ঢাকা ১১:৫৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫

শিল্প কারখানায় গ্যাস রেশনিং পেশাদারি সিদ্ধান্ত নয়

  • আপডেট সময় : ১১:২১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ এপ্রিল ২০২২
  • ১০৩ বার পড়া হয়েছে

সালেক সুফী : নিজেদের ব্যর্থতার জন্য সৃষ্ট গ্যাস সংকটে বেসামাল হয়ে পড়েছে পেট্রোবাংলা, জ্বালানি বিভাগ। রমজান মাসের শুরুতেই বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রের উৎপাদন বিভ্রাটের জন্য দেশব্যাপী গ্যাস গ্রাহকদের ব্যাপক হয়রানির পর দিশেহারা পেট্রোবাংলা। ১২ এপ্রিল পেট্রোবাংলা গ্যাস বিতরণ অঞ্চলে সব শিল্প গ্রাহকদের জন্য বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত গ্যাস রেশনিং চালু করেছে। এমনিতে শুরু থেকেই বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সিএনজি পাম্পগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় ট্রান্সপোর্ট সেক্টর সঙ্কট চলছে। এখন শিল্প কারখানাগুলোতে ঢালাওভাবে গ্যাস ব্যবহার সংকুচিত করায় ব্যাপক প্রভাব এবং সঙ্কট আরো বাড়বে বলে আমি মনে করি।
প্রশ্ন হলো, কেন এই গ্যাস সঙ্কট? যারা জানেন তারা বলবেন- ২০০০ থেকে এখন পর্যন্ত গ্যাস অনুসন্ধান এবং উন্নয়নে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেই। পেট্রোবাংলা এবং কোম্পানিসমূহ আমলাতন্ত্রের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে কাজের দক্ষতা হারিয়েছে। জাতীয় অনুসন্ধান এবং উন্নয়ন কোম্পানি বাপেক্সকে হাত-পা বেঁধে সাগরে সাঁতার কাটার চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছে। অথচ গ্যাসের সুলভ মূল্য এবং সহজলভ্যতার জন্য অসংখ্য অদক্ষ জ্বালানি ব্যবহারকারী শিল্প গ্রাহক দেশে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে।
২০০০ থেকেই গ্যাসের চাহিদা এবং সরবরাহে ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এই সেক্টরে কিছু মেধাবী সাহসী কারিগরি কর্মকর্তা থাকায় ২০০৫ পর্যন্ত কোনোভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেছে। যদিও বিভিন্ন সময়ে নানা পরিস্থিতির কারণে অনেক মেধাবী পেশাদার গ্যাস সেক্টর ছেড়ে বিদেশে চলে গেছেন। সেই শূন্যস্থান পূরণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাধারণ জনবলকেও কারিগরি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে ২০০০ সালের পর থেকেই দেশে কোনো বড় গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ক্রমাগত গ্যাস সঙ্কট ঘনীভূত হয়ে এখন চরম আকার ধারণ করেছে। আমলা নির্ভর প্রেট্রোবাংলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো আদৌ যোগ্যতা রাখে কিনা- সেই প্রশ্ন উঠেছে বেশ জোরেসোরে।
বিভিন্ন সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভোলা গ্যাস ক্ষেত্রসমূহের গ্যাস জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সংযুক্ত না করে, ২০০৫ সালে মায়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত তিন জাতি গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণ প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ গ্রহণ করেননি কর্তারা। উপরন্তু নাইকো নামের একটি অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে ফেনী এবং ছাতক (টেংরাটিলাসহ) গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়নের নামে ধ্বংস করার সুযোগ দিয়ে গ্যাস সেক্টরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ২০১০ থেকেই সাগরের গ্যাস সম্পদ সম্পর্কে আমরা সিদ্ধান্তহীন। সাগর সীমার বিরোধ মিটে যাবার পর প্রতিবেশী মায়ানমার এবং ভারত এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ হাত গুটিয়ে রয়েছে। জ্বালানি কয়লা উত্তোলনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না-নেওয়ার কথা নাইবা বললাম।
উপরে বর্ণিত সকল কিছুর সম্মিলিত যোগফল দেশের প্রমাণিত গ্যাস সম্পদ দ্রুত নিঃশেষ হবার পথে। দেশজুড়ে ৪০০০ এমএমসিএফডি গ্যাস চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ সরবরাহ হয়েছে ৮৯২ মিলিয়ন ঘনফুট আর এলেঙ্গিসহ ৩১৫৭ মিলিয়ন ঘনফুট। শেভ্রন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকেই মোট সরবরাহের ৪৩ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে। দুটি বৃহৎ গ্যাস ক্ষেত্র বিবিয়ানা এবং তিতাস উৎপাদন ব্যবস্থা এখন ঝুঁকিপূর্ণ। গ্যাস কূপগুলোর ওয়েল হেড প্রেসার কমছে দ্রুত, পানি উৎপাদন বাড়ছে। বিবিয়ানার একটি কূপে বালু উঠছে।
শিল্প কারখানায় গ্যাস সরবরাহ রেশনিং কেন সুবিবেচনা প্রসূত নয়, সেই প্রসঙ্গে আসি। দেশের অনেক প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জ্বালানি, বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এগুলোতে চার ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ কারিগরি কারণেই অবাস্তব। যেসব শিল্প বয়লার চালুর জন্য গ্যাস ব্যবহার করে সেগুলো চার ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হলে বয়লার চালু এবং বন্ধ করার সংকটে পড়বে। অনেক শিল্প কারখানা যেগুলো পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে চুক্তিবদ্ধ সেগুলো সময় মতো রপ্তানি করতে পারবে না। গ্যাস সরবরাহ ঢালাওভাবে সংকুচিত করার সিদ্ধান্ত আদৌ বাস্তবসম্মত হয়নি।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

