নারী ও শিশু ডেস্ক: শিশু নতুন কিছু করতে গেলেই কোনো কোনো অভিভাবক সামনে দুর্ভেদ্য দুর্গ হয়ে দাঁড়ান। ‘ও তো ছোট, ওর বয়স হয়নি’- এমন নানা কথা বলে তারা শিশুর ‘ভালোর স্বার্থে’ই হয়তো এসব সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু স্বাভাবিক বিকাশের পথে তা কতটা সঠিক? হ্যাঁ, এটা ঠিক, শিশুর ভালো সবচেয়ে বেশি চাইবেন তার মা-বাবা তথা অভিভাবকই। তাই নানা বিষয়ে তদারকি তো দরকার আছেই। কিছু বিষয়ে হয়তো বাধা দেওয়াও প্রয়োজন। তাই নিচের কয়েকটি বিষয়ে কখনো শিশুকে নিরুৎসাহিত করবেন না; বরং পারলে উৎসাহিত করুন। এসব বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ বললে আপনার শিশু জীবনপথে কত দূর যাবে, তা হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না।
খেলাধুলা: আজকাল কে না জানে, শিশুর শারীরিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা কতা দরকারি। কিন্তু খেলাধুলা শুধু শারীরিক বিকাশই ঘটায় না, এটা শিশুকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও অধ্যবসায়ের মতো গুণও শেখায়। খেলাধুলা সঠিকভাবে জয় উদ্যাপন করতে ও পরাজয়কে মর্যাদার সঙ্গে মেনে নিতে সাহায্য করে। এটা শৃঙ্খলা ও সুস্থ প্রতিযোগিতার মতো সুন্দর বিষয়গুলোও শিশুমনে গেঁথে দেয়।
বড় স্বপ্ন দেখা: মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়—এটা আমরা অনেকেই মানি। তাই শিশুকে শুরু থেকেই বড় স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করতে হবে। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়েও যে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা ও বাস্তবায়ন করা যায়, তা শিশুকে বোঝাতে হবে। অনেক বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করলে তা শিশুকে আত্মবিশ্বাসী, অধ্যবসায়ী ও সৃজনশীল করে গড়ে তুলবে। শিশুকে সাহায্য করবে পরবর্তী জীবনে অর্থবহ ও অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণে।
আবেগের প্রকাশ: শিশুকে তার আবেগ প্রকাশ করতে দিতে হবে। ‘ছেলেরা কাঁদে না, মেয়েরা উচ্চ শব্দে হাসে না’—এমন নানা অকারণ বারণ করা যাবে না। আবেগের যথাযথ প্রকাশ শিশুকে নিজের সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। এটি তার নিজের আবেগময় বোঝাপড়া সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা দেয়। যথাযথভাবে আবেগের প্রকাশ শিশুকে তার নানা অনুভূতি প্রকাশে স্বচ্ছন্দ করে। তার মধ্যে অন্যের প্রতি সহমর্মিতাবোধ তৈরি করে। একই সঙ্গে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে মাত্রাবোধ বজায় রাখতেও সহায়ক।
নিত্যনতুন শখ: শিশুকে তার নিত্যনতুন শখের পেছনে ছুটতে দিতে হবে। এটা তাকে সৃজনশীল করে তুলবে। একই সঙ্গে তা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে শিশুর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলবে। ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’ বলে তাকে বেঁধে রাখা যাবে না। নতুন নতুন শখের পেছনে সময় দিলে তা একসময় শিশুকে নিজের আসল আগ্রহের বিষয় খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে। ধাবিত করবে সত্যিকার ‘প্যাশনের’ প্রতি। এভাবে ছুটে চললে শিশু তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দক্ষতাকে আরও শাণিত করে তুলতে শিখবে।
ভুল করা: ভুল হলো শেখার পথের সিঁড়ি। শিশু ভুল করেই শিখবে এবং এগিয়ে যাবে। এটা তার সহনশীলতা, সূক্ষ্ম চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়িয়ে তুলবে। ভুল থেকে শেখা শিশু জীবনের পথে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিতে সাহসী হয়। একই সঙ্গে এসব শিশু অন্যদের চেয়ে আত্মবিশ্বাসীও হয়।
প্রশ্ন করা: বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’র অপু আর তার বাবা হরিহরের কথা মনে আছে? হরিহর একবার শিশু অপুকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে নানা প্রশ্ন করে হরিহরকে ত্যক্ত করে অপু। কিন্তু এটাই শিশুর সহজাত প্রবণতা। শিশু সবকিছুই জানতে চাইবে। কিন্তু এতে হরিহরের মতো ত্যক্ত হওয়া যাবে না। বরং শিশুকে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করতে হবে। এটা শিশুকে আরও গভীরভাবে জানতে ও বুঝতে শেখাবে। প্রশ্ন করা শিশুর আত্মবিশ্বাস ও সূক্ষ্মভাবে চিন্তার দক্ষতা বাড়ায়। এটা শিশুকে তার চারপাশের জগতের সঙ্গে আরও গভীরভাবে মিশতে সাহায্য করে।
নিজেই সমস্যার সমাধান করা: শিশুকে কোনো সমস্যার সমাধান নিজে নিজেই করতে দিন। ‘ও ছোট, তাই পারবে না’—এমন কথা বলবেন না। এমনকি হোমওয়ার্কের মতো খুঁটিনাটি সব সমস্যা সমাধানে সাহায্য করারও দরকার নেই। নিজে থেকে সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা শিশুকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলে। এটা শিশুর সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করার দক্ষতাও বাড়ায়। নিজে নিজে সমস্যা সমাধানে উৎসাহ দিলে সেই শিশু স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে ওঠে। এটা শিশুকে তার জীবনপথের বিভিন্ন বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
সংগীত শিক্ষা: সংগীত শিশুর সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায় এবং মানসিক দক্ষতা বাড়ায়। একই সঙ্গে তা শিশুকে করে তোলে সুরের মতোই সুশৃঙ্খল। সংগীত শিশুর নিজেকে প্রকাশ করার দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে। একই সঙ্গে তা ধৈর্য ও মনোযোগ আরও বাড়াতে সাহায্য করে।
প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া: শিশুকে প্রকৃতির সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে। তাকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে উৎসাহ দিতে হবে। অনেক অভিভাবকই শিশুকে খালে, বিলে, জলে, জঙ্গলে যেতে বাধা দেন। কিন্তু শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে যদি তেমন কোনো অনিশ্চয়তা না থাকে, তবে তাকে প্রকৃতিতে ছেড়ে দিতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটালে শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো থাকে। এটা শিশুর মধ্যে কৌতূহল জাগ্রত করে। পরিবেশের প্রতি তাকে দায়িত্বশীল ও সচেতনও করে তোলে। সর্বোপরি প্রকৃতির অবাক বিস্ময় সম্পর্কে শিশুকে সজাগ করে তোলে। সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট।