনে এসে আইএসপিআর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের একটি ইউনিট দুজন তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের দুজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা সক্ষম হয়েছে।’

গ্রেপ্তার চারজন হলেন- সুব্রত বাইন, আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ, শ্যুটার আরাফাত ও শরীফ।

তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আজ (মঙ্গলবার) আনুমানিক ভোর ৫ টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ অভিযানে কুষ্টিয়া জেলা থেকে শীর্ষ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোল্লা মাসুদ ওরফে আবু রাসেল মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইনের দুই সহযোগী শ্যুটার আরাফাত ও শরীফকে।’

আইএসপিআর বলছে, এই চারজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন নাশকতার অভিযোগে মামলা রয়েছে। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ সেভেন স্টার সন্ত্রাসী দলের নেতা এবং তালিকাভুক্ত ‘২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর’ অন্যতম। অভিযানে তাদের কাছ থেকে পাঁচটি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি ও একটি স্যাটেলাইট ফোন জব্দ করার কথাও বলেছে আইএসপিআর।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সুব্রত বাইনের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯১ সালে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদ হত্যার মধ্য দিয়ে তার সন্ত্রাস জীবনের উত্থান শুরু হয়।

২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে, তাদের মধ্যে ঢাকার অপরাধ জগতের তখনকার প্রভাবশালী ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপের প্রধান সুব্রত বাইনও ছিলেন।

২০০৩ সালের দিকে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর তৎপরতা বেড়ে গেলে সুব্রত ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর কলকাতার স্পেশাল টাস্কফোর্স কারাইয়া এলাকা থেকে ২০০৮ সালের ১৩ অক্টোবর সুব্রতকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে কলকাতায় অস্ত্র ও অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলাও হয়। ওই মামলায় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার গা ঢাকা দেন সুব্রত। এরপর ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্সের কর্মকর্তাদের ধাওয়া খেয়ে সুব্রত বাইন নেপাল সীমান্তের কাকরভিটা শহরে ঢুকে পড়েন। পরে নেপালের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের প্রায় তিন বছরের মাথায় ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর সুড়ঙ্গ খুড়ে নেপালের কারাগার থেকে পালিয়ে ফের ভারতে অনুপ্রবেশ করেন সুব্রত বাইন। একই বছরের ২৭ নভেম্বর কলকাতার বৌবাজারের একটি বাসা থেকে সুব্রতকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় পুলিশ। সেখানে ফতেহ আলী নাম নিয়ে ছদ্মবেশে অবস্থান করছিলেন তিনি।

সুব্রত বাইনকে গ্রেফতারের বিষয়টি প্রশাসনে ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, রাজধানীতে সাম্প্রতিক যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, তার পেছনে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের হাত রয়েছে।

এর আগে মঙ্গলবার (২৭ মে) সকাল ৮টায় কুষ্টিয়ার কালীশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদ-সংলগ্ন বাসাটিতে তিন ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সহযোগীসহ তাকে আটক করা হয়।

এদিকে মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ফয়সাল মাহমুদ, কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তা ও সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা ওই ভুবনের ভাড়াটিয়া ও আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন।

কালীশংকরপুর এলাকার ওই বাসার ভাড়াটিয়া সানজিদুর ও ইভান বলেন, তিনতলা বিশিষ্ট এই ভবনের নিচ ফাঁকা ছিল। প্রায় দেড় মাস আগে আমাদের এই বিল্ডিংয়ের পেছনের বাসার মালিকের ছেলে বাসাটি ভাড়া নিয়ে তাদের উঠান। যে দুজন এই বসাতে থাকতেন তারা খুব বেশি চলাফেরা করতেন না। তাদের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা ও পরিচয় ছিল না। তবে পাশের ভবনের মালিক তার আত্মীয় পরিচয় দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, তারা ব্যবসা করবে এবং এখানে থাকবে। এরপর থেকেই তারা দুজন এখানে থাকতেন।

মঙ্গলবার ভোরে কী ঘটনা ঘটেছিল এ প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ভোর ৫টা থেকে ৮টা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর একটি টিম অভিযান চালিয়ে দুজনকে আটক করে নিয়ে যায়। দরজা ভেঙে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় তারা পাশের ভবনের মালিকের ছেলের সঙ্গেও কথা বলেন। আমরা জানতে পেরেছি, সুব্রত বাইন নামে একজনকে সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। সুব্রত বাহিনীর চেহারার সঙ্গে মিলও খুঁজে পেয়েছি আমরা। অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন আমাদেরকে সুব্রত বাইনের নামও বলেছিলেন।

ভাড়াটিয়া ও স্থানীয় কয়েকজন বলেন, মঙ্গলবার ভোরে ৩ ঘণ্টা ধরে সেখানে অভিযান চালিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এলাকায় অধিকাংশ বাড়িতে মেস ভাড়া দেওয়া হয়। যে বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে, সেটির সামনে পৌরসভার সাইনবোর্ডে বাড়ির মালিকের নাম লেখা মীর মহিউদ্দিন। তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার মেসে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ১৮ জন ছাত্র থাকেন।

কালীশংকরপুর এলাকার ওই বাসার ভাড়াটিয়া শাহীন বলেন, নিচতলায় এই বাড়ির পেছনের বাড়ির এক স্থানীয় বাসিন্দা দুই মাস আগে ভাড়া নেন। দেড় মাস আগে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এ বাসায় তাদের উঠান। নিচতলায় কী হয় বা কারা থাকেন, তা কখনো দেখেনি আমরা। তবে একজনকে কয়েকদিন দেখেছি যে কাপড় রোদে দিচ্ছেন এবং বাইরে থেকে খাওয়ার আনছেন। তার সঙ্গে সুব্রত বাহিনীর চেহারার মিল রয়েছে। অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন বলেছেন যে তিনি সুব্রত বাইন।

তিনি আরো বলেন, মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে বাড়ির সামনে সেনাবাহিনীর ৫ থেকে ৬টি গাড়ি আসে। গাড়ির বহরে একটি কালো মাইক্রোবাসও ছিল। প্রায় ৫০ জন সেনাসদস্য বাড়ির তালা খুলতে বলেন। তালা খোলার পর তারা দোতলা ও তিনতলায় ওঠেন। এরপর মেসের সব বাসিন্দাদের একটি কক্ষে রাখেন। এ সময় তারা মেসের ছাত্রদের বলেন, ‘তোমাদের কোনো ভয় বা সমস্যা নেই। তোমরা বসে থাকো। এখানে অভিযান চলছে।’ সেনা কর্মকর্তা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন বলে ছাত্ররা জানান।

মেসের শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে নিচতলায় তল্লাশি চলে। ৮টার কিছু সময় পর কালো মাইক্রোবাসটি একদম গেটের সামনে চলে আসে। নিচতলা থেকে দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে হাতকড়া পরা ও মাথায় গামছা বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে তোলা হয়। আরেক যুবকের কোমরে ও শরীরে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল।

ছাত্রদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেসের পেছনের বাড়িতে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা আটকানো পাওয়া যায়। একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাদের সাড়া মিলেনি।

উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন প্রকাশ্যে অপরাধে যুক্ত হন এবং আলোচনায় আসেন। সুব্রত বাইন বাংলাদেশের একজন কুখ্যাত অপরাধচক্র নেতা। তাকে সচরাচর ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার বিরুদ্ধে ঢাকায় কমপক্ষে ৩০টি খুনের মামলা রয়েছে।

 

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আন্ডারওয়ার্ল্ডে সেনা অভিযান

শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ চারজন গ্রেফতার

আপডেট সময় : ০৯:১১:০৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ চারজনকে ঢাকা ও কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর- আইএসপিআর।

মঙ্গলবার (২৭ মে) বিকালে ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য দেয় আইএসপিআর। আইএসপিআর সংবাদ সম্মেলন করার আগেই অবশ্য সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে আসে। খবরে বলা হয়, মঙ্গলবার ভোরে কুষ্টিয়ার একটি বহুতল ভবন থেকে সুব্রত বাইনসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সুব্রত বাইনের সঙ্গে গ্রেপ্তার আরেকজন কে, সেটা তখন জানা যায়নি।

ওই খবরের বিষয়ে কুষ্টিয়া সদর মডেল থানার ওসি মোশাররফ হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, শোনা যাচ্ছে, একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এটা আমাদের অফিসিয়ালি কেউ জানায়নি।

এর মধ্যে বিকালে সংবাদ সম্মেলনে এসে আইএসপিআর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের একটি ইউনিট দুজন তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের দুজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা সক্ষম হয়েছে।’

গ্রেপ্তার চারজন হলেন- সুব্রত বাইন, আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ, শ্যুটার আরাফাত ও শরীফ।

তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আজ (মঙ্গলবার) আনুমানিক ভোর ৫ টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ অভিযানে কুষ্টিয়া জেলা থেকে শীর্ষ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোল্লা মাসুদ ওরফে আবু রাসেল মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইনের দুই সহযোগী শ্যুটার আরাফাত ও শরীফকে।’

আইএসপিআর বলছে, এই চারজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন নাশকতার অভিযোগে মামলা রয়েছে। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ সেভেন স্টার সন্ত্রাসী দলের নেতা এবং তালিকাভুক্ত ‘২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর’ অন্যতম। অভিযানে তাদের কাছ থেকে পাঁচটি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি ও একটি স্যাটেলাইট ফোন জব্দ করার কথাও বলেছে আইএসপিআর।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সুব্রত বাইনের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯১ সালে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদ হত্যার মধ্য দিয়ে তার সন্ত্রাস জীবনের উত্থান শুরু হয়।

২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে, তাদের মধ্যে ঢাকার অপরাধ জগতের তখনকার প্রভাবশালী ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপের প্রধান সুব্রত বাইনও ছিলেন।

২০০৩ সালের দিকে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর তৎপরতা বেড়ে গেলে সুব্রত ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর কলকাতার স্পেশাল টাস্কফোর্স কারাইয়া এলাকা থেকে ২০০৮ সালের ১৩ অক্টোবর সুব্রতকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে কলকাতায় অস্ত্র ও অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলাও হয়। ওই মামলায় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার গা ঢাকা দেন সুব্রত। এরপর ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্সের কর্মকর্তাদের ধাওয়া খেয়ে সুব্রত বাইন নেপাল সীমান্তের কাকরভিটা শহরে ঢুকে পড়েন। পরে নেপালের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের প্রায় তিন বছরের মাথায় ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর সুড়ঙ্গ খুড়ে নেপালের কারাগার থেকে পালিয়ে ফের ভারতে অনুপ্রবেশ করেন সুব্রত বাইন। একই বছরের ২৭ নভেম্বর কলকাতার বৌবাজারের একটি বাসা থেকে সুব্রতকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় পুলিশ। সেখানে ফতেহ আলী নাম নিয়ে ছদ্মবেশে অবস্থান করছিলেন তিনি।

সুব্রত বাইনকে গ্রেফতারের বিষয়টি প্রশাসনে ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, রাজধানীতে সাম্প্রতিক যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, তার পেছনে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের হাত রয়েছে।

এর আগে মঙ্গলবার (২৭ মে) সকাল ৮টায় কুষ্টিয়ার কালীশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদ-সংলগ্ন বাসাটিতে তিন ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সহযোগীসহ তাকে আটক করা হয়।

এদিকে মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ফয়সাল মাহমুদ, কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তা ও সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা ওই ভুবনের ভাড়াটিয়া ও আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন।

