ঢাকা ০৫:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ মে ২০২৫

শিশুচিত্রকলার‘বড় স্যার’: অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক

  • আপডেট সময় : ০১:০০:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • ১০৬ বার পড়া হয়েছে

ফিরোজ আহমেদ ইকবাল : সমুদ্র বিধৌত খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার একটি সবুজ-শ্যামল গ্রাম শ্রীফলতলা। সেখানকার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ জন্মলাভ করেন শিল্পী মোস্তাফিজুল হক। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পিতা আলহাজ¦ ডাঃ জহুরুল হক এবং মাতা সাহাবুন নেছা ছিলেন তৎকালীন গ্রামীণ জীবনযাত্রায় অভিজাত কিন্তু পরোপকারী দম্পতি। তাঁদের পাঁচ সন্তান হলেন- নূরুল হক, মাহমুদুল হক, সাহারা হক, মোস্তাফিজুল হক ও ঝর্ণা হক। সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী পিতা গ্রামের পরিবারগুলোতে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এবং তাদেরকে সম্পৃক্ত করে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রামেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীফলতলা স্কুল। আর, এখানেই শুরু হয় শিশু মোস্তাফিজের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
বড়ভাই নূরুল হক প্রধান শিক্ষক হবার কারণে স্কুল জীবন নিয়ে তেমন কোনো ভয়ডর ছিল না শিশু মোস্তাফিজের মনে। ছেলেবেলা থেকেই চঞ্চল, ডানপিটে ও দুরন্ত স্বভাবের হলেও সুকুমারবৃত্তিগুলো প্রস্ফুটিত হতে দেরি হয়নি একটুও। স্কুল জীবন থেকে ছবি আঁকা, গান গাওয়া, আবৃত্তি ও অভিনয়ের প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। বাড়ির পাশে স্তূপীকৃত ছাইয়ের গাদায় ছোট ছোট আঙুলকে তুলি বানিয়ে চলতো তাঁর আঁকিবুঁকি খেলা। খেলতে খেলতে অনেক সময় ছাইয়ের স্তূপেই ঘুমিয়ে পড়তেন। কেউ হয়তো দুষ্টুমি করে তাঁকে হাঁস-মুরগি ঢাকার খাঁচা দিয়ে ঢেকে রাখতো। শ্রেণিশিক্ষক নওয়াব আলী ও নজমল স্যার পাঠদানের পাশাপাশি আবৃত্তি ও অভিনয় শেখাতেন। তাঁরা বালক মোস্তাফিজের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রতি অদম্য আগ্রহের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। গৃহশিক্ষক ইলিয়াস স্যারসহ রাতের বেলা নিকটবর্তী দাউদখালী নদীর পাড় ধরে হাঁটতেন আর গলা ছেড়ে গান করতেন। দুরন্তপনার কারণে গাছে উঠতে গিয়ে বহুবার পড়ে গেছেন, হাত ভেঙেছেন। মুখ ফেটে যাওয়া বা শরীর ছিলে যাওয়া ছিল নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। গ্রামের মানুষ তাঁর কারণে অস্থির থাকতো সারাক্ষণ। তাই বলে ডানপিটে বালকের প্রতি ভালোবাসার কমতি ছিল না কারুরই।
চিকিৎসক পিতা শ্রীফলতলা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজনের সন্তানেরা শিক্ষা লাভের জন্য এসে থাকতো তাঁরই বাড়িতে। শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়িটি ছিল যেন বিদ্যাশিক্ষার একটি অঘোষিত আশ্রম। সব মিলিয়ে বেশ বড় একটি সংসারে বালক মোস্তাফিজ কখনো ভাবতেই পারতোনা যে, এই বাড়িটি একান্তই তাদের। মিতব্যয়ী, ত্যাগী ও সংগ্রামী পিতা ছিলেন অত্যন্ত সংযমী। মহীয়সী মা সংসার চালানোর ব্যয়ভার সামলে নিতেন কোনো না কোনোভাবে। গ্রামের অন্যান্য সাধারণ পরিবারের জন্যও মা ছিলেন দানশীল, মমতাময়ী ও নিবেদিতপ্রাণ। ফলে, পিতার মতোই মাতাও ছিলেন গ্রামের সর্বসাধারণের কাছে সমাদৃত, প্রশংসিত ও জনপ্রিয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২-এ পনের বছর বয়সে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন কিশোর মোস্তাফিজ। সেসময়ে তাদের বাড়িতে থেকে আরো তিনজন আত্মীয় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন, যারা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল দুরন্ত মোস্তাফিজ অন্যদের মতোই উত্তীর্ণ প্রথম বিভাগে। এই আনন্দে বিদ্যানুরাগী পিতা খাসি জবাই করে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আপ্যায়ন করান। এসএসসি পাশের পর মা তাঁর আদরের ছোট ছেলে মোস্তুকে তুলে দেন মেজ ছেলে শিল্পী অধ্যাপক মাহমুদুল হকের হাতে। ভাইয়ের হাত ধরে ১৯৭৩-এ ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তির মধ্য দিয়েই শুরু হয় চারুকলা নিয়ে মোস্তাফিজুল হকের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা। প্রথম ছয় মাস চলে যায় চারুকলা পাঠ্যসূচির প্রাথমিক বিষয়গুলো বুঝতে। ফলে প্রথমবর্ষে তেমন একটা ভালো করতে পারেননি। দ্বিতীয়বর্ষে ওঠার পর চিত্রকলায় জলরঙ প্রয়োগে হয়ে ওঠেন একেবারে সিদ্ধহস্ত। পিতার মতোই সাংগঠনিক ও সমাজসেবামূলক গুণাবলির জন্য ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দেই সম্পৃক্ত হন শিশু চিত্রকলার সাথে। নিবেদিতপ্রাণ, একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের ফলস্বরূপ এ বছরই আর্ট কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীতে পুরস্কার লাভ করেন। চারুকলার প্রতি নিবিড় ভালোবাসায় সিক্ত মোস্তাফিজুল হক ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠেয় বিএফএ চূড়ান্ত পরীক্ষা ১৯৮০-তে অনুষ্ঠিত হলে কৃতিত্বের সাথে অর্জন করেন ব্যাচেলর অব ফাইন আর্ট বা বিএফএ ডিগ্রী। ¯œাতক পরবর্তী সময় ১৯৮১-তে তিনি ‘নক্শা কেন্দ্র বিসিক’-এ চাকরিতে যোগদান করেন। তখন মাস্টার অব ফাইন আর্টের পড়ালেখা, সরকারি চাকরি এবং চারুকলা বিষয়ের অন্যান্য কর্মযজ্ঞ চলছিল সমানতালে।
স্বাধীনতা উত্তর ঢাকা শহরে শিল্প ও সংস্কৃতি শিক্ষা কর্মকা-ে তেমন কোনো প্রসার ঘটেনি। অগ্রজ, স্বনামখ্যাত শিল্পী অধ্যাপক মাহমুদুল হকের নির্দেশে আজিমপুর লেডিস ক্লাবে শিশুচিত্রকলার সাথে যুক্ত হন ছোটভাই মোস্তাফিজ। লেখিকা জুবেদা খানম ছিলেন সে সময়ের মহিলা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। ছাত্র মোস্তাফিজের প্রতি তাঁর ¯েœহ ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান পদে থাকাকালীন ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে একটি চাইল্ড আর্ট স্কুল খোলার জন্য অনুরোধ করলে শিল্পী মোস্তাফিজের হাত ধরেই বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চিত্রাংকন বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। কঠোর সাধনা, আন্তরিক প্রচেষ্টা আর নিয়মিত অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হতো তখনকার প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত। একই বছর আর্ট কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীতে তৈলচিত্র মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ওই বছরের ৮ মার্চ সাহানা বেগম মঞ্জুর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নতুন সংসার আর চিত্রকলা নিয়ে দিব্যি কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। সেসময় শিশু-কিশোরদের শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে ‘কচি-কণ্ঠের আসর’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। শিল্পী মোস্তাফিজুল হক সেখানে প্রচুর শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করেন অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগ।

ভাষা সৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেন ছিলেন তদানীন্তন নক্শা কেন্দ্র বিসিক-এর প্রধান নক্শাবিদ। সরকারি চাকরিতে তখন চারুশিল্পীদের জন্য প্রথম শ্রেণির পে-স্কেল ছিল না। সংগ্রামী যুবক মোস্তাফিজ প্রধান নক্শাবিদের পথ নির্দেশনায় বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে সরকারের পে কমিশনে যান শিল্পীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। বিসিক সহকর্মী ও সহপাঠী বন্ধু শিল্পী ইমরুল, মাহমুদা, সুধীর, মনোজ, আলমগীর, শাহাদাত, আজিজ শরাফীসহ অনেককে নিয়েই চারুকলার বকুলতলায় শুরু করেন সাংগঠনিক কার্যক্রম। এরই মধ্যে মায়ের কোল আলো করে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে জন্ম নেয় মোস্তাফিজ দম্পতির প্রথম সন্তান সাদ্দাম ইবনে মোস্তাফিজ (অন্তু)। বর্তমানে সে আমেরিকা প্রবাসী।

শিল্পীদের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে শিল্পী মোস্তাফিজকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় একটি কমিটি। এর ছয় মাস পর তাঁকেই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করে প্রকাশিত হয় প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি। নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় চারুশিল্পীদের প্রাণের সংগঠন ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ’। নিরীক্ষাধর্মী কাজের জন্য ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের বার্ষিক শিল্পকলা প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেন। তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার গতিধারায় সেশনজটের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও দমে যাননি এক মুহূর্তও। অবশেষে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের এমএফএ চূড়ান্ত পরীক্ষা ১৯৮৫-তে অনুষ্ঠিত হলে চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন মাস্টার অব ফাইন আর্ট ডিগ্রি। শিশুচিত্রকলা নিয়ে কাজ করতে করতেই ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে হাতিরপুলে বাসাতেই শুরু করেন নিজ প্রতিষ্ঠান ‘প্রভাতি আর্ট স্কুল’। স্থান সংকুলানের জন্য পরে তা স্থানান্তরিত হয় আজিমপুর লেডিস ক্লাবে। সে বছরেরই শেষ মাস ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে মা-বাবার নয়নের মণি কন্যা অনন্যা মোস্তাফিজ দেখে পৃথিবীর আলো।

বিসিকে চাকরিরত অবস্থায় শিল্পী মোস্তাফিজ জাপান সরকারের মনবুশো স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে শুকুবা বিশ^বিদ্যালয়ে গমন করেন। সেখানে প্রথম ছ’মাস জাপানিজ ল্যাংগুয়েজ কোর্স এবং পরে দেড় বছর গবেষণার কাজ সম্পন্ন করে নির্ধারিত পরীক্ষায় অংশ নেন। এ পরীক্ষায় পাশ করলে জাপানিজ স্টাইল অব প্রিন্টিং (নিহঙ্গা) বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রীতে ভর্তির সুযোগ লাভ হয়। পড়াশুনা চলাকালীন নিহঙ্গা রীতিতে বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন শিল্পী মোস্তাফিজুল হক। গভীর ধ্যান, নিয়মিত অধ্যবসায় আর স্বযতœ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয় আরো দু’টি বছর। ফলস্বরূপ ১৯৯৫-এর মার্চ মাসে জাপানের বিখ্যাত শুকুবা বিশ^বিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন দ্বিতীয় মাস্টার ডিগ্রী। এপ্রিলে জাপান সরকার কর্তৃক ওয়ার্ক পারমিট পেলে বিশ^বিখ্যাত তোশিবা কোম্পানিতে চাকরিতে যোগ দেন। সেখানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করতে থাকেন। চাকরিরত অবস্থায় জুলাই মাসে ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। একই বছর আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন।

এসময় বাংলাদেশের শিল্পকলার অঙ্গনে চিত্রশিল্পে এক অভিনব মাত্রার সংযোজন করেন তিনি। জাপানিজ চিত্রকলার রীতি নিহঙ্গা এবং ভারতীয় রীতির সংমিশ্রণে এক ব্যতিক্রম ধারা নিয়ে আসেন, যা তাঁর ক্যানভাসে স্বতন্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে। রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি এক রঙের সাথে আরেক রঙের সংমিশ্রণ ও বাঁধন তৈরিতে বিশেষ নিপুণতার পরিচয় দেন। প্রবহমান জীবনযাত্রার আশপাশে চিরচেনা যে পরিবেশ এবং পশু-পাখির অবয়ব নিয়ে দুঃসাহসী সব চিত্রকর্ম রচনা করেন শিল্পী মোস্তাফিজুল হক। চিত্রকর্মগুলোতে কখনও বাস্তববাদী, কখনও আধা বিমূর্তবাদী আবার কখনওবা বাস্তব-বিমূর্তের মাঝামাঝি একটি নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি প্রস্ফুটিত হয়। শিল্পকর্মের পটের উপরাংশে উজ্জ্বল স্পেস, রঙের বৈপরিত্য এবং ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে বিষয়বস্তুতে এক ধরনের ওজন তৈরি করেন তিনি, যা সাধারণের কাছে দৃষ্টিনন্দন ও প্রশংসা লাভ করে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফাইন আর্ট-এ শিক্ষক পদে যোগদানের পর বিশেষ করে শিশুচিত্রকলার ক্ষেত্রে পরিকল্পিত ও দায়িত্বপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে উদ্ভাবন করেন নতুন এক শৈলী। বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মে যোগদানের ৪ বছর পর ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতি লাভ করেন। বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি শিশুচিত্রাংকনকে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় করে তুলতে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে তাঁর প্রচেষ্টা অবিশ্রান্ত।

চিত্রকর্ম প্রদর্শনী একজন শিল্পীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেশ-বিদেশ মিলে শিল্পী অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হকের এ পর্যন্ত পাঁচটি একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাপানের শুকুবা বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘হিরোসেতে’ নামক গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর প্রথম একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। শিল্পীর দ্বিতীয় একক চিত্রকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় শুকুবাতেই ‘তোবি’ গ্যালারিতে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে। এ বছরই জাপানের রাজধানী টোকিওর গিঞ্জায় অবস্থিত ‘কিউবি’ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর তৃতীয় একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। শিক্ষাবিদ ও শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের চতুর্থ একক চিত্রকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে। শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র নিজস্ব গ্যালারি ‘ক্রিয়েটিভ ডেসটিনেশন’-এ ২০১০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। এর দশ বছর পর করোনা মহামারিকালীন ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ হতে ৩০ জুন অনলাইনভিত্তিক সাড়া জাগানো তাঁর একক পঞ্চম চিত্রকর্ম প্রদর্শনী করেন। ‘বৈশি^ক দুর্যোগের গতি প্রকৃতি: প্যান্ডামিক মুড’ শিরোনামে ভার্চুয়াল ও ত্রি-মাত্রিক একক শিল্পকর্মটি প্রদর্শিত হয় চিত্রকলা গ্যালারিতে।
তবে, দেশে ও বিদেশে মিলে অদ্যাবধি প্রায় অর্ধশত যৌথ চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ছাত্রাবস্থায় ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চারুকলা ইন্সটিটিউটের সকল বার্ষিক প্রদর্শনীতে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল নজর কাড়ার মতো। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘নবীন চিত্রকলা প্রদর্শনী’ ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ এবং ‘এশিয়ান দ্বি-বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী’-তে ১৯৮১ থেকে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেছেন সাফল্যের সাথে। ‘জাতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনী’তে ১৯৮২ থেকে ২০০৯ খিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন। জাপানে অধ্যয়নকালে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর অংশগ্রহণ ছিল শুকুবা বিশ^বিদ্যালয়ের ‘বার্ষিক চিত্রকলা প্রদর্শনী’তে। ‘হিরোসেতে’ গ্যালারিতে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ‘ফরেন স্টুডেন্টস চিত্রকলা প্রদর্শনী’তে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসিত। জাপানের বিখ্যাত মাস্সুশীমা আয়োজিত ১৯, ২০ ও ২১তম ‘স্প্রিং সুগাকী চিত্রকলা প্রদর্শনী’-তে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেন অত্যন্ত সাফল্যের সাথে। জাপানের ‘ঝোওমাচি’ গ্যালারিতে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে এবং ‘হিরোসেতে’ গ্যালারিতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্বৈত চিত্রকলা প্রদর্শনী’ করেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কলকাতায় ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে আয়োজিত ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা চিত্র প্রদর্শনী ও কর্মশালা’তে অংশ নেন সাফল্যের সাথে। গণচীন-এ ‘সমসাময়িক বাংলাদেশ শিল্পকলা প্রদর্শনী’তে অংশগ্রহণ করেন ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে। চিত্রকলার মাধ্যমে ‘জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক বন্ধন প্রদর্শনী’ ২০০৩-এ ছিল তাঁর সফল অংশগ্রহণ। বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্ট কর্তৃক আয়োজিত ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ‘বন্ধুত্বের সেতু’ শীর্ষক ‘বাংলাদেশ জাপান যৌথ শিল্প প্রদর্শনী’তে অংশ নেন। ‘ঢাকা আর্ট সামিট’-এ অংশগ্রহণ করেন ২০১২ ও ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে। নেদারল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে অংশগ্রহণ করেন ‘বাংলাদেশ সমসাময়িক আধুনিক শিল্পকলা প্রদর্শনী’তে। পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত ‘নদীর পাড়ে’ শীর্ষক চিত্রকলা প্রদর্শনীতে অংশ নেন ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে।
চিত্রশিল্পের প্রতি নিবিড় ভালোবাসার কারণেই শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের জীবনের সকল কর্মকা- যেন একই সুতোয় গাঁথা হয়েছে ধাপে ধাপে। আর সে পথ ধরেই ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। শিল্পকলার এই শক্তিশালী অলিন্দে চলাচল করতে গিয়ে পরম মমতায় এবং অতি সহজ করে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন শিশুচিত্রকলাকে। হয়তো এ কারণেই শ্রদ্ধার আসনে আসীন হয়েছেন কলাপ্রেমী শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে। শিক্ষার্থীদের প্রতি নিবিড় মমত্ববোধ আর শিশু চিত্রকলার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণেই সুদীর্ঘ ৪৫ বছর যাবৎ নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের শিশুচিত্রকলার উৎকর্ষ সাধনে। বর্ণমালা ও সংখ্যার মাধ্যমে খুবই সহজভাবে তিনি শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের চিত্রাংকনের কৌশল শিখিয়ে থাকেন। একইসাথে বিভিন্ন আর্ট স্কুল এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে চিত্রকলা বিষয়ে দক্ষ, আন্তরিক ও যোগ্য শিক্ষক তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। তাঁর এ মহতী প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। ইতিমধ্যেই তাঁর মেধাদীপ্ত তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছে শিশুচিত্রকলা বিষয়ের অসংখ্য শিক্ষক। নিঃস্বার্থ এ অবদানের জন্য চিত্রকলাপ্রেমী শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী, তাদের চারুকলা বিষয়ের শিক্ষক এবং অভিভাবকদের নিকট পরিচিতি লাভ করেছেন ‘বড় স্যার’ সম্বোধনে। শিল্পকলার মাধ্যমে শিশুদের মানসিক উৎকর্ষ সাধন বিশেষ করে চিত্রকলায় পারদর্শী করে তোলার জন্য ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলেন আরো একটি প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর চাইল্ড ক্রিয়েটিভিটি’। পরবর্তীতে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠান দু’টির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মোস্তাফিজ একাডেমী অব ফাইন আর্ট’। তাঁরই ¯েœহধন্য কন্যা অনন্যা মোস্তাফিজ বর্তমানে প্রতিষ্ঠান দু’টির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।

চিত্রশিল্পী গড়ার কারিগর শিক্ষাবিদ ও শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা কুঁড়ি শিশু সংগঠন কর্তৃক ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে প্রদান করা হয় ‘আব্দুল আলীম স্মৃতি সম্মাননা’। পরের বছর ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পান ‘মওলানা ভাসানী স্মৃতি সম্মাননা’ এবং পুনরায় আমরা কুঁড়ি শিশু সংগঠন কর্তৃক ‘১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সম্মাননা’। একই বছরে ধারা সাংস্কৃতিক সংঘ কর্তৃক ‘ধারা গোল্ডেন এওয়ার্ড’ প্রাপ্ত হন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ট্রাস্ট কর্তৃক ২০১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে প্রদান করা হয় ‘শিল্পাচার্য সম্মাননা’।

ছেলেবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ অনুরাগ। চিত্রাংকন, সংগীত, অভিনয়, খেলাধুলা সবকিছুর প্রতিই ছিল নিবিড় ভালোবাসা। স্কুল জীবনে অ্যাসেম্বিলিতে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের জন্য শিক্ষকগণ তাঁকে নির্বাচিত করতেন। বিসিকে চাকরিকালীন অফিসের নাটকে অংশ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট এবং শিশু একাডেমির মঞ্চে অভিনয় করেছেন। কন্যা অনন্যা মোস্তাফিজ শৈশবে যখন গৃহ শিক্ষকের কাছে সংগীত শিক্ষা করতো তখন পাশে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে তিনি তা শুনতেন। কন্যার সাথে সাথে হারমোনিয়ামে সারগাম তুলে তা চর্চা করতেন। পঞ্চাশোর্ধ বয়সে এসে নিজ আর্ট স্কুলের সংগীত বিভাগের শিক্ষকদের অনুরোধ করতেন তাঁকে গান শেখানোর জন্য। সংগীত শিক্ষক লাকি, মিতু, তানিমসহ অনেকেই তাঁর প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হন। পরবর্তীতে ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ^বিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্র সংগীতে উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করে আসা সুমী আতিকের কাছে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে শুরু করেন রবীন্দ্র সংগীত চর্চা। দীর্ঘ ৪ বছর নিয়মিত সাধনার পর সংগীত শিক্ষকের আগ্রহে একটি গানের সিডি তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হন। বাংলাদেশ বেতারের সংগীত প্রযোজক দৌলতুর রহমানের সংগীতায়োজনে ১০টি রবীন্দ্র সংগীতের মিউজিক ট্র্যাক তৈরি হয়। অতঃপর বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী লিলি ইসলাম ও সুমী আতিকের তত্ত্বাবধানে গানগুলো শুদ্ধভাবে গাওয়াতে মনোযোগী হন তিনি। নিজেকে প্রস্তুত করে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রুতি স্টুডিওতে রেকর্ডিং সম্পন্ন হলে প্রকাশিত হয় শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের রবীন্দ্র সংগীতের অ্যালবাম ‘আমার হিয়ার মাঝে’। এটি উৎসর্গ করেন মেয়ে এবং ছেলের ঘরের নাতনি মানহা ও আয়াতের উদ্দেশ্যে। এ বছরই তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগের অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।

তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজে অধ্যয়নের সময় ভবিষ্যতে নিজেও একটি ‘ফাইন আর্ট ইন্সটিটিউট’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন কুঁড়ি মেলেছিল তাঁর হৃদয়ের গহিনে। সময়ের সাথে সাথে সেই স্বপ্ন ডালপালা বিস্তার করলে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ধানমন্ডিতে একটি ফাইন আর্ট ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তবে, স্থান সংকুলানের অভাবে তাঁর সে স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। পরবর্তীতে সহধর্মিণীর বড়ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত’র সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে অর্থ ও স্থানের ব্যাপারে তিনি নিশ্চয়তা প্রদান করেন। তখন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শিল্পী মাহমুদুল হক, সুবীর চৌধুরীসহ বিশিষ্টজনদের সম্পৃক্ত করে ২০০২ খ্রিস্টাব্দে যাত্রা শুরু করে ‘শান্ত-মারিয়াম একাডেমি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’ এবং ‘ইধহমষধফবংয ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ অৎঃ, উবংরমহ ্ ঞবপযহড়ষড়মু’ নামের দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অবশ্য পরবর্তীতে ইন্সটিটিউটের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শান্ত-মারিয়াম ইন্সটিটিউট অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’টি প্রতিষ্ঠার পরও শিক্ষাবিদ মোস্তাফিজুল হকের ভিতরে একটা অতৃপ্তি যেন সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। দূরদর্শী বড়ভাই শিল্পপতি শান্ত বুঝতে পারেন, ভগ্নিপতির মনের কোনো অপূর্ণতা তাঁকে পীড়া দিচ্ছে। এসময় স্বনামখ্যাত বেতার ও টেলিভিশন উপস্থাপিকা কণ্ঠকন্যা হেনা কবীর সাংস্কৃতিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করার বিষয়েও তাঁদেরকে অনুপ্রাণিত করেন। সমাজসেবক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বড়ভাই শান্ত ইউরোপে থাকাকালীন দেখে এসেছেন ডিজাইন শিক্ষার প্রসার ও গুরুত্ব। কিন্তু সেসময় বাংলাদেশে ডিজাইন শিক্ষার পাঠদানের জন্য কোনো শিক্ষক ছিল না। হঠাৎ করেই পরিচয় হয় আয়ারল্যান্ডের নাগরিক প্রফেসর শীনা মার্গারেট ফ্যালকোনার সাথে। তিনি প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনতে উৎসাহ প্রদানসহ বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন। অবশেষে, শিক্ষানুরাগী মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত’র উদ্যোগে এবং অধ্যাপক শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের আন্তরিক সহযোগিতায় ফাইন আর্ট, পারফরমিং আর্ট ও ডিজাইন শিক্ষাকে সংযুক্ত করে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’। শিল্পী অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে অত্যন্ত সফলতার সাথে।
একজন শিল্পীর মনে সংগ্রহশালা তৈরির স্বপ্ন উঁকি দিয়ে যাবে এটাইতো স্বাভাবিক। নিজ পিত্রালয় শ্রীফলতলা গ্রামে শিল্পগুরু ও সহোদর, শিল্পী অধ্যাপক মাহমুদুল হককে সঙ্গে নিয়ে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মাহমুদ-মোস্তাফিজ সংগ্রহশালা’। উদ্দেশ্য হলো সেখানে শিল্পীগণ যাবেন, অতিথি ঘরে থাকবেন, এলাকাতে বেড়াবেন, ইচ্ছেমতো ছবি আঁকবেন এবং এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সে অঞ্চলে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে। একইসাথে রাজধানীকেন্দ্রিক মূলধারার যে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা তার সাথে অনগ্রসর এলাকার সেতুবন্ধ তৈরি হবে। আর এ লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে দেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন্নবী, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, শেখ আফজাল, শামসুদ্দোহাসহ খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্মিলনে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘মাহমুদ-মোস্তাফিজ সংগ্রহশালা’য় একটি বর্ণাঢ্য আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়।

‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই অমোঘ সত্যকে মনেপ্রাণে বিশ^াস করেন বলেই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পেশাগত জীবনের সহকর্মী, প্রিয় শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী, দুঃস্থ মানুষ যে কারুরই প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে বিলম্ব করেন না শিল্পী মোস্তাফিজ। দৈবাৎ চীনের উহান প্রদেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস নামের এক মরণব্যাধির কথা জানা যায় ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর তারিখে। এই ভয়াভহ ভাইরাসটি সমগ্র বিশে^ যখন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন তিনি খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ভাবতে থাকেন তাঁর এখন কি করা উচিত? মৃত্যুভয়ংকর এই মহামারিকে জয় করার প্রচেষ্টায় তিনি কিভাবে একাত্ম হবেন। বিশে^র অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও তখন শুরু হয়েছে মৃত্যুর ভয়াল বিভীষিকা। ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েও তিনি অসীম সাহসে হাতে তুলে নেন প্রিয় রং-তুলি। ক্যানভাসের বুকে ছড়িয়ে দিতে থাকেন তাঁর সকল দুশ্চিন্তা, সকল ভাবনা, সকল কষ্ট, সকল পর্যবেক্ষণ। রং-তুলি-ক্যানভাসের সাথে চলে শিল্পকর্ম সৃষ্টির অসাধারণ এক খেলা। তুলির আঁচড়ে একের পর এক রচনা করতে থাকেন ব্যতিক্রম সব চিত্রকর্ম। লক ডাউনের দু’মাসে তাঁর আঁকা শিল্পকর্মগুলো নিয়ে ১৫ থেকে ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত অনলাইন প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত হয় ‘বৈশি^ক দুর্যোগের গতি প্রকৃতি : পেন্ডামিক মুড’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনী। স্বনামখ্যাত চিত্রশিল্পী অধ্যাপক রফিকুন্নবী ব্যতিক্রমধর্মী এই শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর শুভ উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের প্রথম ভার্চুয়াল থ্রিডি পদ্ধতির মাধ্যমে চিত্রকলা গ্যালারির আয়োজনে তাঁর এই একক প্রদর্শনীতে বিক্রয়লব্ধ চিত্রকর্মগুলোর অর্ধেক অর্থ তুলে দেন করোনা ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী ও দুঃস্থজনের সহযোগিতায়।
আকস্মিকভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ৩০ মে না ফেরার দেশে চলে যান শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত। ব্যথিত শিল্পী প্রয়াত বন্ধুপ্রতিম বড়ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রদর্শনীটি তাঁরই নামে উৎসর্গ করেন। শান্ত-মারিয়াম বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের মহাপ্রয়াণে এবং তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী ১৮ জুন ২০২০-এ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যবৃন্দ কর্তৃক শিল্পী মোস্তাফিজুল হক নির্বাচিত হন নতুন চেয়ারম্যান। মানবোচিত গুণাবলিসম্পন্ন হবার প্রচেষ্টায় যিনি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন সফলতো তিনি হবেনই। হয়তো সে কারণেই গ্রামের ডানপিটে ছেলেটি সময়ের পরিক্রমায় হয়ে উঠেন শিল্পী অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক।
তথ্যসূত্র :

 Mostafi“ul Haque, Nwe Chairman of SMUCT, The Daily Observer, 03-07-2020, Friday, Page-3
 শিল্পী অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক, প্রথম আলো, ০৫-০৭-২০২০, রোববার, পৃষ্ঠা-১০
 শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের একক চতুর্থ শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ক্যাটালগ, ক্রিয়েটিভ ডেসটিনেশন, জসীমউদ্দিন, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
ব্যক্তিগত আলাপচারিতা

 শিল্পী মাহমুদুল হক, অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ছাপচিত্র বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এবং প্রাক্তন মহাপরিচালক, জাতীয় জাদুঘর, শাহবাগ, ঢাকা
 শিল্পী মোস্তাফিজুল হক, অধ্যাপক, অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
 শিল্পী দেওয়ান মিজান, সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
 সাদাত ইবনে মাহমুদ, হেড অব মার্কেটিং, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
 শিল্পী মোঃ রেজওয়ানুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
 শিল্পী মোঃ মেহেদী মাসুদ, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, মৃৎশিল্প বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এবং সিনিয়র ডিজাইনার, ক্রিয়েটিভ দ্য আর্ট গ্যালারি, ৪৫ সোনারগাঁও জনপথ রোড, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও গবেষক

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

শিশুচিত্রকলার‘বড় স্যার’: অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক

আপডেট সময় : ০১:০০:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফিরোজ আহমেদ ইকবাল : সমুদ্র বিধৌত খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার একটি সবুজ-শ্যামল গ্রাম শ্রীফলতলা। সেখানকার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ জন্মলাভ করেন শিল্পী মোস্তাফিজুল হক। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পিতা আলহাজ¦ ডাঃ জহুরুল হক এবং মাতা সাহাবুন নেছা ছিলেন তৎকালীন গ্রামীণ জীবনযাত্রায় অভিজাত কিন্তু পরোপকারী দম্পতি। তাঁদের পাঁচ সন্তান হলেন- নূরুল হক, মাহমুদুল হক, সাহারা হক, মোস্তাফিজুল হক ও ঝর্ণা হক। সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী পিতা গ্রামের পরিবারগুলোতে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এবং তাদেরকে সম্পৃক্ত করে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রামেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীফলতলা স্কুল। আর, এখানেই শুরু হয় শিশু মোস্তাফিজের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
বড়ভাই নূরুল হক প্রধান শিক্ষক হবার কারণে স্কুল জীবন নিয়ে তেমন কোনো ভয়ডর ছিল না শিশু মোস্তাফিজের মনে। ছেলেবেলা থেকেই চঞ্চল, ডানপিটে ও দুরন্ত স্বভাবের হলেও সুকুমারবৃত্তিগুলো প্রস্ফুটিত হতে দেরি হয়নি একটুও। স্কুল জীবন থেকে ছবি আঁকা, গান গাওয়া, আবৃত্তি ও অভিনয়ের প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। বাড়ির পাশে স্তূপীকৃত ছাইয়ের গাদায় ছোট ছোট আঙুলকে তুলি বানিয়ে চলতো তাঁর আঁকিবুঁকি খেলা। খেলতে খেলতে অনেক সময় ছাইয়ের স্তূপেই ঘুমিয়ে পড়তেন। কেউ হয়তো দুষ্টুমি করে তাঁকে হাঁস-মুরগি ঢাকার খাঁচা দিয়ে ঢেকে রাখতো। শ্রেণিশিক্ষক নওয়াব আলী ও নজমল স্যার পাঠদানের পাশাপাশি আবৃত্তি ও অভিনয় শেখাতেন। তাঁরা বালক মোস্তাফিজের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রতি অদম্য আগ্রহের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। গৃহশিক্ষক ইলিয়াস স্যারসহ রাতের বেলা নিকটবর্তী দাউদখালী নদীর পাড় ধরে হাঁটতেন আর গলা ছেড়ে গান করতেন। দুরন্তপনার কারণে গাছে উঠতে গিয়ে বহুবার পড়ে গেছেন, হাত ভেঙেছেন। মুখ ফেটে যাওয়া বা শরীর ছিলে যাওয়া ছিল নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। গ্রামের মানুষ তাঁর কারণে অস্থির থাকতো সারাক্ষণ। তাই বলে ডানপিটে বালকের প্রতি ভালোবাসার কমতি ছিল না কারুরই।
চিকিৎসক পিতা শ্রীফলতলা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজনের সন্তানেরা শিক্ষা লাভের জন্য এসে থাকতো তাঁরই বাড়িতে। শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়িটি ছিল যেন বিদ্যাশিক্ষার একটি অঘোষিত আশ্রম। সব মিলিয়ে বেশ বড় একটি সংসারে বালক মোস্তাফিজ কখনো ভাবতেই পারতোনা যে, এই বাড়িটি একান্তই তাদের। মিতব্যয়ী, ত্যাগী ও সংগ্রামী পিতা ছিলেন অত্যন্ত সংযমী। মহীয়সী মা সংসার চালানোর ব্যয়ভার সামলে নিতেন কোনো না কোনোভাবে। গ্রামের অন্যান্য সাধারণ পরিবারের জন্যও মা ছিলেন দানশীল, মমতাময়ী ও নিবেদিতপ্রাণ। ফলে, পিতার মতোই মাতাও ছিলেন গ্রামের সর্বসাধারণের কাছে সমাদৃত, প্রশংসিত ও জনপ্রিয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২-এ পনের বছর বয়সে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন কিশোর মোস্তাফিজ। সেসময়ে তাদের বাড়িতে থেকে আরো তিনজন আত্মীয় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন, যারা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল দুরন্ত মোস্তাফিজ অন্যদের মতোই উত্তীর্ণ প্রথম বিভাগে। এই আনন্দে বিদ্যানুরাগী পিতা খাসি জবাই করে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আপ্যায়ন করান। এসএসসি পাশের পর মা তাঁর আদরের ছোট ছেলে মোস্তুকে তুলে দেন মেজ ছেলে শিল্পী অধ্যাপক মাহমুদুল হকের হাতে। ভাইয়ের হাত ধরে ১৯৭৩-এ ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তির মধ্য দিয়েই শুরু হয় চারুকলা নিয়ে মোস্তাফিজুল হকের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা। প্রথম ছয় মাস চলে যায় চারুকলা পাঠ্যসূচির প্রাথমিক বিষয়গুলো বুঝতে। ফলে প্রথমবর্ষে তেমন একটা ভালো করতে পারেননি। দ্বিতীয়বর্ষে ওঠার পর চিত্রকলায় জলরঙ প্রয়োগে হয়ে ওঠেন একেবারে সিদ্ধহস্ত। পিতার মতোই সাংগঠনিক ও সমাজসেবামূলক গুণাবলির জন্য ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দেই সম্পৃক্ত হন শিশু চিত্রকলার সাথে। নিবেদিতপ্রাণ, একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের ফলস্বরূপ এ বছরই আর্ট কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীতে পুরস্কার লাভ করেন। চারুকলার প্রতি নিবিড় ভালোবাসায় সিক্ত মোস্তাফিজুল হক ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠেয় বিএফএ চূড়ান্ত পরীক্ষা ১৯৮০-তে অনুষ্ঠিত হলে কৃতিত্বের সাথে অর্জন করেন ব্যাচেলর অব ফাইন আর্ট বা বিএফএ ডিগ্রী। ¯œাতক পরবর্তী সময় ১৯৮১-তে তিনি ‘নক্শা কেন্দ্র বিসিক’-এ চাকরিতে যোগদান করেন। তখন মাস্টার অব ফাইন আর্টের পড়ালেখা, সরকারি চাকরি এবং চারুকলা বিষয়ের অন্যান্য কর্মযজ্ঞ চলছিল সমানতালে।
স্বাধীনতা উত্তর ঢাকা শহরে শিল্প ও সংস্কৃতি শিক্ষা কর্মকা-ে তেমন কোনো প্রসার ঘটেনি। অগ্রজ, স্বনামখ্যাত শিল্পী অধ্যাপক মাহমুদুল হকের নির্দেশে আজিমপুর লেডিস ক্লাবে শিশুচিত্রকলার সাথে যুক্ত হন ছোটভাই মোস্তাফিজ। লেখিকা জুবেদা খানম ছিলেন সে সময়ের মহিলা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। ছাত্র মোস্তাফিজের প্রতি তাঁর ¯েœহ ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান পদে থাকাকালীন ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে একটি চাইল্ড আর্ট স্কুল খোলার জন্য অনুরোধ করলে শিল্পী মোস্তাফিজের হাত ধরেই বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চিত্রাংকন বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। কঠোর সাধনা, আন্তরিক প্রচেষ্টা আর নিয়মিত অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হতো তখনকার প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত। একই বছর আর্ট কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীতে তৈলচিত্র মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ওই বছরের ৮ মার্চ সাহানা বেগম মঞ্জুর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নতুন সংসার আর চিত্রকলা নিয়ে দিব্যি কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। সেসময় শিশু-কিশোরদের শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে ‘কচি-কণ্ঠের আসর’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। শিল্পী মোস্তাফিজুল হক সেখানে প্রচুর শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করেন অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগ।

ভাষা সৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেন ছিলেন তদানীন্তন নক্শা কেন্দ্র বিসিক-এর প্রধান নক্শাবিদ। সরকারি চাকরিতে তখন চারুশিল্পীদের জন্য প্রথম শ্রেণির পে-স্কেল ছিল না। সংগ্রামী যুবক মোস্তাফিজ প্রধান নক্শাবিদের পথ নির্দেশনায় বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে সরকারের পে কমিশনে যান শিল্পীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। বিসিক সহকর্মী ও সহপাঠী বন্ধু শিল্পী ইমরুল, মাহমুদা, সুধীর, মনোজ, আলমগীর, শাহাদাত, আজিজ শরাফীসহ অনেককে নিয়েই চারুকলার বকুলতলায় শুরু করেন সাংগঠনিক কার্যক্রম। এরই মধ্যে মায়ের কোল আলো করে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে জন্ম নেয় মোস্তাফিজ দম্পতির প্রথম সন্তান সাদ্দাম ইবনে মোস্তাফিজ (অন্তু)। বর্তমানে সে আমেরিকা প্রবাসী।

শিল্পীদের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে শিল্পী মোস্তাফিজকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় একটি কমিটি। এর ছয় মাস পর তাঁকেই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করে প্রকাশিত হয় প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি। নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় চারুশিল্পীদের প্রাণের সংগঠন ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ’। নিরীক্ষাধর্মী কাজের জন্য ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের বার্ষিক শিল্পকলা প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেন। তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার গতিধারায় সেশনজটের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও দমে যাননি এক মুহূর্তও। অবশেষে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের এমএফএ চূড়ান্ত পরীক্ষা ১৯৮৫-তে অনুষ্ঠিত হলে চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন মাস্টার অব ফাইন আর্ট ডিগ্রি। শিশুচিত্রকলা নিয়ে কাজ করতে করতেই ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে হাতিরপুলে বাসাতেই শুরু করেন নিজ প্রতিষ্ঠান ‘প্রভাতি আর্ট স্কুল’। স্থান সংকুলানের জন্য পরে তা স্থানান্তরিত হয় আজিমপুর লেডিস ক্লাবে। সে বছরেরই শেষ মাস ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে মা-বাবার নয়নের মণি কন্যা অনন্যা মোস্তাফিজ দেখে পৃথিবীর আলো।

বিসিকে চাকরিরত অবস্থায় শিল্পী মোস্তাফিজ জাপান সরকারের মনবুশো স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে শুকুবা বিশ^বিদ্যালয়ে গমন করেন। সেখানে প্রথম ছ’মাস জাপানিজ ল্যাংগুয়েজ কোর্স এবং পরে দেড় বছর গবেষণার কাজ সম্পন্ন করে নির্ধারিত পরীক্ষায় অংশ নেন। এ পরীক্ষায় পাশ করলে জাপানিজ স্টাইল অব প্রিন্টিং (নিহঙ্গা) বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রীতে ভর্তির সুযোগ লাভ হয়। পড়াশুনা চলাকালীন নিহঙ্গা রীতিতে বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন শিল্পী মোস্তাফিজুল হক। গভীর ধ্যান, নিয়মিত অধ্যবসায় আর স্বযতœ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয় আরো দু’টি বছর। ফলস্বরূপ ১৯৯৫-এর মার্চ মাসে জাপানের বিখ্যাত শুকুবা বিশ^বিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন দ্বিতীয় মাস্টার ডিগ্রী। এপ্রিলে জাপান সরকার কর্তৃক ওয়ার্ক পারমিট পেলে বিশ^বিখ্যাত তোশিবা কোম্পানিতে চাকরিতে যোগ দেন। সেখানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করতে থাকেন। চাকরিরত অবস্থায় জুলাই মাসে ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। একই বছর আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন।

এসময় বাংলাদেশের শিল্পকলার অঙ্গনে চিত্রশিল্পে এক অভিনব মাত্রার সংযোজন করেন তিনি। জাপানিজ চিত্রকলার রীতি নিহঙ্গা এবং ভারতীয় রীতির সংমিশ্রণে এক ব্যতিক্রম ধারা নিয়ে আসেন, যা তাঁর ক্যানভাসে স্বতন্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে। রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি এক রঙের সাথে আরেক রঙের সংমিশ্রণ ও বাঁধন তৈরিতে বিশেষ নিপুণতার পরিচয় দেন। প্রবহমান জীবনযাত্রার আশপাশে চিরচেনা যে পরিবেশ এবং পশু-পাখির অবয়ব নিয়ে দুঃসাহসী সব চিত্রকর্ম রচনা করেন শিল্পী মোস্তাফিজুল হক। চিত্রকর্মগুলোতে কখনও বাস্তববাদী, কখনও আধা বিমূর্তবাদী আবার কখনওবা বাস্তব-বিমূর্তের মাঝামাঝি একটি নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি প্রস্ফুটিত হয়। শিল্পকর্মের পটের উপরাংশে উজ্জ্বল স্পেস, রঙের বৈপরিত্য এবং ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে বিষয়বস্তুতে এক ধরনের ওজন তৈরি করেন তিনি, যা সাধারণের কাছে দৃষ্টিনন্দন ও প্রশংসা লাভ করে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফাইন আর্ট-এ শিক্ষক পদে যোগদানের পর বিশেষ করে শিশুচিত্রকলার ক্ষেত্রে পরিকল্পিত ও দায়িত্বপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে উদ্ভাবন করেন নতুন এক শৈলী। বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মে যোগদানের ৪ বছর পর ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতি লাভ করেন। বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি শিশুচিত্রাংকনকে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় করে তুলতে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে তাঁর প্রচেষ্টা অবিশ্রান্ত।

