ঢাকা ১১:৩৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থা আমাদের পঙ্গু করে রেখেছে

  • আপডেট সময় : ০৯:৪৮:২২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২
  • ১২১ বার পড়া হয়েছে

সানাউল হক সানী : আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করে। ঠিক বন্ধু বলা যাবে না, ক্যাম্পাসে হাই-হ্যালো সম্পর্ক ছিল। আমি ক্যারিয়ারে ওর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছি, এজন্য আপনি সম্বোধন করে বিষয়টি এমন না। আসলে ছেলেটি হীনম্মন্যতায় ভুগছে। বেশ কয়েকবার বলেছি আমি লজ্জিত হই। ও যখন কথা বলে, মুখের দিকে তাকাতে পারি না।
একসময় ক্যাম্পাসের খুব পরিচিত মুখ ছিল। কিন্তু জীবন-জীবিকার এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ ছেলেটি। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা, তিন বেলা দুমুঠো খাবার জোগাতে গলদঘর্ম অবস্থা। দ্বারে দ্বারে ঘুরছে একটা চাকরির জন্য। কিন্তু বাস্তব জীবন অনেক কঠিন, যুদ্ধে না নামলে মাঠের চিত্র কল্পনাও করা যায় না।
দিন ১৫ আগে এক বড় ভাই এসেছিলেন। আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র। সরকারি চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু ব্যর্থ। এখন বয়স শেষ। দুমুঠো খাবার জোগাড় হয় এমন একটা চাকরি হলেই হবে। নিরস মুখ, যেন গলায় এসে কথা আটকে থাকে। প্রাণ প্রাচুর্যের সেই ভাইটিকে দেখলে মায়া হয়।
এক বন্ধু এসেছিল কিছুদিন আগে যেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেই। হাজার পনেরো টাকা বেতন হলেই হবে। বিয়ে করেছেন, লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে খুব সিগারেট খেতেন। অভ্যাসবশত তাই তাকে অফার করেছিলাম একটা সিগারেট। কিন্তু সিগারেটটা নেয়নি। বললেন জীবন যেখানে টিকিয়ে রাখা দায়, সেখানে ১৬ টাকার বিলাসিতা বেমানান।
আরো দুইটা ভাই গত কয়েক মাস ধরে খুব করে বলছেন কোনো মিডিয়ায় যেন একটু চাকরির ব্যবস্থা করে দেই। অন্তত একটা পরিচয় হোক। আপাতত সচ্ছলতা না হোক, জীবনটা টিকে থাকুক। ৫-৬ দিন আগে ঈদের ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে ঢাকা এসেছি। ইলিশ পরিবহন থেকে যাত্রাবাড়ী মাত্র নামলাম। হঠাৎ দেখি একটা পরিচিত মুখ বাসে ডেকে ডেকে যাত্রী তুলছেন। ছেলেটি মিরপুরের একটি কলেজে মাস্টার্সে পড়ে। আমাদের এলাকায় বাড়ি। বাসের সুপারভাইজার। খুব আক্ষেপ লেগেছিল। কিন্তু এরপরে অবাকও হই। আসলে বাসটি ওর নিজেরই। বিভিন্ন কাজকর্ম করে টাকা জমিয়ে, ধারদেনা করে বাসটি নিজেই কিনেছেন। এখন দায়িত্ব পালন করছেন সুপারভাইজারের। ঋণের টাকা প্রায় শোধ। লক্ষ্য এখন আরেকটি বাস নামানো।
হিসাব করে দেখলাম, ছেলেটির যখন সরকারি চাকরির বয়স শেষ হবে। তখন ও অন্তত চার পাঁচটি বাসের মালিক হবে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত পরিবহন ব্যবসায়ী।
শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থা আমাদের পঙ্গু করে রেখেছে। পাশাপাশি সমান দায়ী ছাত্র রাজনীতি নামের মুলা। সরকারি চাকরি না পেলে হীনম্মন্যতায় বুক উঁচু করে কথা বলতে পারি না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে কোনো বিজনেস আইডিয়া নিয়ে কাজ করলে দারুণ হতো। চাকরির বয়স শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হওয়া সম্ভব। এজন্য পুরো দেশের আমূল পরিবর্তনের দরকার নেই। শুধুমাত্র উদ্যোক্তাদের একটু নিরাপত্তা দরকার। করোনা লাখ লাখ শিক্ষার্থীর চাকরির বয়স খেয়ে দিয়েছে। আশাভঙ্গ করেছে অযুত তারুণ্যের। কিন্তু এই মানুষগুলোকে নিয়ে কেউ ভাবছে না। অথচ সরকারের ফার্স্ট প্রায়োরিটিতে থাকার কথা ছিল এদের।
লেখক : সাংবাদিক

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থা আমাদের পঙ্গু করে রেখেছে

আপডেট সময় : ০৯:৪৮:২২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২

সানাউল হক সানী : আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করে। ঠিক বন্ধু বলা যাবে না, ক্যাম্পাসে হাই-হ্যালো সম্পর্ক ছিল। আমি ক্যারিয়ারে ওর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছি, এজন্য আপনি সম্বোধন করে বিষয়টি এমন না। আসলে ছেলেটি হীনম্মন্যতায় ভুগছে। বেশ কয়েকবার বলেছি আমি লজ্জিত হই। ও যখন কথা বলে, মুখের দিকে তাকাতে পারি না।
একসময় ক্যাম্পাসের খুব পরিচিত মুখ ছিল। কিন্তু জীবন-জীবিকার এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ ছেলেটি। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা, তিন বেলা দুমুঠো খাবার জোগাতে গলদঘর্ম অবস্থা। দ্বারে দ্বারে ঘুরছে একটা চাকরির জন্য। কিন্তু বাস্তব জীবন অনেক কঠিন, যুদ্ধে না নামলে মাঠের চিত্র কল্পনাও করা যায় না।
দিন ১৫ আগে এক বড় ভাই এসেছিলেন। আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র। সরকারি চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু ব্যর্থ। এখন বয়স শেষ। দুমুঠো খাবার জোগাড় হয় এমন একটা চাকরি হলেই হবে। নিরস মুখ, যেন গলায় এসে কথা আটকে থাকে। প্রাণ প্রাচুর্যের সেই ভাইটিকে দেখলে মায়া হয়।
এক বন্ধু এসেছিল কিছুদিন আগে যেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেই। হাজার পনেরো টাকা বেতন হলেই হবে। বিয়ে করেছেন, লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে খুব সিগারেট খেতেন। অভ্যাসবশত তাই তাকে অফার করেছিলাম একটা সিগারেট। কিন্তু সিগারেটটা নেয়নি। বললেন জীবন যেখানে টিকিয়ে রাখা দায়, সেখানে ১৬ টাকার বিলাসিতা বেমানান।
আরো দুইটা ভাই গত কয়েক মাস ধরে খুব করে বলছেন কোনো মিডিয়ায় যেন একটু চাকরির ব্যবস্থা করে দেই। অন্তত একটা পরিচয় হোক। আপাতত সচ্ছলতা না হোক, জীবনটা টিকে থাকুক। ৫-৬ দিন আগে ঈদের ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে ঢাকা এসেছি। ইলিশ পরিবহন থেকে যাত্রাবাড়ী মাত্র নামলাম। হঠাৎ দেখি একটা পরিচিত মুখ বাসে ডেকে ডেকে যাত্রী তুলছেন। ছেলেটি মিরপুরের একটি কলেজে মাস্টার্সে পড়ে। আমাদের এলাকায় বাড়ি। বাসের সুপারভাইজার। খুব আক্ষেপ লেগেছিল। কিন্তু এরপরে অবাকও হই। আসলে বাসটি ওর নিজেরই। বিভিন্ন কাজকর্ম করে টাকা জমিয়ে, ধারদেনা করে বাসটি নিজেই কিনেছেন। এখন দায়িত্ব পালন করছেন সুপারভাইজারের। ঋণের টাকা প্রায় শোধ। লক্ষ্য এখন আরেকটি বাস নামানো।
হিসাব করে দেখলাম, ছেলেটির যখন সরকারি চাকরির বয়স শেষ হবে। তখন ও অন্তত চার পাঁচটি বাসের মালিক হবে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত পরিবহন ব্যবসায়ী।
শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থা আমাদের পঙ্গু করে রেখেছে। পাশাপাশি সমান দায়ী ছাত্র রাজনীতি নামের মুলা। সরকারি চাকরি না পেলে হীনম্মন্যতায় বুক উঁচু করে কথা বলতে পারি না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে কোনো বিজনেস আইডিয়া নিয়ে কাজ করলে দারুণ হতো। চাকরির বয়স শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হওয়া সম্ভব। এজন্য পুরো দেশের আমূল পরিবর্তনের দরকার নেই। শুধুমাত্র উদ্যোক্তাদের একটু নিরাপত্তা দরকার। করোনা লাখ লাখ শিক্ষার্থীর চাকরির বয়স খেয়ে দিয়েছে। আশাভঙ্গ করেছে অযুত তারুণ্যের। কিন্তু এই মানুষগুলোকে নিয়ে কেউ ভাবছে না। অথচ সরকারের ফার্স্ট প্রায়োরিটিতে থাকার কথা ছিল এদের।
লেখক : সাংবাদিক