ঢাকা ০৯:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

শীতে সুস্থ থাকতে খাদ্যাভ্যাস বদলান

  • আপডেট সময় : ১১:৩৬:২১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১
  • ৯৬ বার পড়া হয়েছে

লাইফস্টাইল ডেস্ক : ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে দেহে পুষ্টির চাহিদাও বদলায়। প্রতিটি ঋতু যেমন শরীরকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত করে তেমনি সেই প্রভাবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীরের চাহিদা পরিবর্তন হওয়াটাই যৌক্তিক।
‘দ্য নিউট্রিশন টুইনস’ এবং ‘টোয়েন্টিওয়ান-ডে বডি রিবুট’য়ের প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রের যমজ পুষ্টিবিদ বোন ট্যামি লাকাটোস ও ল্যাসি লাকাটোস ‘ওয়েল অ্যান্ড গুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “গ্রীষ্মের দিনগুলোতে আমরা লম্বা সময় ঘরের বাইরে থাকি, ত্বকের সরাসরি রোদ লাগে। গ্রীষ্মকালে সূর্যের তেজও থাকে বেশি। ফলে শরীর সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি’র যোগান পায়। শীতকালে সূর্যের তেজ কম। ফলে শীতকালে ভিটামিন ডি’র যোগানে কমতি দেখা দেয়।”
“পাশাপাশি আমাদের শরীর ‘থার্মোরিজেনারেশন’য়ে সক্রিয়। আর এই প্রক্রিয়া হল শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখা। শীতকালে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে বেশি শক্তি খরচ হয়। আর সেই বাড়তি শক্তি যোগাতে চাই বাড়তি খাবার।”
“অপরদিকে গ্রীষ্মকালে ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে অনেক ‘ইলেক্ট্রোলাইট’ বেরিয়ে যায়, শীতকালে তা হয় না। তাই শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালে ‘ইলেক্ট্রোলাইট‘য়ের চাহিদা বেশি থাকে।” শীতকালে দিন ছোট, রাত বড়। ফলে সতেজ বাতাস এই ঋতুতে মেলে কম।
‘দ্য নিউট্রিশন টুইনস’য়ের মতে, “শীতকালে দিনের পরিমাণ কম। আবার ঘরের মধ্যে আলো বাতাস চলাচল যতই ভালো হোক তা বাইরের মতো কখনই হয় না। আর ঘরে অন্যান্য মানুষের সংস্পর্শে আসা হয় বেশি। এই দুইয়ে মিলে জীবাণুর মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা শীতকালে বেশি। তাই এই ঋতুতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন খাবার খাওয়া দরকার বেশি পরিমাণে।”
সংস্থাটি আরও জানায়, “ঘরে থাকলেও ‘অভ্যন্তরীণ দূষণ’য়ে শিকার হওয়া আশঙ্কা থাকে। যে কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ আরও অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়ে। তাই এগুলো থেকে বাঁচতেও শীতকালে চাই বাড়তি সতর্কতা।”
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক পুষ্টিবিদ মিয়া সিন বলেন, “ঋতুর পরির্তনের কারণে মানুষের খাবার খাওয়ার ধরনেও পরিবর্তন দেখা যায়। বিশেষ করে যারা মৌসুমি খাবার খেতে পছন্দ করেন। কাঁচাবাজারে কী পাওয়া যাবে সেটাও মৌসুমি ফসলের সঙ্গে তাল মিলিয়েই বদলায়। শীতকালে শরীরের উষ্ণতা বজায় রাখার জন্য শরীর স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া তাগিদ দেয়।”
তো শীতকালে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়তে কোন খাবারগুলো বেছে নেবেন? পুষ্টিবিদদের পরামর্শের আলোকে জানানো হল সে সম্পর্কে।
ভিটামিন ডি’র প্রতি মনযোগ দিতে হবে : ‘দ্য নিউট্রিশন টুইনস’য়ের মতে, “ভিটামিন ডি শরীরে জরুরি। কারণ এটি ছাড়া শরীর ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারে না। ক্যালসিয়াম না পেলে হাড় হবে দুর্বল। ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার রোগ তো হয়ই, কয়েক ধরনের ক্যান্সার, ‘আলৎঝাইমারস’, ‘অটোইমিউন’ রোগ, প্রদাহ ইত্যাদিও দেখা দেয়।”
“ভিটামিন ডি’র যোগান নিশ্চিত করতে বেছে নিতে হবে চর্বিওয়ালা মাছ, ডিম, বৃক্কের মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, কমলার রস, সয়া দুধ, সিরিয়াল ইত্যাদি। এই ভিটামিনের অভাব থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ি ‘সাপ্লিমেন্ট’ নিতে হবে।”
শীতের ত্বকের অস্বস্তি কমাতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড : ‘দ্য নিউট্রিশন টুইনস’য়ের দাবি, রক্তচাপ ও ‘ট্রাইগ্লিসারাইড’য়ের মাত্রা কমায় ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। রক্তনালীতে যে ‘প্লাক’ জমে, সেটাও রোধ করে এই উপাদান। ফলে কমায় ‘হার্ট অ্যাটাক’ ও ‘স্ট্রোক’য়ের ঝুঁকি। আর শীতকালে ত্বক খসখসে হয়, চামড়া ওঠে, চুলকায়, প্রচ- শুষ্ক হয় যায় ত্বক। এই সবগুলো অস্বস্তির জন্যই উপকারী ওই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। প্রদাহ রোধ করা, ত্বকের জৈবিক তেলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, আর্দ্রতার ভারসাম্য রক্ষা, ত্বকের অস্বস্তি কমানো ও ত্বক নরম করা ইত্যাদি সবই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার উপকারিতার মধ্যে পড়ে। বিভিন্ন ধরনের মাছ, ‘ফ্লাক্সসিড’, ‘শিয়া সিড’, কাঠবাদাম ইত্যাদি ওমেগা থ্রি’র আদর্শ উৎস।
মৌসুমি রোগ দমাতে ভিটামিন সি : রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে জোরদার করে ভিটামিন সি। ‘দ্য নিউট্রিশন টুইন’ বলছে, “ভিটামিন সি মৌসুমি রোগ থেকে সুরক্ষা দেয় কি-না সে ব্যাপারে পরস্পর বিপরীতমুখী মতামতের প্রচলন আছে। তবে এই ভিটামিন যে সর্দি জ্বরের তীব্রতা কমায় এবং অল্প সময়ে সুস্থ করে তোলে একথা প্রমাণীত।”
‘অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট’ হিসেবে ভিটামিন সি অত্যন্ত সক্রিয়, যা মুক্তমৌলের ক্ষতি থেকে বাঁচায়। ফলে কোষ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়, প্রদাহের আশঙ্কা কমে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। কমলা, আঙুর, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, ‘ব্রাসেল স্প্রাউট’ ইত্যাদি ভিটামিন সি’র উল্লেখযোগ্য উৎস।
উদ্ভিজ্জ প্রোটিন আর আঁশ : মিয়া সিন বলছেন, “শীতের আমেজ আর বিভিন্ন উৎসবের মিলিত প্রভাবে এসময়ে মানুষের মাংস এবং ভারি খাবার বেশি খাওয়া হয়। এই খাবারগুলো সুস্বাদু হলেও হঠাৎ এই পরিবর্তন ডেকে আনে হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য।” এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে খাদ্যাভ্যাসে থাকতে হবে প্রোটিন ও ভোজ্য আঁশ। আর দুটোই আসতে হবে উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে। বিভিন্ন সবজি দিয়ে তৈরি সুপ, ডাল, মটরশুঁটিসহ অন্যান্য সকল সবজিই হতে পারে সুস্বাদু খাবারের পদ।
