ঢাকা ১২:১৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫

শিক্ষার মানোন্নয়ন কি সম্ভব?

  • আপডেট সময় : ০৯:৩২:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
  • ৭৪ বার পড়া হয়েছে

ড. কামরুল হাসান মামুন : সত্যিকারের আদর্শিক মানুষদের শূন্যতা এখন প্রবল। এখন যারা মডেল তারা কি আসলেই আদর্শিক মানুষ? নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন কাদের মডেল ভাবছে? এইভাবে প্রিয় দেশটা আজ দুঃসহ সময় পার করছে। এই পথকে আরও পিচ্ছিল করার জন্য সরকার নতুন একটা শিক্ষাক্রম তৈরি করেছে যার মাধ্যমে উদাহরণ হওয়ার মতো বড় মানুষ তৈরির পথ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ষাট বা আশির দশকেও অনেক বড় আলোকিত মানুষ ছিল। বড় কবি ছিলেন, বড় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, নাট্যকার, শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক ছিলেন। যেমন ৬০ ও ৭০ দশকের বাংলাদেশের কবি লেখক কারা ছিলেন—শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আহমদ শরীফ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হেলাল হাফিজ, জিয়া হায়দার, দাউদ হায়দার, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, হাসান হাফিজুর রহমান, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আহমদ ছফা, আলমগীর কবির, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, আলতাফ মাহমুদ, ফজলে লোহানী এইরকম আরও অনেক নাম নেওয়া যাবে।
সবার নাম এই মুহূর্তে মনেও আসছে না। ফজলে লোহানী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, নিলুফার ইয়াসমিন, আজম খানের মতো গায়ক, জুয়েল আইচের মতো জাদুশিল্পী, আবু হেনা মোস্তফা কামালের মতো গীতিকার কি আমরা তৈরি করতে পারছি? শুধু জাতীয় পর্যায় না। আমাদের গ্রাম পর্যায়েও উদাহরণ দেওয়ার মতো শিক্ষক ছিলেন, রাজনীতিবিদ ছিলেন, ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন চোখ খুললেই স্মার্ট ধান্দাবাজ দেখি, স্মার্ট দুর্নীতিবাজ দেখি, স্মার্ট ঋণখেলাপি, স্মার্ট আমলা দেখি। ভালো মানুষ কীভাবে তৈরি করতে পারবো? যারা কবি, সাহিত্যিক, লেখক, অভিনেতা, শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক হতে পারতো তাদের বিরাট অংশ পড়ে ইংরেজি মাধ্যমে। যারা বাংলাভাষা ঠিক মতো পড়েনি, বাংলা সাহিত্য পড়েনি, বাংলা গান শোনেনি তারা লেখক হবে কীভাবে? এই যে এত শত শত ছেলেমেয়েরা বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে তাদের সরকারি চাকরিতে কীভাবে নেওয়া যায় সেই চিন্তা কি কেউ করেছে? আপন ভাষায় না পড়লে জানা, শেখা ও বোঝা হয় ভাসা ভাসা। এরা ভালো হতে পারতো ছেলেমেয়েদের নির্দিষ্ট অংশ বড় হয় বিদেশে চলে যাবে স্বপ্ন নিয়ে। তাদের স্বপ্নগুলো খুব ছোট। বিদেশে গিয়ে একটু পড়াশোনা করে একটা ছোটখাটো চাকরি পেলেই নিজে এবং তাদের বাবা-মায়েরা সফল মনে করে।