চিত্রকর্ম প্রদর্শনী একজন শিল্পীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেশ-বিদেশ মিলে শিল্পী অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হকের এ পর্যন্ত পাঁচটি একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাপানের শুকুবা বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘হিরোসেতে’ নামক গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর প্রথম একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। শিল্পীর দ্বিতীয় একক চিত্রকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় শুকুবাতেই ‘তোবি’ গ্যালারিতে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে। এ বছরই জাপানের রাজধানী টোকিওর গিঞ্জায় অবস্থিত ‘কিউবি’ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর তৃতীয় একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। শিক্ষাবিদ ও শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের চতুর্থ একক চিত্রকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে। শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র নিজস্ব গ্যালারি ‘ক্রিয়েটিভ ডেসটিনেশন’-এ ২০১০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। এর দশ বছর পর করোনা মহামারিকালীন ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ হতে ৩০ জুন অনলাইনভিত্তিক সাড়া জাগানো তাঁর একক পঞ্চম চিত্রকর্ম প্রদর্শনী করেন। ‘বৈশি^ক দুর্যোগের গতি প্রকৃতি: প্যান্ডামিক মুড’ শিরোনামে ভার্চুয়াল ও ত্রি-মাত্রিক একক শিল্পকর্মটি প্রদর্শিত হয় চিত্রকলা গ্যালারিতে।
তবে, দেশে ও বিদেশে মিলে অদ্যাবধি প্রায় অর্ধশত যৌথ চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ছাত্রাবস্থায় ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চারুকলা ইন্সটিটিউটের সকল বার্ষিক প্রদর্শনীতে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল নজর কাড়ার মতো। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘নবীন চিত্রকলা প্রদর্শনী’ ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ এবং ‘এশিয়ান দ্বি-বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী’-তে ১৯৮১ থেকে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেছেন সাফল্যের সাথে। ‘জাতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনী’তে ১৯৮২ থেকে ২০০৯ খিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন। জাপানে অধ্যয়নকালে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর অংশগ্রহণ ছিল শুকুবা বিশ^বিদ্যালয়ের ‘বার্ষিক চিত্রকলা প্রদর্শনী’তে। ‘হিরোসেতে’ গ্যালারিতে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ‘ফরেন স্টুডেন্টস চিত্রকলা প্রদর্শনী’তে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসিত। জাপানের বিখ্যাত মাস্সুশীমা আয়োজিত ১৯, ২০ ও ২১তম ‘স্প্রিং সুগাকী চিত্রকলা প্রদর্শনী’-তে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেন অত্যন্ত সাফল্যের সাথে। জাপানের ‘ঝোওমাচি’ গ্যালারিতে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে এবং ‘হিরোসেতে’ গ্যালারিতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্বৈত চিত্রকলা প্রদর্শনী’ করেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কলকাতায় ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে আয়োজিত ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা চিত্র প্রদর্শনী ও কর্মশালা’তে অংশ নেন সাফল্যের সাথে। গণচীন-এ ‘সমসাময়িক বাংলাদেশ শিল্পকলা প্রদর্শনী’তে অংশগ্রহণ করেন ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে। চিত্রকলার মাধ্যমে ‘জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক বন্ধন প্রদর্শনী’ ২০০৩-এ ছিল তাঁর সফল অংশগ্রহণ। বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্ট কর্তৃক আয়োজিত ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ‘বন্ধুত্বের সেতু’ শীর্ষক ‘বাংলাদেশ জাপান যৌথ শিল্প প্রদর্শনী’তে অংশ নেন। ‘ঢাকা আর্ট সামিট’-এ অংশগ্রহণ করেন ২০১২ ও ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে। নেদারল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে অংশগ্রহণ করেন ‘বাংলাদেশ সমসাময়িক আধুনিক শিল্পকলা প্রদর্শনী’তে। পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত ‘নদীর পাড়ে’ শীর্ষক চিত্রকলা প্রদর্শনীতে অংশ নেন ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে।
চিত্রশিল্পের প্রতি নিবিড় ভালোবাসার কারণেই শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের জীবনের সকল কর্মকা- যেন একই সুতোয় গাঁথা হয়েছে ধাপে ধাপে। আর সে পথ ধরেই ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। শিল্পকলার এই শক্তিশালী অলিন্দে চলাচল করতে গিয়ে পরম মমতায় এবং অতি সহজ করে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন শিশুচিত্রকলাকে। হয়তো এ কারণেই শ্রদ্ধার আসনে আসীন হয়েছেন কলাপ্রেমী শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে। শিক্ষার্থীদের প্রতি নিবিড় মমত্ববোধ আর শিশু চিত্রকলার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণেই সুদীর্ঘ ৪৫ বছর যাবৎ নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের শিশুচিত্রকলার উৎকর্ষ সাধনে। বর্ণমালা ও সংখ্যার মাধ্যমে খুবই সহজভাবে তিনি শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের চিত্রাংকনের কৌশল শিখিয়ে থাকেন। একইসাথে বিভিন্ন আর্ট স্কুল এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে চিত্রকলা বিষয়ে দক্ষ, আন্তরিক ও যোগ্য শিক্ষক তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। তাঁর এ মহতী প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। ইতিমধ্যেই তাঁর মেধাদীপ্ত তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছে শিশুচিত্রকলা বিষয়ের অসংখ্য শিক্ষক। নিঃস্বার্থ এ অবদানের জন্য চিত্রকলাপ্রেমী শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী, তাদের চারুকলা বিষয়ের শিক্ষক এবং অভিভাবকদের নিকট পরিচিতি লাভ করেছেন ‘বড় স্যার’ সম্বোধনে। শিল্পকলার মাধ্যমে শিশুদের মানসিক উৎকর্ষ সাধন বিশেষ করে চিত্রকলায় পারদর্শী করে তোলার জন্য ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলেন আরো একটি প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর চাইল্ড ক্রিয়েটিভিটি’। পরবর্তীতে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠান দু’টির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মোস্তাফিজ একাডেমী অব ফাইন আর্ট’। তাঁরই ¯েœহধন্য কন্যা অনন্যা মোস্তাফিজ বর্তমানে প্রতিষ্ঠান দু’টির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।

চিত্রশিল্পী গড়ার কারিগর শিক্ষাবিদ ও শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা কুঁড়ি শিশু সংগঠন কর্তৃক ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে প্রদান করা হয় ‘আব্দুল আলীম স্মৃতি সম্মাননা’। পরের বছর ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পান ‘মওলানা ভাসানী স্মৃতি সম্মাননা’ এবং পুনরায় আমরা কুঁড়ি শিশু সংগঠন কর্তৃক ‘১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সম্মাননা’। একই বছরে ধারা সাংস্কৃতিক সংঘ কর্তৃক ‘ধারা গোল্ডেন এওয়ার্ড’ প্রাপ্ত হন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ট্রাস্ট কর্তৃক ২০১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে প্রদান করা হয় ‘শিল্পাচার্য সম্মাননা’।

ছেলেবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ অনুরাগ। চিত্রাংকন, সংগীত, অভিনয়, খেলাধুলা সবকিছুর প্রতিই ছিল নিবিড় ভালোবাসা। স্কুল জীবনে অ্যাসেম্বিলিতে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের জন্য শিক্ষকগণ তাঁকে নির্বাচিত করতেন। বিসিকে চাকরিকালীন অফিসের নাটকে অংশ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট এবং শিশু একাডেমির মঞ্চে অভিনয় করেছেন। কন্যা অনন্যা মোস্তাফিজ শৈশবে যখন গৃহ শিক্ষকের কাছে সংগীত শিক্ষা করতো তখন পাশে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে তিনি তা শুনতেন। কন্যার সাথে সাথে হারমোনিয়ামে সারগাম তুলে তা চর্চা করতেন। পঞ্চাশোর্ধ বয়সে এসে নিজ আর্ট স্কুলের সংগীত বিভাগের শিক্ষকদের অনুরোধ করতেন তাঁকে গান শেখানোর জন্য। সংগীত শিক্ষক লাকি, মিতু, তানিমসহ অনেকেই তাঁর প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হন। পরবর্তীতে ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ^বিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্র সংগীতে উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করে আসা সুমী আতিকের কাছে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে শুরু করেন রবীন্দ্র সংগীত চর্চা। দীর্ঘ ৪ বছর নিয়মিত সাধনার পর সংগীত শিক্ষকের আগ্রহে একটি গানের সিডি তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হন। বাংলাদেশ বেতারের সংগীত প্রযোজক দৌলতুর রহমানের সংগীতায়োজনে ১০টি রবীন্দ্র সংগীতের মিউজিক ট্র্যাক তৈরি হয়। অতঃপর বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী লিলি ইসলাম ও সুমী আতিকের তত্ত্বাবধানে গানগুলো শুদ্ধভাবে গাওয়াতে মনোযোগী হন তিনি। নিজেকে প্রস্তুত করে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রুতি স্টুডিওতে রেকর্ডিং সম্পন্ন হলে প্রকাশিত হয় শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের রবীন্দ্র সংগীতের অ্যালবাম ‘আমার হিয়ার মাঝে’। এটি উৎসর্গ করেন মেয়ে এবং ছেলের ঘরের নাতনি মানহা ও আয়াতের উদ্দেশ্যে। এ বছরই তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগের অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।

তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজে অধ্যয়নের সময় ভবিষ্যতে নিজেও একটি ‘ফাইন আর্ট ইন্সটিটিউট’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন কুঁড়ি মেলেছিল তাঁর হৃদয়ের গহিনে। সময়ের সাথে সাথে সেই স্বপ্ন ডালপালা বিস্তার করলে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ধানমন্ডিতে একটি ফাইন আর্ট ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তবে, স্থান সংকুলানের অভাবে তাঁর সে স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। পরবর্তীতে সহধর্মিণীর বড়ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত’র সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে অর্থ ও স্থানের ব্যাপারে তিনি নিশ্চয়তা প্রদান করেন। তখন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শিল্পী মাহমুদুল হক, সুবীর চৌধুরীসহ বিশিষ্টজনদের সম্পৃক্ত করে ২০০২ খ্রিস্টাব্দে যাত্রা শুরু করে ‘শান্ত-মারিয়াম একাডেমি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’ এবং ‘ইধহমষধফবংয ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ অৎঃ, উবংরমহ ্ ঞবপযহড়ষড়মু’ নামের দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অবশ্য পরবর্তীতে ইন্সটিটিউটের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শান্ত-মারিয়াম ইন্সটিটিউট অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’টি প্রতিষ্ঠার পরও শিক্ষাবিদ মোস্তাফিজুল হকের ভিতরে একটা অতৃপ্তি যেন সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। দূরদর্শী বড়ভাই শিল্পপতি শান্ত বুঝতে পারেন, ভগ্নিপতির মনের কোনো অপূর্ণতা তাঁকে পীড়া দিচ্ছে। এসময় স্বনামখ্যাত বেতার ও টেলিভিশন উপস্থাপিকা কণ্ঠকন্যা হেনা কবীর সাংস্কৃতিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করার বিষয়েও তাঁদেরকে অনুপ্রাণিত করেন। সমাজসেবক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বড়ভাই শান্ত ইউরোপে থাকাকালীন দেখে এসেছেন ডিজাইন শিক্ষার প্রসার ও গুরুত্ব। কিন্তু সেসময় বাংলাদেশে ডিজাইন শিক্ষার পাঠদানের জন্য কোনো শিক্ষক ছিল না। হঠাৎ করেই পরিচয় হয় আয়ারল্যান্ডের নাগরিক প্রফেসর শীনা মার্গারেট ফ্যালকোনার সাথে। তিনি প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনতে উৎসাহ প্রদানসহ বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন। অবশেষে, শিক্ষানুরাগী মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত’র উদ্যোগে এবং অধ্যাপক শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের আন্তরিক সহযোগিতায় ফাইন আর্ট, পারফরমিং আর্ট ও ডিজাইন শিক্ষাকে সংযুক্ত করে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’। শিল্পী অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে অত্যন্ত সফলতার সাথে।
একজন শিল্পীর মনে সংগ্রহশালা তৈরির স্বপ্ন উঁকি দিয়ে যাবে এটাইতো স্বাভাবিক। নিজ পিত্রালয় শ্রীফলতলা গ্রামে শিল্পগুরু ও সহোদর, শিল্পী অধ্যাপক মাহমুদুল হককে সঙ্গে নিয়ে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মাহমুদ-মোস্তাফিজ সংগ্রহশালা’। উদ্দেশ্য হলো সেখানে শিল্পীগণ যাবেন, অতিথি ঘরে থাকবেন, এলাকাতে বেড়াবেন, ইচ্ছেমতো ছবি আঁকবেন এবং এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সে অঞ্চলে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে। একইসাথে রাজধানীকেন্দ্রিক মূলধারার যে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা তার সাথে অনগ্রসর এলাকার সেতুবন্ধ তৈরি হবে। আর এ লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে দেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন্নবী, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, শেখ আফজাল, শামসুদ্দোহাসহ খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্মিলনে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘মাহমুদ-মোস্তাফিজ সংগ্রহশালা’য় একটি বর্ণাঢ্য আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়।

‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই অমোঘ সত্যকে মনেপ্রাণে বিশ^াস করেন বলেই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পেশাগত জীবনের সহকর্মী, প্রিয় শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী, দুঃস্থ মানুষ যে কারুরই প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে বিলম্ব করেন না শিল্পী মোস্তাফিজ। দৈবাৎ চীনের উহান প্রদেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস নামের এক মরণব্যাধির কথা জানা যায় ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর তারিখে। এই ভয়াভহ ভাইরাসটি সমগ্র বিশে^ যখন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন তিনি খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ভাবতে থাকেন তাঁর এখন কি করা উচিত? মৃত্যুভয়ংকর এই মহামারিকে জয় করার প্রচেষ্টায় তিনি কিভাবে একাত্ম হবেন। বিশে^র অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও তখন শুরু হয়েছে মৃত্যুর ভয়াল বিভীষিকা। ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েও তিনি অসীম সাহসে হাতে তুলে নেন প্রিয় রং-তুলি। ক্যানভাসের বুকে ছড়িয়ে দিতে থাকেন তাঁর সকল দুশ্চিন্তা, সকল ভাবনা, সকল কষ্ট, সকল পর্যবেক্ষণ। রং-তুলি-ক্যানভাসের সাথে চলে শিল্পকর্ম সৃষ্টির অসাধারণ এক খেলা। তুলির আঁচড়ে একের পর এক রচনা করতে থাকেন ব্যতিক্রম সব চিত্রকর্ম। লক ডাউনের দু’মাসে তাঁর আঁকা শিল্পকর্মগুলো নিয়ে ১৫ থেকে ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত অনলাইন প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত হয় ‘বৈশি^ক দুর্যোগের গতি প্রকৃতি : পেন্ডামিক মুড’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনী। স্বনামখ্যাত চিত্রশিল্পী অধ্যাপক রফিকুন্নবী ব্যতিক্রমধর্মী এই শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর শুভ উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের প্রথম ভার্চুয়াল থ্রিডি পদ্ধতির মাধ্যমে চিত্রকলা গ্যালারির আয়োজনে তাঁর এই একক প্রদর্শনীতে বিক্রয়লব্ধ চিত্রকর্মগুলোর অর্ধেক অর্থ তুলে দেন করোনা ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী ও দুঃস্থজনের সহযোগিতায়।
আকস্মিকভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ৩০ মে না ফেরার দেশে চলে যান শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইমামুল কবীর শান্ত। ব্যথিত শিল্পী প্রয়াত বন্ধুপ্রতিম বড়ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রদর্শনীটি তাঁরই নামে উৎসর্গ করেন। শান্ত-মারিয়াম বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের মহাপ্রয়াণে এবং তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী ১৮ জুন ২০২০-এ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যবৃন্দ কর্তৃক শিল্পী মোস্তাফিজুল হক নির্বাচিত হন নতুন চেয়ারম্যান। মানবোচিত গুণাবলিসম্পন্ন হবার প্রচেষ্টায় যিনি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন সফলতো তিনি হবেনই। হয়তো সে কারণেই গ্রামের ডানপিটে ছেলেটি সময়ের পরিক্রমায় হয়ে উঠেন শিল্পী অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক।
তথ্যসূত্র :

 Mostafi“ul Haque, Nwe Chairman of SMUCT, The Daily Observer, 03-07-2020, Friday, Page-3
 শিল্পী অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক, প্রথম আলো, ০৫-০৭-২০২০, রোববার, পৃষ্ঠা-১০
 শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের একক চতুর্থ শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ক্যাটালগ, ক্রিয়েটিভ ডেসটিনেশন, জসীমউদ্দিন, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
ব্যক্তিগত আলাপচারিতা

 শিল্পী মাহমুদুল হক, অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ছাপচিত্র বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এবং প্রাক্তন মহাপরিচালক, জাতীয় জাদুঘর, শাহবাগ, ঢাকা
 শিল্পী মোস্তাফিজুল হক, অধ্যাপক, অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
 শিল্পী দেওয়ান মিজান, সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
 সাদাত ইবনে মাহমুদ, হেড অব মার্কেটিং, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
 শিল্পী মোঃ রেজওয়ানুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০
 শিল্পী মোঃ মেহেদী মাসুদ, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, মৃৎশিল্প বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এবং সিনিয়র ডিজাইনার, ক্রিয়েটিভ দ্য আর্ট গ্যালারি, ৪৫ সোনারগাঁও জনপথ রোড, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও গবেষক