পর্যাপ্ত পানি : শীতকালে পানি পানের পরিমাণ কমে যায় অনেকটা। তবে এসময় শরীরে আরও বেশি পানি প্রয়োজন। মিয়া সিন বলেন, “গ্রীষ্মে ঘামের সঙ্গে অনেক পানি বেরিয়ে যায়, শীতকালে ঘাম না হলেও শরীর প্রায় একই পরিমাণ পানি হারায়। কারণ এই ঋতুতে আবহাওয়ার আর্দ্রতা কম, মূত্রবিয়োগ হয় বেশি এবং পানির পানের তাগিদ অনুভব হয় না।” “তাই পানি পান করতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে। যেসব খাবারে পানির মাত্রা বেশি সেগুলো বেশি খেলেও উপকার মিলবে।”
ভিটামিন কে-টু : মিয়া সিন বলেন, “অনেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে এই ভিটামিন পায় না। হাতেগোনা কয়েকটি খাবারে প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন কে-টু পাওয়া যায়। আর থাকে কিছু ‘ফার্মেন্টেড’ খাবারে।” কেউ যদি ভিটামিন ডি ‘সাপ্লিমেন্ট’ নেন, তবে তার সঙ্গে ভিটামিন কে টু’র ‘সাপ্লিমেন্ট’ও নেওয়া উচিত। শরীরের ক্যালসিয়ামের সুষম বন্টনের কাজ করে এই ভিটামিন।
যেসব পানীয় পান করা উচিত : ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে অনেকেই ঠান্ডাজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এই সময়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো উচিত। এজন্য বেশ কিছু পানীয় পান করতে পারেন। যেগুলো পানে বাড়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
ইমিউনিটি বর্ধক হলুদ : হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিনে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টি-ভাইরাল উপাদান রয়েছে যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। বিশেষত শীতকালে দুধে এক চিমটি হলুদ মিশিয়ে কিংবা সাধারণ চা বানিয়ে খেলে তা গাঁটের ব্যথা, পেশির ব্যথা ইত্যাদি সারাতে কার্যকরী হয়। এছাড়াও এটির অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট উপাদান কোষের ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে। সহজে হলুদ চা বানাতে শুধু এক চিমটি হলুদ, আদা দিয়ে পানি ফোটাতে হবে। চাইলে এই চায়ে মধুও মেশানো যায়। হলুদ দুধ বানাতে ১/২ পানি এবং ১ কাপ দুধ ফোটাতে হবে। এবার তাতে এক চিমটে হলুদ, এক চিমটে গোলমরিচ এবং চাইলে সামান্য চিনি মেশাতে হবে। তবে যদি ইমিউনিটি ও মেটাবলিজম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ওজনও কমাতে চায়া হয় তাহলে চিনি না দেওয়াই উচিত।
আপেল খেজুর সিয়া স্মুদি : ইমিউনিটি সহ সামগ্রিকভাবে শরীরের মেটাবলিজম বাড়াতে এই আপেল স্মুদি একেবারে উপযুক্ত পানীয়। যার জন্য ছোট ছোট টুকরো করে কাটা একটি আপেল, দুধে ভেজানো ৩টি খেজুর, ৩টি আমন্ড একসঙ্গে ব্লেন্ড করতে হবে। এর পর মিশ্রণটিতে ২ টেবিল চামচ ভেজানো সিয়া সিড মেশাতে হবে। এই আয়রন, ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ পানীয়টি আমাদের অন্ত্রের উপকারের জন্য এবং মেটাবলিজম বাড়াতে খুবই স্বাস্থ্যকর।
পালং শাক এবং অ্যাভোগাডো স্মুদি : একটি ব্লেন্ডারে ১ কাপ ধোয়া কচি পালং শাক এবং অর্ধেক অ্যাভোগাডো ভালো করে ব্লেন্ড করতে হবে এবং তাতে বিট লবণ, গোলমরিচ ও ১/২ লেবুর রস মেশাতে হবে৷ স্বাস্থ্যকর এই পানীয়টি শুধু পুষ্টির জোগান দেয় না, একই সঙ্গে এটিতে আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের উপস্থিতি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, কোষ পুর্নগঠনে এবং রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে।
বিটের চা : খুব তাড়াতাড়ি এই চা বানাতে ১ ১/২ কাপ পানিতে ১ ইঞ্চি গ্রেট করা আদা এবং ১/২ কাপ বিট ফোটাতে হবে এবং তাতে ২ টেবিল চামচ লেবুর রস, বিট লবণ এবং গোল মরিচ মেশাতে হবে। বিটের মিনারেল, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট উপাদান ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে। গোল মরিচ, লেবুর রস ও আদা দেওয়া এই পানীয়টি শুধু ঋতু পরিবর্তনের সময় অ্যালার্জি, সর্দি, কাশি ও জ্বরের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই সাহায্য করে না, একই সঙ্গে হিমোগে¬াবিন বাড়িয়ে ঠা-া আবহাওয়ার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করে তোলে।
আমলকির রস : বাড়িতে আমলকির পানীয় বানাতে ৪-৫ টা আমলকির বীজ বের ছোট টুকরো করে কেটে ১ কাপ পানিতে দিয়ে তাতে ১ চিমটি গোলমরিচ, ১ চিমটি বিট লবণ, ১ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে ব্লেন্ড করতে হবে। চাইলে মধু মিশিয়ে সকালে এই মিশ্রণটি খাওয়া যায়। অ্যামিনো অ্যাসিড এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টে ভরপুর আমলকীর রস শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি শরীর থেকে টক্সিন বের করতে এবং স্বাভাবিক ভাবে লিভারকে ভালো রাখতেও সাহায্য করে। এছাড়া আমলকী মেটাবলিজম বাড়ায় এবং দ্রুত ওজন কমায়।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

শীতে সুস্থ থাকতে খাদ্যাভ্যাস বদলান

আপডেট সময় : ১১:৩৬:২১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১

লাইফস্টাইল ডেস্ক : ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে দেহে পুষ্টির চাহিদাও বদলায়। প্রতিটি ঋতু যেমন শরীরকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত করে তেমনি সেই প্রভাবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীরের চাহিদা পরিবর্তন হওয়াটাই যৌক্তিক।
‘দ্য নিউট্রিশন টুইনস’ এবং ‘টোয়েন্টিওয়ান-ডে বডি রিবুট’য়ের প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রের যমজ পুষ্টিবিদ বোন ট্যামি লাকাটোস ও ল্যাসি লাকাটোস ‘ওয়েল অ্যান্ড গুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “গ্রীষ্মের দিনগুলোতে আমরা লম্বা সময় ঘরের বাইরে থাকি, ত্বকের সরাসরি রোদ লাগে। গ্রীষ্মকালে সূর্যের তেজও থাকে বেশি। ফলে শরীর সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি’র যোগান পায়। শীতকালে সূর্যের তেজ কম। ফলে শীতকালে ভিটামিন ডি’র যোগানে কমতি দেখা দেয়।”
“পাশাপাশি আমাদের শরীর ‘থার্মোরিজেনারেশন’য়ে সক্রিয়। আর এই প্রক্রিয়া হল শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখা। শীতকালে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে বেশি শক্তি খরচ হয়। আর সেই বাড়তি শক্তি যোগাতে চাই বাড়তি খাবার।”