শিল্প কারখানায় গ্যাস রেশনিং পেশাদারি সিদ্ধান্ত নয়

আপডেট সময় : ১১:২১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ এপ্রিল ২০২২

সালেক সুফী : নিজেদের ব্যর্থতার জন্য সৃষ্ট গ্যাস সংকটে বেসামাল হয়ে পড়েছে পেট্রোবাংলা, জ্বালানি বিভাগ। রমজান মাসের শুরুতেই বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রের উৎপাদন বিভ্রাটের জন্য দেশব্যাপী গ্যাস গ্রাহকদের ব্যাপক হয়রানির পর দিশেহারা পেট্রোবাংলা। ১২ এপ্রিল পেট্রোবাংলা গ্যাস বিতরণ অঞ্চলে সব শিল্প গ্রাহকদের জন্য বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত গ্যাস রেশনিং চালু করেছে। এমনিতে শুরু থেকেই বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সিএনজি পাম্পগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় ট্রান্সপোর্ট সেক্টর সঙ্কট চলছে। এখন শিল্প কারখানাগুলোতে ঢালাওভাবে গ্যাস ব্যবহার সংকুচিত করায় ব্যাপক প্রভাব এবং সঙ্কট আরো বাড়বে বলে আমি মনে করি।
প্রশ্ন হলো, কেন এই গ্যাস সঙ্কট? যারা জানেন তারা বলবেন- ২০০০ থেকে এখন পর্যন্ত গ্যাস অনুসন্ধান এবং উন্নয়নে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেই। পেট্রোবাংলা এবং কোম্পানিসমূহ আমলাতন্ত্রের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে কাজের দক্ষতা হারিয়েছে। জাতীয় অনুসন্ধান এবং উন্নয়ন কোম্পানি বাপেক্সকে হাত-পা বেঁধে সাগরে সাঁতার কাটার চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছে। অথচ গ্যাসের সুলভ মূল্য এবং সহজলভ্যতার জন্য অসংখ্য অদক্ষ জ্বালানি ব্যবহারকারী শিল্প গ্রাহক দেশে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে।
২০০০ থেকেই গ্যাসের চাহিদা এবং সরবরাহে ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এই সেক্টরে কিছু মেধাবী সাহসী কারিগরি কর্মকর্তা থাকায় ২০০৫ পর্যন্ত কোনোভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেছে। যদিও বিভিন্ন সময়ে নানা পরিস্থিতির কারণে অনেক মেধাবী পেশাদার গ্যাস সেক্টর ছেড়ে বিদেশে চলে গেছেন। সেই শূন্যস্থান পূরণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাধারণ জনবলকেও কারিগরি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে ২০০০ সালের পর থেকেই দেশে কোনো বড় গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ক্রমাগত গ্যাস সঙ্কট ঘনীভূত হয়ে এখন চরম আকার ধারণ করেছে। আমলা নির্ভর প্রেট্রোবাংলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো আদৌ যোগ্যতা রাখে কিনা- সেই প্রশ্ন উঠেছে বেশ জোরেসোরে।
বিভিন্ন সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভোলা গ্যাস ক্ষেত্রসমূহের গ্যাস জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সংযুক্ত না করে, ২০০৫ সালে মায়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত তিন জাতি গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণ প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ গ্রহণ করেননি কর্তারা। উপরন্তু নাইকো নামের একটি অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে ফেনী এবং ছাতক (টেংরাটিলাসহ) গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়নের নামে ধ্বংস করার সুযোগ দিয়ে গ্যাস সেক্টরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ২০১০ থেকেই সাগরের গ্যাস সম্পদ সম্পর্কে আমরা সিদ্ধান্তহীন। সাগর সীমার বিরোধ মিটে যাবার পর প্রতিবেশী মায়ানমার এবং ভারত এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ হাত গুটিয়ে রয়েছে। জ্বালানি কয়লা উত্তোলনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না-নেওয়ার কথা নাইবা বললাম।
উপরে বর্ণিত সকল কিছুর সম্মিলিত যোগফল দেশের প্রমাণিত গ্যাস সম্পদ দ্রুত নিঃশেষ হবার পথে। দেশজুড়ে ৪০০০ এমএমসিএফডি গ্যাস চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ সরবরাহ হয়েছে ৮৯২ মিলিয়ন ঘনফুট আর এলেঙ্গিসহ ৩১৫৭ মিলিয়ন ঘনফুট। শেভ্রন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকেই মোট সরবরাহের ৪৩ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে। দুটি বৃহৎ গ্যাস ক্ষেত্র বিবিয়ানা এবং তিতাস উৎপাদন ব্যবস্থা এখন ঝুঁকিপূর্ণ। গ্যাস কূপগুলোর ওয়েল হেড প্রেসার কমছে দ্রুত, পানি উৎপাদন বাড়ছে। বিবিয়ানার একটি কূপে বালু উঠছে।
শিল্প কারখানায় গ্যাস সরবরাহ রেশনিং কেন সুবিবেচনা প্রসূত নয়, সেই প্রসঙ্গে আসি। দেশের অনেক প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জ্বালানি, বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এগুলোতে চার ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ কারিগরি কারণেই অবাস্তব। যেসব শিল্প বয়লার চালুর জন্য গ্যাস ব্যবহার করে সেগুলো চার ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হলে বয়লার চালু এবং বন্ধ করার সংকটে পড়বে। অনেক শিল্প কারখানা যেগুলো পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে চুক্তিবদ্ধ সেগুলো সময় মতো রপ্তানি করতে পারবে না। গ্যাস সরবরাহ ঢালাওভাবে সংকুচিত করার সিদ্ধান্ত আদৌ বাস্তবসম্মত হয়নি।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