- ইয়াহিয়া নয়ন
দেশের তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৬১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর গণিতের দক্ষতায় দুর্বল। তাদের গণিতের দক্ষতা তৃতীয় শ্রেণির উপযোগী নয়। তৃতীয় শ্রেণির ৫১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায়ও দুর্বল। তাদের মানও তৃতীয় শ্রেণির উপযোগী নয়। অনেক ক্ষেত্রে একটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি থাকে যে একজন শিক্ষক আলাদাভাবে সব শিক্ষার্থীর প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন না। তাই, দুর্বল শিক্ষার্থীরা কোনো বাড়তি যত্ন পায় না।
এমন তথ্য উঠে এসেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে চালানো এক জরিপে। ‘জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন-২০২২ এর জাতীয় প্রচারণা কৌশল’ শীর্ষক কর্মশালায় জরিপের ভয়াবহ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অটোপাস এবং সংক্ষিপ্ত সিলেবাস চালু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ লাখ শিক্ষার্থী অটোপাস বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অটোপাস কোনো সমাধান নয়। বরং এতে দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার্থী ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চশিক্ষা, চাকরির বাজারে অটোপাসের পরিপ্রেক্ষিতে নানান বেগ পোহানোসহ সামাজিকভাবে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দুঃখজনকভাবে সে আশঙ্কার কিছুটা বর্তমানে পরিলক্ষিতও হচ্ছে।
এমন ঘটনা কোভিডের সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা না দিয়ে পাস করা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। সে সময় এসএসসি, জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের গড় মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছিল। বর্তমানে তাদের অটোপাস জেনারেশন নামে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। তাছাড়া যারা পরিশ্রমী শিক্ষার্থী তাদের ওপর এটি এক ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণও বটে। অটোপাস পদ্ধতিতে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন সম্ভব নয়।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষকরা বলছেন, সীমিত সিলেবাসে পরীক্ষা বা অটোপাসের কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মৌলিক জ্ঞানের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের অনেক বিষয় বুঝতে অসুবিধা হয়, যেগুলো তাদের মাধ্যমিকে শিখে আসার কথা, ফলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পড়াতে গিয়ে তাদের পুরোনো শ্রেণির বিষয়ও নতুন করে বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে। আবার অনেকেই স্নাতকে ফেল করছেন। আবার পূর্ণাঙ্গ পাঠ্যক্রমে পরীক্ষা দিয়ে আসা ব্যাচগুলোর তুলনায় এসব শিক্ষার্থীর ফলাফলও তুলনামূলক খারাপ। অর্থাৎ এ ব্যবস্থার কারণে শিক্ষার মান আরো নিম্নমুখী হয়েছে।
অন্যদিকে এসব শিক্ষার্থীর পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি তৈরির পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ শিক্ষার ভিত মজবুত না হলে মানবসম্পদ গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। একটি দেশের উন্নয়নে যে কর্মক্ষম, চিন্তাশীল ও আত্মবিশ্বাসী নাগরিক প্রয়োজন, তার ভিত্তি গড়ে ওঠে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা থেকে। কিন্তু এ স্তরেই যদি দায়সারা মূল্যায়নের প্রবণতা চলে আসে বা অটোপাস দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে স্নাতক পাসদের কর্মদক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দেশের অগ্রগতিও ব্যাহত হবে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ আবশ্যক। আর উত্তরণের উপায় হলো শিক্ষাঙ্গনে পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে পরীক্ষার রীতি ফিরিয়ে আনা। কোনো পরিস্থিতিতেই অটোপাস বা সীমিত সিলেবাসের পথে হাঁটা যাবে না। তাছাড়া একবার বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এ ব্যবস্থা নেওয়া হলে তার জেরে গত বছরের এইচএসসির স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ে আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীদের একাংশ। এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী ছিল সাড়ে ১৪ লাখের মতো। তাদের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে দফায় দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে ওই সরকার পতন-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন এলাকার থানায় হামলা হয়। সেসব থানায় প্রশ্নপত্রের ট্রাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে শিক্ষা বোর্ড জানায়, ১১ আগস্টের পরিবর্তে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে। কিন্তু পরবর্তীসময়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করেছে সরকার।