“অপরদিকে গ্রীষ্মকালে ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে অনেক ‘ইলেক্ট্রোলাইট’ বেরিয়ে যায়, শীতকালে তা হয় না। তাই শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালে ‘ইলেক্ট্রোলাইট‘য়ের চাহিদা বেশি থাকে।” শীতকালে দিন ছোট, রাত বড়। ফলে সতেজ বাতাস এই ঋতুতে মেলে কম।
‘দ্য নিউট্রিশন টুইনস’য়ের মতে, “শীতকালে দিনের পরিমাণ কম। আবার ঘরের মধ্যে আলো বাতাস চলাচল যতই ভালো হোক তা বাইরের মতো কখনই হয় না। আর ঘরে অন্যান্য মানুষের সংস্পর্শে আসা হয় বেশি। এই দুইয়ে মিলে জীবাণুর মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা শীতকালে বেশি। তাই এই ঋতুতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন খাবার খাওয়া দরকার বেশি পরিমাণে।”
সংস্থাটি আরও জানায়, “ঘরে থাকলেও ‘অভ্যন্তরীণ দূষণ’য়ে শিকার হওয়া আশঙ্কা থাকে। যে কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ আরও অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়ে। তাই এগুলো থেকে বাঁচতেও শীতকালে চাই বাড়তি সতর্কতা।”
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক পুষ্টিবিদ মিয়া সিন বলেন, “ঋতুর পরির্তনের কারণে মানুষের খাবার খাওয়ার ধরনেও পরিবর্তন দেখা যায়। বিশেষ করে যারা মৌসুমি খাবার খেতে পছন্দ করেন। কাঁচাবাজারে কী পাওয়া যাবে সেটাও মৌসুমি ফসলের সঙ্গে তাল মিলিয়েই বদলায়। শীতকালে শরীরের উষ্ণতা বজায় রাখার জন্য শরীর স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া তাগিদ দেয়।”
তো শীতকালে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়তে কোন খাবারগুলো বেছে নেবেন? পুষ্টিবিদদের পরামর্শের আলোকে জানানো হল সে সম্পর্কে।
ভিটামিন ডি’র প্রতি মনযোগ দিতে হবে : ‘দ্য নিউট্রিশন টুইনস’য়ের মতে, “ভিটামিন ডি শরীরে জরুরি। কারণ এটি ছাড়া শরীর ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারে না। ক্যালসিয়াম না পেলে হাড় হবে দুর্বল। ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার রোগ তো হয়ই, কয়েক ধরনের ক্যান্সার, ‘আলৎঝাইমারস’, ‘অটোইমিউন’ রোগ, প্রদাহ ইত্যাদিও দেখা দেয়।”
“ভিটামিন ডি’র যোগান নিশ্চিত করতে বেছে নিতে হবে চর্বিওয়ালা মাছ, ডিম, বৃক্কের মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, কমলার রস, সয়া দুধ, সিরিয়াল ইত্যাদি। এই ভিটামিনের অভাব থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ি ‘সাপ্লিমেন্ট’ নিতে হবে।”
শীতের ত্বকের অস্বস্তি কমাতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড : ‘দ্য নিউট্রিশন টুইনস’য়ের দাবি, রক্তচাপ ও ‘ট্রাইগ্লিসারাইড’য়ের মাত্রা কমায় ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। রক্তনালীতে যে ‘প্লাক’ জমে, সেটাও রোধ করে এই উপাদান। ফলে কমায় ‘হার্ট অ্যাটাক’ ও ‘স্ট্রোক’য়ের ঝুঁকি। আর শীতকালে ত্বক খসখসে হয়, চামড়া ওঠে, চুলকায়, প্রচ- শুষ্ক হয় যায় ত্বক। এই সবগুলো অস্বস্তির জন্যই উপকারী ওই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। প্রদাহ রোধ করা, ত্বকের জৈবিক তেলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, আর্দ্রতার ভারসাম্য রক্ষা, ত্বকের অস্বস্তি কমানো ও ত্বক নরম করা ইত্যাদি সবই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার উপকারিতার মধ্যে পড়ে। বিভিন্ন ধরনের মাছ, ‘ফ্লাক্সসিড’, ‘শিয়া সিড’, কাঠবাদাম ইত্যাদি ওমেগা থ্রি’র আদর্শ উৎস।
মৌসুমি রোগ দমাতে ভিটামিন সি : রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে জোরদার করে ভিটামিন সি। ‘দ্য নিউট্রিশন টুইন’ বলছে, “ভিটামিন সি মৌসুমি রোগ থেকে সুরক্ষা দেয় কি-না সে ব্যাপারে পরস্পর বিপরীতমুখী মতামতের প্রচলন আছে। তবে এই ভিটামিন যে সর্দি জ্বরের তীব্রতা কমায় এবং অল্প সময়ে সুস্থ করে তোলে একথা প্রমাণীত।”
‘অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট’ হিসেবে ভিটামিন সি অত্যন্ত সক্রিয়, যা মুক্তমৌলের ক্ষতি থেকে বাঁচায়। ফলে কোষ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়, প্রদাহের আশঙ্কা কমে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। কমলা, আঙুর, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, ‘ব্রাসেল স্প্রাউট’ ইত্যাদি ভিটামিন সি’র উল্লেখযোগ্য উৎস।
উদ্ভিজ্জ প্রোটিন আর আঁশ : মিয়া সিন বলছেন, “শীতের আমেজ আর বিভিন্ন উৎসবের মিলিত প্রভাবে এসময়ে মানুষের মাংস এবং ভারি খাবার বেশি খাওয়া হয়। এই খাবারগুলো সুস্বাদু হলেও হঠাৎ এই পরিবর্তন ডেকে আনে হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য।” এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে খাদ্যাভ্যাসে থাকতে হবে প্রোটিন ও ভোজ্য আঁশ। আর দুটোই আসতে হবে উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে। বিভিন্ন সবজি দিয়ে তৈরি সুপ, ডাল, মটরশুঁটিসহ অন্যান্য সকল সবজিই হতে পারে সুস্বাদু খাবারের পদ।
পর্যাপ্ত পানি : শীতকালে পানি পানের পরিমাণ কমে যায় অনেকটা। তবে এসময় শরীরে আরও বেশি পানি প্রয়োজন। মিয়া সিন বলেন, “গ্রীষ্মে ঘামের সঙ্গে অনেক পানি বেরিয়ে যায়, শীতকালে ঘাম না হলেও শরীর প্রায় একই পরিমাণ পানি হারায়। কারণ এই ঋতুতে আবহাওয়ার আর্দ্রতা কম, মূত্রবিয়োগ হয় বেশি এবং পানির পানের তাগিদ অনুভব হয় না।” “তাই পানি পান করতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে। যেসব খাবারে পানির মাত্রা বেশি সেগুলো বেশি খেলেও উপকার মিলবে।”
ভিটামিন কে-টু : মিয়া সিন বলেন, “অনেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে এই ভিটামিন পায় না। হাতেগোনা কয়েকটি খাবারে প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন কে-টু পাওয়া যায়। আর থাকে কিছু ‘ফার্মেন্টেড’ খাবারে।” কেউ যদি ভিটামিন ডি ‘সাপ্লিমেন্ট’ নেন, তবে তার সঙ্গে ভিটামিন কে টু’র ‘সাপ্লিমেন্ট’ও নেওয়া উচিত। শরীরের ক্যালসিয়ামের সুষম বন্টনের কাজ করে এই ভিটামিন।
যেসব পানীয় পান করা উচিত : ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে অনেকেই ঠান্ডাজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এই সময়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো উচিত। এজন্য বেশ কিছু পানীয় পান করতে পারেন। যেগুলো পানে বাড়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