অথচ আমরা যদি বাংলা মাধ্যমকে উন্নত করতে পারতাম এবং ওরা যদি বাংলা মাধ্যমে পড়তো তাদের একটা বড় অংশই লেখক, শিক্ষক, গবেষক হতো। এই ইংরেজি মাধ্যম দিয়ে আমরা কী পাচ্ছি তার কি কোনো গবেষণা আছে? কেউ কি ভাবছে? ৪০ বছরের ইংরেজি মাধ্যম দিয়ে দেশ কী পেল আর কী হারালো? যারা গেল তারা ফিরে আসলেও তাদের কি যথোপযুক্ত চাকরির জায়গা দেওয়ার ব্যবস্থা? এই যে এত শত শত ছেলেমেয়েরা বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে তাদের সরকারি চাকরিতে কীভাবে নেওয়া যায় সেই চিন্তা কি কেউ করেছে? বাংলা মাধ্যমের স্কুল ও কারিকুলামকে নষ্ট করে আমাদের নষ্ট হওয়ার পথ আরও পিচ্ছিল করে দ্রুত সেই পথে নামার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এখন আর কেউ বড় হয় না। যারা বিসিএস পরীক্ষায় বসে তাদের স্বপ্ন থাকে প্রশাসন, রাজস্ব, পররাষ্ট্র বা পুলিশ ক্যাডার হওয়ার। কিংবা শিক্ষা ক্যাডার ছাড়া অন্য যেকোনো ক্যাডার। কেউ শিক্ষা ক্যাডার পেলে তত খুশি হয় না। মন্দের ভালো ভেবে হয়। হলে তাদের কেউ অভিনন্দনের বন্যায় ভাসায় না।
এমনকি শিক্ষা ক্যাডার পাওয়া ব্যক্তিও পরের বছর আবার পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। আশায় থাকে অন্য কোনো ক্যাডারে যাওয়ার। এর কারণ হলো, অন্যান্য ক্যাডারে ক্ষমতা আছে। শিক্ষকের কোনো ক্ষমতা নেই। সরকার নিজের স্বার্থে শিক্ষকতা ও অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক সম্মানের দিক থেকে অনেক বেশি বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে। শিক্ষক জ্ঞানের ধারা সচল রেখে সমাজকে অজ্ঞানতার আবর্জনা থেকে মুক্ত রাখে। মুখে সবাই বলে, শিক্ষাই জাতির মেরুদ-, শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু জাতীয় বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ দেখুন! পৃথিবীর যেসব দেশ শিক্ষায় সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয় বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর তলানিতে। যতটুকু দেয় তাতেও আছে ছলচাতুরী। প্রযুক্তির বরাদ্দকেও শিক্ষার সাথে যুক্ত করে দেয়। শিক্ষায় এত কম বরাদ্দ দিলে সঙ্গত কারণেই শিক্ষকদের বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা কম দিতে হবে এবং করাও হয় তাই। তার উপর দেখা যায় একজন প্রশাসন ক্যাডার শিক্ষকের ওপর ছড়ি ঘোরায়। দুইদিন পরপর কী করা যাবে আর কী করা যাবে না তা নিয়ে প্রজ্ঞাপন পাঠায়।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

শিক্ষার মানোন্নয়ন কি সম্ভব?

আপডেট সময় : ০৯:৩২:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

ড. কামরুল হাসান মামুন : সত্যিকারের আদর্শিক মানুষদের শূন্যতা এখন প্রবল। এখন যারা মডেল তারা কি আসলেই আদর্শিক মানুষ? নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন কাদের মডেল ভাবছে? এইভাবে প্রিয় দেশটা আজ দুঃসহ সময় পার করছে। এই পথকে আরও পিচ্ছিল করার জন্য সরকার নতুন একটা শিক্ষাক্রম তৈরি করেছে যার মাধ্যমে উদাহরণ হওয়ার মতো বড় মানুষ তৈরির পথ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ষাট বা আশির দশকেও অনেক বড় আলোকিত মানুষ ছিল। বড় কবি ছিলেন, বড় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, নাট্যকার, শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক ছিলেন। যেমন ৬০ ও ৭০ দশকের বাংলাদেশের কবি লেখক কারা ছিলেন—শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আহমদ শরীফ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হেলাল হাফিজ, জিয়া হায়দার, দাউদ হায়দার, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, হাসান হাফিজুর রহমান, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আহমদ ছফা, আলমগীর কবির, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, আলতাফ মাহমুদ, ফজলে লোহানী এইরকম আরও অনেক নাম নেওয়া যাবে।
সবার নাম এই মুহূর্তে মনেও আসছে না। ফজলে লোহানী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, নিলুফার ইয়াসমিন, আজম খানের মতো গায়ক, জুয়েল আইচের মতো জাদুশিল্পী, আবু হেনা মোস্তফা কামালের মতো গীতিকার কি আমরা তৈরি করতে পারছি? শুধু জাতীয় পর্যায় না। আমাদের গ্রাম পর্যায়েও উদাহরণ দেওয়ার মতো শিক্ষক ছিলেন, রাজনীতিবিদ ছিলেন, ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন চোখ খুললেই স্মার্ট ধান্দাবাজ দেখি, স্মার্ট দুর্নীতিবাজ দেখি, স্মার্ট ঋণখেলাপি, স্মার্ট আমলা দেখি। ভালো মানুষ কীভাবে তৈরি করতে পারবো? যারা কবি, সাহিত্যিক, লেখক, অভিনেতা, শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক হতে পারতো তাদের বিরাট অংশ পড়ে ইংরেজি মাধ্যমে। যারা বাংলাভাষা ঠিক মতো পড়েনি, বাংলা সাহিত্য পড়েনি, বাংলা গান শোনেনি তারা লেখক হবে কীভাবে? এই যে এত শত শত ছেলেমেয়েরা বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে তাদের সরকারি চাকরিতে কীভাবে নেওয়া যায় সেই চিন্তা কি কেউ করেছে? আপন ভাষায় না পড়লে জানা, শেখা ও বোঝা হয় ভাসা ভাসা। এরা ভালো হতে পারতো ছেলেমেয়েদের নির্দিষ্ট অংশ বড় হয় বিদেশে চলে যাবে স্বপ্ন নিয়ে। তাদের স্বপ্নগুলো খুব ছোট। বিদেশে গিয়ে একটু পড়াশোনা করে একটা ছোটখাটো চাকরি পেলেই নিজে এবং তাদের বাবা-মায়েরা সফল মনে করে।
অথচ আমরা যদি বাংলা মাধ্যমকে উন্নত করতে পারতাম এবং ওরা যদি বাংলা মাধ্যমে পড়তো তাদের একটা বড় অংশই লেখক, শিক্ষক, গবেষক হতো। এই ইংরেজি মাধ্যম দিয়ে আমরা কী পাচ্ছি তার কি কোনো গবেষণা আছে? কেউ কি ভাবছে? ৪০ বছরের ইংরেজি মাধ্যম দিয়ে দেশ কী পেল আর কী হারালো? যারা গেল তারা ফিরে আসলেও তাদের কি যথোপযুক্ত চাকরির জায়গা দেওয়ার ব্যবস্থা? এই যে এত শত শত ছেলেমেয়েরা বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে তাদের সরকারি চাকরিতে কীভাবে নেওয়া যায় সেই চিন্তা কি কেউ করেছে? বাংলা মাধ্যমের স্কুল ও কারিকুলামকে নষ্ট করে আমাদের নষ্ট হওয়ার পথ আরও পিচ্ছিল করে দ্রুত সেই পথে নামার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এখন আর কেউ বড় হয় না। যারা বিসিএস পরীক্ষায় বসে তাদের স্বপ্ন থাকে প্রশাসন, রাজস্ব, পররাষ্ট্র বা পুলিশ ক্যাডার হওয়ার। কিংবা শিক্ষা ক্যাডার ছাড়া অন্য যেকোনো ক্যাডার। কেউ শিক্ষা ক্যাডার পেলে তত খুশি হয় না। মন্দের ভালো ভেবে হয়। হলে তাদের কেউ অভিনন্দনের বন্যায় ভাসায় না।
এমনকি শিক্ষা ক্যাডার পাওয়া ব্যক্তিও পরের বছর আবার পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। আশায় থাকে অন্য কোনো ক্যাডারে যাওয়ার। এর কারণ হলো, অন্যান্য ক্যাডারে ক্ষমতা আছে। শিক্ষকের কোনো ক্ষমতা নেই। সরকার নিজের স্বার্থে শিক্ষকতা ও অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক সম্মানের দিক থেকে অনেক বেশি বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে। শিক্ষক জ্ঞানের ধারা সচল রেখে সমাজকে অজ্ঞানতার আবর্জনা থেকে মুক্ত রাখে। মুখে সবাই বলে, শিক্ষাই জাতির মেরুদ-, শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু জাতীয় বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ দেখুন! পৃথিবীর যেসব দেশ শিক্ষায় সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয় বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর তলানিতে। যতটুকু দেয় তাতেও আছে ছলচাতুরী। প্রযুক্তির বরাদ্দকেও শিক্ষার সাথে যুক্ত করে দেয়। শিক্ষায় এত কম বরাদ্দ দিলে সঙ্গত কারণেই শিক্ষকদের বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা কম দিতে হবে এবং করাও হয় তাই। তার উপর দেখা যায় একজন প্রশাসন ক্যাডার শিক্ষকের ওপর ছড়ি ঘোরায়। দুইদিন পরপর কী করা যাবে আর কী করা যাবে না তা নিয়ে প্রজ্ঞাপন পাঠায়।