সুতরাং এখনই অটোপাস বা এ ধরনের উদ্যোগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নিলে ভবিষ্যতে এমন আরো আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে। এজন্য নীতিনির্ধারকদেরও আরো সুদূরপ্রসারী চিন্তা করা প্রয়োজন। এক সংকট সমাধান থেকে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে-এমন নীতি প্রণয়ন থেকে সরে আসতে হবে। অন্যদিকে ভবিষ্যতে আবারো বিরূপ পরিস্থিতি হলে অটোপাস বা সিলেবাস সংক্ষেপ করার বাইরে আর কী করা যায়, সে বিষয়েও প্রস্তুতি রাখা উচিত।
এর বাইরে এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাচগুলোর জন্য বিশেষ শিখন কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। বিশেষত মৌলিক শিক্ষার দুর্বলতা কাটানোর দিকে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে সার্বিকভাবে শিক্ষার মানোন্নয়নে মনোযোগ প্রয়োজন। শিক্ষা ব্যবস্থার যে ক্ষত তৈরি হয়েছে অটোপাস ও সিলেবাস সংক্ষেপের কারণে তা একদিনে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তবে পরিস্থিতির উন্নয়নে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে আরো বড় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে সচেতন করা প্রয়োজন। তাদের বোঝা দরকার যে অটোপাস দেওয়া হলে তাদেরই ভুগতে হবে। তাই কষ্ট করে হলেও পরীক্ষা দেওয়া উচিত। তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ যাতে ব্যাহত এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে না পারে সেজন্য পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস সম্পন্ন করা আবশ্যক।
শিক্ষার মান ভালো না হলে দেশের টেকসই অগ্রগতি সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে দেশের শিক্ষা মান প্রশ্নবিদ্ধ। তার ওপর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। কিন্তু প্রত্যাশা ছিল নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর শিক্ষাঙ্গনে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ১০ মাস অতিবাহিত হলেও খুব বেশি স্বাভাবিক হয়ে আসেনি শিক্ষার পরিবেশ। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগও তুলনামূলক কম বলে অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। এমন পরিস্থিতিতে অটোপাসের মতো সিদ্ধান্ত আরো অমনোযোগী করে তুলবে শিক্ষার্থীদের। তাই মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে অটোপাস বা সীমিত সিলেবাসের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে একেবারেই বিরত থাকবে হবে। পাশাপাশি সরকারের পুরো শিক্ষার পরিবেশ ঢেলে সাজানোয় মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধরনের কর্মশালা, সেমিনার কিংবা সিম্পোজিয়াম আয়োজনের মাধ্যমে মানুষের সামনে যথাযথ পদ্ধতি অবলম্বনে বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে হবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে সংকটের নানান প্রকাশ আছে, প্রতিবিধানও আছে এবং সফল প্রতিবিধানের জন্য কয়েকটি বিষয় ও প্রস্তুতি অপরিহার্য। এর একটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকল্প এবং সদিচ্ছা, দ্বিতীয়টি পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও তৃতীয়টি জাতির চিন্তায় শিক্ষাকে সর্বাগ্রে রাখা। মানবসম্পদ উন্নয়ন নিঃসন্দেহে সব ধরনের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। এক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। কারণ শিক্ষাই হলো মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান উপায়। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, উচ্চ হারে মাধ্যমিক শিক্ষা এবং সুনির্বাচিত উচ্চশিক্ষা যে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে সে শিক্ষা আমরা পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে পাই। মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি রাষ্ট্র বস্তুগত অবকাঠামো উন্নয়ন, উপযুক্ত নীতি সমর্থন দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের গতি আরো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য মোটেই উপযোগী নয়, তা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা পেশা পরিবর্তনে সামান্য সহায়তা করলেও মানবসম্পদ উন্নয়নে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এ অবস্থায় যুগোপযোগী মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার উৎকর্ষ অর্জনে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম থেকে শুরু করে পাঠদান ও প্রতিষ্ঠানে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, যা জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মৌলিক উৎকর্ষকে উৎসারিত করবে। এ পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার কীভাবে বাড়ানো যায়, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক