মহানগর প্রতিবেদন : রাজধানীর কাওরানবাজার একটি মাছের দোকানে খ-কালীন কাজ করেন রাফসান (২২)। তার বাবা বেঁচে নেই। পাশের তেজগাঁও মোল্লাবাড়ি বস্তিতে মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। গত চার বছর ধরে এ বস্তিতে বসবাস করেন তারা। প্রতিদিনের মতোই কাজ শেষ করে বস্তির ওই বাসায় আসেন রাফসান। তবে তীব্র শীতে গত রাতে একটু আগেভাগেই রাতের খাবার শেষ করে শুয়ে পড়েছিলেন তারা। গভীর রাতে আচমকা শব্দে ঘুম ভাঙে তাদের। ঘর থেকে বের হতেই বস্তির একপাশে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। মুহূর্তেই যে আগুন বস্তির চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখতে পান তারা। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের বসতঘরটিতেও আগুন চলে আসে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাদের ঘর।
গত শনিবার (১৩ জানুয়ারি) বিকালে পুড়ে যাওয়া বস্তিতে গেলে দেখা যায়, ওই রাফসান নিজের পুড়ে যাওয়া ঘর থেকে পুড়া যাওয়া টিন ভাঙা অংশ সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘শীত বেশি পড়ায় একটু আগেই কাল বাসায় চলে আসছিলাম। এসে ঘুমিয়ে পড়ি। তবে এভাবে ঘুম ভাঙবে তা কখনও কল্পনাও করি নাই। আমাদের একটি রুম ছিল; সেখানে আমাদের যা ছিল সব পুড়ে শেষ। ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারি নাই। আমরা গরীব মানুষ প্রতিদিন কাজ করে যা টাকা পাই তা দিয়ে চলি। এ শীতে এখন কোথায় যাবো, কী খাবো। সকাল থেকে পানি ছাড়া কিছুই খাইনি।’
একই ঘটনার আরেক ভুক্তভোগী পঞ্চাশোর্ধ্ব জোসনা বেগম। ১৮ বছর আগে মুন্সীগঞ্জে থেকে দুই সন্তান ও স্বামী আব্দুল কাদের নিয়ে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন কাজের সন্ধানে। রাত্রীযাপনের জন্য প্রথমে ঠাঁই নিয়েছিলেন ওই বস্তিতে এক আত্মীয়ের ঘরে। পরে নিজে মানুষের ঘরে কাজ করতে শুরু করেন। তার স্বামীও এলাকার একটি দর্জির দোকানে কাজ নেয়। এভাবে একসময় সময় সুযোগে নিজেরাও বস্তিতে টিন দিয়ে ঘর তৈরি করেন। মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিন ও ছেলে সাব্বিরকে সুখে-শান্তিতেই চলছিল তাদের সংসার। শুক্রবার ( ১৩ জানুয়ারি) গভীর রাতে আগুনে ১৮ বছরের এই গোছানো সংসার কয়েক মিনিটে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
অশ্রুসিক্ত চোখে জোসনা বেগম বলেন, ‘আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম। অসুস্থতার জন্য এখন আর কাজে যেতে পারি না। আমার মেয়ের বিয়ে হলেও আমার কাছেই থাকে। স্বামী-সন্তান নিয়ে এখন কোথায় যাবো? এ শীতে নিজের শরীরের কাপড়টা ছাড়া আর কিছু নেই আমাদের। ঘরে আসবাবপত্র যা ছিল সবই শেষ। ৪০ হাজার নগদ টাকা ছিল তাও শেষ। হাতে কিছু নেই।‘
বস্তিতে আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে শিরিন আক্তার (৪২) নামে আরেক নারীর। গত বছর কিশোরগঞ্জ থেকে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এসে ওই বস্তিতে আসেন। উঠছিলেন একটি ভাড়া করা টিনশেট ঘরে। উঠে নতুন ঘরে সাজানোর জন্য নতুন কিছু আসবাবপত্রও কিনেছিলেন। কয়েক মাস পেরোতেই গতকাল গভীর রাতের আগুন তার সব কেড়ে নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী নাই ছেলেকে নিয়ে চলতে পারছিলাম না। কোনও আয়-উপার্জন ছিল। ছেলে এসে রিকশা চালানো শুরু করে। আমি অন্যের বাসায় কাজ করি। ঘরে যা ছিল সবই পুড়েছে।’
তাদের মতো ভয়াবহ এ আগুনে মোল্লাবাড়ির বস্তির ৩০০ পরিবারের ঘর পুড়েছে। পুড়ে গেছে ঘরের টিভি, ফ্রিজ, কাপড়সহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র। তীব্র এই শীতে অসহায়ের মতো বস্তির চারপাশে দাঁড়িয়ে আছেন শেষ সম্বল হারানো মানুষগুলো। সেই সঙ্গে ভাবছেন কীভাবে আবার মাথা গোঁজার ঠাঁই বানাবেন।
এদিকে শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান। অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্তদের সমবেদনা জানিয়ে তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘অগ্নিকা-ের ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা সবাই নি¤œবিত্ত পরিবারের। সবাই কাওরান বাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পেশার সঙ্গে জড়িত। আগুনের ভয়াবহতায় তারা বের হওয়ার রাস্তা পাননি। সেদিক থেকে ক্ষতির পরিমাণটাও বেশি হয়েছে। অগ্নিকা-ের কারণ খোঁজার চেষ্টা করছি।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘অসতর্কতা নাকি বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন লেগেছে সেটা ফায়ার সার্ভিস এবং আমাদের তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তারপরও এ বস্তির মালিকানা নিয়ে আমরা জানার চেষ্টা করছি।’
এই অগ্নিকা-ের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে।
এর আগে তেজগাঁওয়ে বিএফডিসির পাশে মোল্লাবাড়ি বস্তিতে আগুন লাগার খবর আসে রাত ২টা ২৩ মিনিটে। এর কয়েক মিনিটের মাথায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। প্রায় সোয়া ১ ঘণ্টার চেষ্টায় ৩টা ৪০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, সিদ্দিকবাজার ও মিরপুর ফায়ার স্টেশন থেকে একাধিক ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অগ্নিকা-ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে, তাৎক্ষণিকভাবে তা জানাতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা।