ঢাকা ১০:১৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
বাড়ছে রোগবালাই, হাসপাতালে ভিড়

শীতে কাঁপছে দেশ, জনজীবনে স্থবিরতা

  • আপডেট সময় : ১০:১৫:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ১০ বার পড়া হয়েছে

হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর সংখ্যা -ছবি সংগৃহীত

অনন্য হক: মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহটি কেটে গেলেও আরো কয়েকদিন মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবওহাওয়া অধিদপ্তর।

এই কুয়াশার কারণেই শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে বলে অধিদপ্তরের সহকারী আবওহাওয়াওবিদ আফরোজা সুলতানা জানিয়েছেন।

শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির ফলে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বর, সর্দি-কাশিসহ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। রোগবালাই থেকে রক্ষা পেতে গরম পানি পান করাসহ গরম কাপড় ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) আফরোজা সুলতানা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, শনি, রোব ও সোমবার মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশের কোথাও কোথাও মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা এবং কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবওহাওয়াওবিদ আফরোজা সুলতানা। সাত জেলার ওপর দিয়ে শুক্রবার বয়ে যাওয়া শৈতপ্রবাহটি শনিবার আর বইছে না জানিয়ে তিনি বলেন, তবে কুয়াশার কারণে শীত বেশি মনে হচ্ছে।

শিশু হাসপাতালগুলোতে ভিড়: ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গেছে। বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে নবজাতক ও শিশুরা। শুষ্ক আবহাওয়া, বাড়তে থাকা বায়ুদূষণ ও ধুলাবালির কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ মৌসুমি নানা অসুখে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের বাড়তি সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকদের মতে, এ সময় প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ছে। জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং অ্যালার্জিজনিত জটিলতা এখন শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, একটি শয্যাও খালি নেই। প্রতিদিন বহির্বিভাগে শত শত শিশু চিকিৎসা নিতে আসছে। চিকিৎসকরা জানান, প্রাথমিক চিকিৎসার পর অনেক শিশুকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এবং অবস্থার অবনতি হলে ভর্তি করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে সচেতনতা ও সময়মতো চিকিৎসা নিলে অনেক মৌসুমি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।

হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ১৮ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৬১ জন শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে ৬৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। একই সময়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ১৫৭ জন শিশু। এছাড়া সাধারণ সর্দি-কাশিতে ৮১৬ জন এবং হাঁপানিতে ১২১ জন শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। হাসপাতালটিতে শুধু ২৩ ডিসেম্বর একদিনেই বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ১ হাজার ২৩৪ জন শিশু। এর মধ্যে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা পেয়েছে ২৬০ জন, মেডিসিন বিভাগে ৭৯২ জন এবং সার্জারি বিভাগে ১৮২ জন। ২৪ ঘণ্টায় সর্দি-কাশিতে ২৫৩ জন, নিউমোনিয়ায় ৪৬ জন, হাঁপানিতে ২৩ জন, স্ক্যাবিসে ১৫৩ জন, অন্যান্য চর্মরোগে ২২৩ জন এবং ডায়রিয়ায় ৫৪ জন শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে শিশু রোগীদের কষ্ট স্পষ্ট। তিন মাস বয়সী সুপ্তা জন্মের পর থেকেই ঠান্ডাজনিত সমস্যায় ভুগছে। গত অক্টোবরে সে টানা প্রায় ১৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ছাড়পত্র পাওয়ার তিন দিনের মধ্যেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। দ্বিতীয়বার ভর্তির সময় তার নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। তৃতীয় দফায় ভর্তি হয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫ দিন হাসপাতালে রয়েছে সুপ্তা, এর মধ্যে কয়েক দিন তাকে আইসিইউতেও থাকতে হয়েছে।

নবজাতকরাও ডায়রিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পাঁচ দিনের শিশু আনাফকে সিজারিয়ান ডেলিভারির পর একটি শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার মা জানান, জন্মের পর থেকেই শিশুটি ডায়রিয়ায় ভুগছিল। তিন দিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর এখন তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং শিগগিরই ছাড়পত্র দেওয়ার কথা রয়েছে। একইভাবে এ বছর বয়সী নুসাইবাকেও তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে। তার মা জানান, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে শিশুটি সর্দি ও নাক দিয়ে পানি ঝরার সমস্যায় ভুগছিল। খেতে চাইছিল না, সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছিল এবং শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তাকে নেবুলাইজেশন দেওয়া হচ্ছে। শুরুতে নল দিয়ে খাবার দেওয়া হলেও এখন অবস্থার উন্নতি হওয়ায় মুখে খাবার নিতে পারছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের শিশু শ্বাসতন্ত্র (পালমোনোলজি) বিভাগের অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার সরকার জানান, শীতকালে শিশুদের মধ্যে ফ্লু, সর্দি, কাশি ও নিউমোনিয়ার প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। তিনি বলেন, এ সময়ে অভিভাবকদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত গোসল প্রয়োজন হলেও অপরিণত নবজাতকদের ক্ষেত্রে দেরিতে ও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোসল করানো উচিত, যাতে ঠান্ডা না লাগে। নবজাতকদের সব সময় গরম রাখতে হবে এবং যেসব শিশু খেতে পারে, তাদের বাইরে খোলা খাবার বা খোলা জুস দেওয়া যাবে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, অনেক অভিভাবক শিশুর নাক দিয়ে পানি ঝরার সময়ও প্যাকেটজাত পানীয় দেন। এতে অসুখ আরো বাড়তে পারে। চিকিৎসকরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিরুদ্ধেও সতর্ক করেছেন। ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, শীতকালের বেশিরভাগ রোগই ভাইরাসজনিত। শিশুর জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বিশ্বজুড়ে প্রতি ১৩ সেকেন্ডে একজন মানুষ নিউমোনিয়ায় মারা যান এবং প্রতি ৪৩ সেকেন্ডে মারা যায় একটি শিশু। শীতকালে শিশুদের অপ্রয়োজনে বাইরে নেওয়া থেকে বিরত থাকা, ধুলাবালি ও সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যশোরে: শনিবার সকালে আবওহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভোর ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে, ৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাবনার ঈশ্বরদী ও কিশোরগঞ্জের নিকলিতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে টেকনাফে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রেকর্ড হলে সাধারণত মৃদু শৈতপ্রবাহ বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে কিছু স্থানে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রেকর্ড হলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী না হওয়ায় ও আশপাশে প্রভাব না রাখায় একে শৈতপ্রবাহ বলা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সহকারী আবওহাওয়াওবিদ আফরোজা সুলতানা।

শনিবার আবওহাওয়ার পাঁচদিনের পূর্বাভাসে আবওহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গল ও বুধবার মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের নদী অববাহিকার কোথাও কোথাও মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা এবং দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারী ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। শনি থকে বুধবার অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে বলে তুলে ধরে অধিদপ্তর বলছে, শনিবার সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

রোববার সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আর সোমবার সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে। তবে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার কারণে এ তিনদিন দেশের অনেক জায়গায় ঠান্ডার অনুভূতি অব্যাহত থাকতে পারে। মঙ্গল ও বুধবার সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।

এদিকে সকালে ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামতে ব্যর্থ হয়ে কলকাতা, ব্যাংকক ও চট্টগ্রামে অবতরণ করেছে আটটি ফ্লাইট। শাহজালাল বিমানবন্দরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, ঘন কুয়াশা পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার স্বার্থে এদিন কয়েকটি ফ্লাইটকে বিভিন্ন বিমানবন্দরে ‘ডাইভার্ট’ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ফ্লাইট চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে, চারটি ফ্লাইট কলকাতা বিমানবন্দরে এবং একটি ফ্লাইট ব্যাংকক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। এর আগে শুক্রবার আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছিল, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এবং নীলফামারী জেলায় বয়ে যাচ্ছে মৌসুমের প্রথম মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়; ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।

যশোর সংবাদদাতা জানান, প্রচণ্ড শীতের কারণে মানুষজনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। মোটা জ্যাকেট, মাফলারে ঢেকে মানুষজনকে জবুথুবু হয়ে পথ চলতে দেখা যায়। হাড় কাঁপানো শীতে ঘর থেকে বের হননি অনেকে। তবে ঘর থেকে বের হয়েও কাজ মিলছে না শ্রমজীবী মানুষের। যশোর শহরের লালদীঘি পাড়ে প্রতিদিন তিন-চারশ মানুষ শ্রম বিক্রির জন্য জড়ো হয়ে থাকেন। প্রচণ্ড শীতে সেই সংখ্যা অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপরও কাজ না পাওয়ায় অনেকেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। কিছু মানুষ অনেক বেলা অবধি অপেক্ষা করছেন কাজের আশায়। বাহাদুরপুর এলাকার সুজন মিয়া বলেন, ‘শীতে একদিন কাজ পাই তো তিন দিন পাই না। গত এক সপ্তাহ ধরে কাজ হচ্ছে না। শীতের মধ্যে প্রতিদিন ভোরবেলায় এসে বসে থেকেও কোনো লাভ হচ্ছে না।

শহরের বেজপাড়া টিবি ক্লিনিক এলাকার নির্মাণশ্রমিক মো. মিনহাজ বলেন, শীতে বাইরে দাঁড়াতে পারছি না। অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। কাজের সন্ধানে বের হয়েছি। ঠিকমতো কাজও পাচ্ছি না। শহরের শংকরপুর এলাকার শ্রমজীবী নজরুল ইসলাম বলেন, বিল্ডিংয়ের রঙের কাজ করি। কাজের সন্ধানে এসেছি। এখানে বসে আছি। এখনো কাজ পাইনি। শীতের ভেতরে অনেক কষ্ট হচ্ছে। পেটের দায়ে ঘরের বাইরে বের হয়েছি। কাজ পাবো কিনা জানি না।

সানা/আপ্র/২৭/১২/২০২৫

 

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

শীতে কাঁপছে দেশ, জনজীবনে স্থবিরতা

বাড়ছে রোগবালাই, হাসপাতালে ভিড়

শীতে কাঁপছে দেশ, জনজীবনে স্থবিরতা

আপডেট সময় : ১০:১৫:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

অনন্য হক: মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহটি কেটে গেলেও আরো কয়েকদিন মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবওহাওয়া অধিদপ্তর।

এই কুয়াশার কারণেই শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে বলে অধিদপ্তরের সহকারী আবওহাওয়াওবিদ আফরোজা সুলতানা জানিয়েছেন।

শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির ফলে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বর, সর্দি-কাশিসহ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। রোগবালাই থেকে রক্ষা পেতে গরম পানি পান করাসহ গরম কাপড় ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) আফরোজা সুলতানা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, শনি, রোব ও সোমবার মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশের কোথাও কোথাও মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা এবং কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবওহাওয়াওবিদ আফরোজা সুলতানা। সাত জেলার ওপর দিয়ে শুক্রবার বয়ে যাওয়া শৈতপ্রবাহটি শনিবার আর বইছে না জানিয়ে তিনি বলেন, তবে কুয়াশার কারণে শীত বেশি মনে হচ্ছে।

শিশু হাসপাতালগুলোতে ভিড়: ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গেছে। বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে নবজাতক ও শিশুরা। শুষ্ক আবহাওয়া, বাড়তে থাকা বায়ুদূষণ ও ধুলাবালির কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ মৌসুমি নানা অসুখে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের বাড়তি সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকদের মতে, এ সময় প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ছে। জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং অ্যালার্জিজনিত জটিলতা এখন শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, একটি শয্যাও খালি নেই। প্রতিদিন বহির্বিভাগে শত শত শিশু চিকিৎসা নিতে আসছে। চিকিৎসকরা জানান, প্রাথমিক চিকিৎসার পর অনেক শিশুকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এবং অবস্থার অবনতি হলে ভর্তি করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে সচেতনতা ও সময়মতো চিকিৎসা নিলে অনেক মৌসুমি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।

হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ১৮ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৬১ জন শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে ৬৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। একই সময়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ১৫৭ জন শিশু। এছাড়া সাধারণ সর্দি-কাশিতে ৮১৬ জন এবং হাঁপানিতে ১২১ জন শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। হাসপাতালটিতে শুধু ২৩ ডিসেম্বর একদিনেই বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ১ হাজার ২৩৪ জন শিশু। এর মধ্যে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা পেয়েছে ২৬০ জন, মেডিসিন বিভাগে ৭৯২ জন এবং সার্জারি বিভাগে ১৮২ জন। ২৪ ঘণ্টায় সর্দি-কাশিতে ২৫৩ জন, নিউমোনিয়ায় ৪৬ জন, হাঁপানিতে ২৩ জন, স্ক্যাবিসে ১৫৩ জন, অন্যান্য চর্মরোগে ২২৩ জন এবং ডায়রিয়ায় ৫৪ জন শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে শিশু রোগীদের কষ্ট স্পষ্ট। তিন মাস বয়সী সুপ্তা জন্মের পর থেকেই ঠান্ডাজনিত সমস্যায় ভুগছে। গত অক্টোবরে সে টানা প্রায় ১৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ছাড়পত্র পাওয়ার তিন দিনের মধ্যেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। দ্বিতীয়বার ভর্তির সময় তার নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। তৃতীয় দফায় ভর্তি হয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫ দিন হাসপাতালে রয়েছে সুপ্তা, এর মধ্যে কয়েক দিন তাকে আইসিইউতেও থাকতে হয়েছে।

নবজাতকরাও ডায়রিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পাঁচ দিনের শিশু আনাফকে সিজারিয়ান ডেলিভারির পর একটি শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার মা জানান, জন্মের পর থেকেই শিশুটি ডায়রিয়ায় ভুগছিল। তিন দিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর এখন তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং শিগগিরই ছাড়পত্র দেওয়ার কথা রয়েছে। একইভাবে এ বছর বয়সী নুসাইবাকেও তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে। তার মা জানান, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে শিশুটি সর্দি ও নাক দিয়ে পানি ঝরার সমস্যায় ভুগছিল। খেতে চাইছিল না, সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছিল এবং শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তাকে নেবুলাইজেশন দেওয়া হচ্ছে। শুরুতে নল দিয়ে খাবার দেওয়া হলেও এখন অবস্থার উন্নতি হওয়ায় মুখে খাবার নিতে পারছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের শিশু শ্বাসতন্ত্র (পালমোনোলজি) বিভাগের অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার সরকার জানান, শীতকালে শিশুদের মধ্যে ফ্লু, সর্দি, কাশি ও নিউমোনিয়ার প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। তিনি বলেন, এ সময়ে অভিভাবকদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত গোসল প্রয়োজন হলেও অপরিণত নবজাতকদের ক্ষেত্রে দেরিতে ও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোসল করানো উচিত, যাতে ঠান্ডা না লাগে। নবজাতকদের সব সময় গরম রাখতে হবে এবং যেসব শিশু খেতে পারে, তাদের বাইরে খোলা খাবার বা খোলা জুস দেওয়া যাবে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, অনেক অভিভাবক শিশুর নাক দিয়ে পানি ঝরার সময়ও প্যাকেটজাত পানীয় দেন। এতে অসুখ আরো বাড়তে পারে। চিকিৎসকরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিরুদ্ধেও সতর্ক করেছেন। ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, শীতকালের বেশিরভাগ রোগই ভাইরাসজনিত। শিশুর জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বিশ্বজুড়ে প্রতি ১৩ সেকেন্ডে একজন মানুষ নিউমোনিয়ায় মারা যান এবং প্রতি ৪৩ সেকেন্ডে মারা যায় একটি শিশু। শীতকালে শিশুদের অপ্রয়োজনে বাইরে নেওয়া থেকে বিরত থাকা, ধুলাবালি ও সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যশোরে: শনিবার সকালে আবওহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভোর ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে, ৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাবনার ঈশ্বরদী ও কিশোরগঞ্জের নিকলিতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে টেকনাফে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রেকর্ড হলে সাধারণত মৃদু শৈতপ্রবাহ বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে কিছু স্থানে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রেকর্ড হলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী না হওয়ায় ও আশপাশে প্রভাব না রাখায় একে শৈতপ্রবাহ বলা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সহকারী আবওহাওয়াওবিদ আফরোজা সুলতানা।

শনিবার আবওহাওয়ার পাঁচদিনের পূর্বাভাসে আবওহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গল ও বুধবার মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের নদী অববাহিকার কোথাও কোথাও মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা এবং দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারী ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। শনি থকে বুধবার অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে বলে তুলে ধরে অধিদপ্তর বলছে, শনিবার সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

রোববার সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আর সোমবার সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে। তবে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার কারণে এ তিনদিন দেশের অনেক জায়গায় ঠান্ডার অনুভূতি অব্যাহত থাকতে পারে। মঙ্গল ও বুধবার সারাদেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।

এদিকে সকালে ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামতে ব্যর্থ হয়ে কলকাতা, ব্যাংকক ও চট্টগ্রামে অবতরণ করেছে আটটি ফ্লাইট। শাহজালাল বিমানবন্দরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, ঘন কুয়াশা পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার স্বার্থে এদিন কয়েকটি ফ্লাইটকে বিভিন্ন বিমানবন্দরে ‘ডাইভার্ট’ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ফ্লাইট চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে, চারটি ফ্লাইট কলকাতা বিমানবন্দরে এবং একটি ফ্লাইট ব্যাংকক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। এর আগে শুক্রবার আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছিল, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এবং নীলফামারী জেলায় বয়ে যাচ্ছে মৌসুমের প্রথম মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়; ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।

যশোর সংবাদদাতা জানান, প্রচণ্ড শীতের কারণে মানুষজনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। মোটা জ্যাকেট, মাফলারে ঢেকে মানুষজনকে জবুথুবু হয়ে পথ চলতে দেখা যায়। হাড় কাঁপানো শীতে ঘর থেকে বের হননি অনেকে। তবে ঘর থেকে বের হয়েও কাজ মিলছে না শ্রমজীবী মানুষের। যশোর শহরের লালদীঘি পাড়ে প্রতিদিন তিন-চারশ মানুষ শ্রম বিক্রির জন্য জড়ো হয়ে থাকেন। প্রচণ্ড শীতে সেই সংখ্যা অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপরও কাজ না পাওয়ায় অনেকেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। কিছু মানুষ অনেক বেলা অবধি অপেক্ষা করছেন কাজের আশায়। বাহাদুরপুর এলাকার সুজন মিয়া বলেন, ‘শীতে একদিন কাজ পাই তো তিন দিন পাই না। গত এক সপ্তাহ ধরে কাজ হচ্ছে না। শীতের মধ্যে প্রতিদিন ভোরবেলায় এসে বসে থেকেও কোনো লাভ হচ্ছে না।

শহরের বেজপাড়া টিবি ক্লিনিক এলাকার নির্মাণশ্রমিক মো. মিনহাজ বলেন, শীতে বাইরে দাঁড়াতে পারছি না। অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। কাজের সন্ধানে বের হয়েছি। ঠিকমতো কাজও পাচ্ছি না। শহরের শংকরপুর এলাকার শ্রমজীবী নজরুল ইসলাম বলেন, বিল্ডিংয়ের রঙের কাজ করি। কাজের সন্ধানে এসেছি। এখানে বসে আছি। এখনো কাজ পাইনি। শীতের ভেতরে অনেক কষ্ট হচ্ছে। পেটের দায়ে ঘরের বাইরে বের হয়েছি। কাজ পাবো কিনা জানি না।

সানা/আপ্র/২৭/১২/২০২৫