কালীশংকরপুর এলাকার ওই বাসার ভাড়াটিয়া সানজিদুর ও ইভান বলেন, তিনতলা বিশিষ্ট এই ভবনের নিচ ফাঁকা ছিল। প্রায় দেড় মাস আগে আমাদের এই বিল্ডিংয়ের পেছনের বাসার মালিকের ছেলে বাসাটি ভাড়া নিয়ে তাদের উঠান। যে দুজন এই বসাতে থাকতেন তারা খুব বেশি চলাফেরা করতেন না। তাদের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা ও পরিচয় ছিল না। তবে পাশের ভবনের মালিক তার আত্মীয় পরিচয় দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, তারা ব্যবসা করবে এবং এখানে থাকবে। এরপর থেকেই তারা দুজন এখানে থাকতেন।

মঙ্গলবার ভোরে কী ঘটনা ঘটেছিল এ প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ভোর ৫টা থেকে ৮টা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর একটি টিম অভিযান চালিয়ে দুজনকে আটক করে নিয়ে যায়। দরজা ভেঙে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় তারা পাশের ভবনের মালিকের ছেলের সঙ্গেও কথা বলেন। আমরা জানতে পেরেছি, সুব্রত বাইন নামে একজনকে সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। সুব্রত বাহিনীর চেহারার সঙ্গে মিলও খুঁজে পেয়েছি আমরা। অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন আমাদেরকে সুব্রত বাইনের নামও বলেছিলেন।

ভাড়াটিয়া ও স্থানীয় কয়েকজন বলেন, মঙ্গলবার ভোরে ৩ ঘণ্টা ধরে সেখানে অভিযান চালিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এলাকায় অধিকাংশ বাড়িতে মেস ভাড়া দেওয়া হয়। যে বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে, সেটির সামনে পৌরসভার সাইনবোর্ডে বাড়ির মালিকের নাম লেখা মীর মহিউদ্দিন। তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার মেসে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ১৮ জন ছাত্র থাকেন।

কালীশংকরপুর এলাকার ওই বাসার ভাড়াটিয়া শাহীন বলেন, নিচতলায় এই বাড়ির পেছনের বাড়ির এক স্থানীয় বাসিন্দা দুই মাস আগে ভাড়া নেন। দেড় মাস আগে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এ বাসায় তাদের উঠান। নিচতলায় কী হয় বা কারা থাকেন, তা কখনো দেখেনি আমরা। তবে একজনকে কয়েকদিন দেখেছি যে কাপড় রোদে দিচ্ছেন এবং বাইরে থেকে খাওয়ার আনছেন। তার সঙ্গে সুব্রত বাহিনীর চেহারার মিল রয়েছে। অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন বলেছেন যে তিনি সুব্রত বাইন।

তিনি আরো বলেন, মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে বাড়ির সামনে সেনাবাহিনীর ৫ থেকে ৬টি গাড়ি আসে। গাড়ির বহরে একটি কালো মাইক্রোবাসও ছিল। প্রায় ৫০ জন সেনাসদস্য বাড়ির তালা খুলতে বলেন। তালা খোলার পর তারা দোতলা ও তিনতলায় ওঠেন। এরপর মেসের সব বাসিন্দাদের একটি কক্ষে রাখেন। এ সময় তারা মেসের ছাত্রদের বলেন, ‘তোমাদের কোনো ভয় বা সমস্যা নেই। তোমরা বসে থাকো। এখানে অভিযান চলছে।’ সেনা কর্মকর্তা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন বলে ছাত্ররা জানান।

মেসের শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে নিচতলায় তল্লাশি চলে। ৮টার কিছু সময় পর কালো মাইক্রোবাসটি একদম গেটের সামনে চলে আসে। নিচতলা থেকে দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে হাতকড়া পরা ও মাথায় গামছা বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে তোলা হয়। আরেক যুবকের কোমরে ও শরীরে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল।

ছাত্রদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেসের পেছনের বাড়িতে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা আটকানো পাওয়া যায়। একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাদের সাড়া মিলেনি।

উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন প্রকাশ্যে অপরাধে যুক্ত হন এবং আলোচনায় আসেন। সুব্রত বাইন বাংলাদেশের একজন কুখ্যাত অপরাধচক্র নেতা। তাকে সচরাচর ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার বিরুদ্ধে ঢাকায় কমপক্ষে ৩০টি খুনের মামলা রয়েছে।