ইমিউনিটি বর্ধক হলুদ : হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিনে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টি-ভাইরাল উপাদান রয়েছে যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। বিশেষত শীতকালে দুধে এক চিমটি হলুদ মিশিয়ে কিংবা সাধারণ চা বানিয়ে খেলে তা গাঁটের ব্যথা, পেশির ব্যথা ইত্যাদি সারাতে কার্যকরী হয়। এছাড়াও এটির অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট উপাদান কোষের ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে। সহজে হলুদ চা বানাতে শুধু এক চিমটি হলুদ, আদা দিয়ে পানি ফোটাতে হবে। চাইলে এই চায়ে মধুও মেশানো যায়। হলুদ দুধ বানাতে ১/২ পানি এবং ১ কাপ দুধ ফোটাতে হবে। এবার তাতে এক চিমটে হলুদ, এক চিমটে গোলমরিচ এবং চাইলে সামান্য চিনি মেশাতে হবে। তবে যদি ইমিউনিটি ও মেটাবলিজম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ওজনও কমাতে চায়া হয় তাহলে চিনি না দেওয়াই উচিত।
আপেল খেজুর সিয়া স্মুদি : ইমিউনিটি সহ সামগ্রিকভাবে শরীরের মেটাবলিজম বাড়াতে এই আপেল স্মুদি একেবারে উপযুক্ত পানীয়। যার জন্য ছোট ছোট টুকরো করে কাটা একটি আপেল, দুধে ভেজানো ৩টি খেজুর, ৩টি আমন্ড একসঙ্গে ব্লেন্ড করতে হবে। এর পর মিশ্রণটিতে ২ টেবিল চামচ ভেজানো সিয়া সিড মেশাতে হবে। এই আয়রন, ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ পানীয়টি আমাদের অন্ত্রের উপকারের জন্য এবং মেটাবলিজম বাড়াতে খুবই স্বাস্থ্যকর।
পালং শাক এবং অ্যাভোগাডো স্মুদি : একটি ব্লেন্ডারে ১ কাপ ধোয়া কচি পালং শাক এবং অর্ধেক অ্যাভোগাডো ভালো করে ব্লেন্ড করতে হবে এবং তাতে বিট লবণ, গোলমরিচ ও ১/২ লেবুর রস মেশাতে হবে৷ স্বাস্থ্যকর এই পানীয়টি শুধু পুষ্টির জোগান দেয় না, একই সঙ্গে এটিতে আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের উপস্থিতি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, কোষ পুর্নগঠনে এবং রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে।
বিটের চা : খুব তাড়াতাড়ি এই চা বানাতে ১ ১/২ কাপ পানিতে ১ ইঞ্চি গ্রেট করা আদা এবং ১/২ কাপ বিট ফোটাতে হবে এবং তাতে ২ টেবিল চামচ লেবুর রস, বিট লবণ এবং গোল মরিচ মেশাতে হবে। বিটের মিনারেল, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট উপাদান ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে। গোল মরিচ, লেবুর রস ও আদা দেওয়া এই পানীয়টি শুধু ঋতু পরিবর্তনের সময় অ্যালার্জি, সর্দি, কাশি ও জ্বরের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই সাহায্য করে না, একই সঙ্গে হিমোগে¬াবিন বাড়িয়ে ঠা-া আবহাওয়ার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করে তোলে।
আমলকির রস : বাড়িতে আমলকির পানীয় বানাতে ৪-৫ টা আমলকির বীজ বের ছোট টুকরো করে কেটে ১ কাপ পানিতে দিয়ে তাতে ১ চিমটি গোলমরিচ, ১ চিমটি বিট লবণ, ১ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে ব্লেন্ড করতে হবে। চাইলে মধু মিশিয়ে সকালে এই মিশ্রণটি খাওয়া যায়। অ্যামিনো অ্যাসিড এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টে ভরপুর আমলকীর রস শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি শরীর থেকে টক্সিন বের করতে এবং স্বাভাবিক ভাবে লিভারকে ভালো রাখতেও সাহায্য করে। এছাড়া আমলকী মেটাবলিজম বাড়ায় এবং দ্রুত ওজন কমায়।