মোহাম্মদ আফজাল হোসেন : কোভিড-১৯ ইস্যু বাংলাদেশে দুইটি জিনিস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্যখাতের জঘন্য অবস্থা এবং শিক্ষাখাত নিয়ে উদাসীনতা। বেহাল স্বাস্থ্যখাত নিয়ে অনেক কথাও হয়েছে। কিন্তু, শিক্ষাখাত নিয়ে এখনো আমরা উদাসীনই রয়ে গিয়েছি।
দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি শিক্ষাদান কার্যক্রম বন্ধের ১৫তম মাস চলছে। মাঝে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি পরীক্ষা নেওয়া শুরু হলেও সেটি চলমান রাখা যায়নি। স্কুল–কলেজসমূহে সীমিত পরিসরে অনলাইন কার্যক্রম দেখা গেলেও, সেটির সার্বিক সফলতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বরং কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই বারবার গিনিপিগ বানানো হয়েছে দেশের শিক্ষা–ব্যবস্থা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। ২০২০ সালের মার্চে দেশ লকডাউনে চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরেই বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে। কোন প্রথাগত প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অনলাইন কার্যক্রমে অংশ নেন। পর্যাপ্ত ডিভাইস, ইন্টারনেট ও অর্থ সংকটের কারণে এ কার্যক্রম প্রথমদিকে অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়। যদিও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ থেকে প্রবল আপত্তি ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বদিচ্ছায় এ কার্যক্রম আলোর মুখ দেখে। একটি সেমিস্টার শেষ হলেও পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছিলনা। পরবর্তীতে বছরের দ্বিতীয় সেমিস্টারের পাঠদানও অনলাইনে শুরু হয়। কিন্তু, পরীক্ষা ছাড়া বেশিদূর আগানো যাচ্ছিল না বিধায় বিভিন্ন উপায়ে মিডটার্ম/টার্মটেস্ট পরীক্ষাগুলো নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে করোনাভাইরাস পরিস্থতি কিছুটা শিথিল হলে হলগুলো বন্ধ রেখে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমাপনী বর্ষের পরীক্ষাগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। হল খুলে পরীক্ষা নেওয়ার মত অবস্থা ও পরিবেশ না থাকলেও এভাবে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তটি পরীক্ষার্থীদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে অসাধ্য ছিল- সেটি মানতেই হবে। আমার প্রতিষ্ঠান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই সুদূর সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট এসে পরীক্ষা দিয়ে আবার ফিরে গিয়েছেন এমন উদাহরণও আছে। কিন্তু, পরে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হল খোলার দাবীতে ছাত্র–আন্দোলনের মুখে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২৪ মে ২০২১ পর্যন্ত পুনরায় বন্ধ ঘোষণা হয়। কয়েকদিন আগে সেই বন্ধের সময়সীমা ২৯ মে পর্যন্ত করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে শিগগিরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কোন উদ্যোগ দেখছি না।
এ লকডাউনে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছিল সর্বস্তরের শিক্ষকদের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারটি। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেভাবে অনলাইনে শিক্ষাদান করছেন তা এককথায় অতুলনীয়। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা কোনদিন স্মার্টফোনও ব্যবহার করেননি, তাদের অনেকেই কোনও ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই অনলাইনে যেভাবে শিক্ষা কার্যক্রমে সামিল হয়েছেন তা গর্ব করার মত। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকলেও, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম খুব বেশি সফল হয়েছে সেকথা বলা যাবেনা। এর সবচেয়ে বড় কারণ নি:সন্দেহে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগণের আর্থ–সামাজিক অবস্থা। যেখানে আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশেরই একদিন কাজে না গেলে পরিবারের ভাত জোটেনা, সেখানে বাচ্চার পড়াশোনার জন্য স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপ কিনে দিবেন সেটি দূরাশা। এ লকডাউনে ক্লারুম শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হবার অন্য একটি বড় কুফল রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমার গ্রাম ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ২০২১ সালে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা পূর্ববর্তী বছরের ৬০–৭০ শতাংশে নেমে গেছে। সারাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিসংখ্যান এমনই হবার কথা। এটি আমাদের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যই অশনিসংকেত!
অবস্থার উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অনলাইনে ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক–শিক্ষার্থী মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। আসলে সরকার থেকে যখন সকল শিক্ষা–প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে হয়তো এর চেয়ে ভালো বিকল্প নেই। কিন্তু, সার্বিক বিবেচনায় এটিও জোড়াতালি দিয়ে কিছু একটা করে চালিয়ে নেওয়া বৈ কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হাজারো ধরনের কোর্স রয়েছে। চাইলেই সব কোর্সের জন্য অনলাইনে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা এতটা সহজ হবে না। উপরন্তু, এ কোর্সগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়নের কথা ভেবে। এতকিছুর পরেও পূর্বের ন্যায়আগের মতো শিক্ষকদের আন্তরিকতায় এসব সমস্যা উতরে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত ডিভাইস সংকট এখনো অনলাইনে চূড়ান্ত মূল্যায়নের প্রধান অন্তরায়। কেননা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী এখন গ্রামে অবস্থান করছে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশ হওয়ায় অনেক কিছু নিয়েই আমাদের পূর্ব প্রস্তুতি থাকে না। কিন্তু লকডাউনের ১৫তম মাসেও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়াটা অত্যন্ত দু:খজনক। একটা প্রজন্ম এভাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে মাসের পর মাস বসে থাকতে পারে না। কিভাবে শিক্ষা–প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া যায় সেটা ভাবুন। দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ–চিকিৎসকদের সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ে পরামর্শক কমিটি করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেসব পরীক্ষা বাকি আছে সেগুলো কিভাবে দ্রুত সম্পন্ন করা যায় সেটি ভাবুন। প্রয়োজনে এক–দুই ব্যাচ করে করে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। হলগুলো কিভাবে সীমিত আকারে খোলা যায়, সেটি ভাবা যেতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে হলগুলোর আসন পুনর্বিন্যাস করে যখন যে ব্যাচের পরীক্ষা চলবে প্রতি কক্ষে সেখান থেকে একজন করে থাকার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। পরীক্ষার হল সমূহে যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব সেটি ইতোমধ্যে প্রমাণিত। স্কুল–কলেজের ক্ষেত্রে সপ্তাহে নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য ২–৩ দিন করে ক্লাস চালু রাখা যেতে পারে। এভাবে একই সময়ে প্রচুর জনসমাগম এড়ানো যাবে। অধ্যায়ভেদে অনলাইন-অফলাইন সমন্বয় করা যেতে পারে। এভাবে আগের মতো শতভাগ ক্লাস নিতে না পারলেও পরবর্তী শ্রেণিতে ওঠার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়সমূহের সরাসরি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান সম্ভব হতে পারে।
২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে করোনাভাইরাসের এ সময়ে চিকিৎসা, অর্থনীতি ও শিল্পখাতে গতিশীলতা ধরে রাখতে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ছিল আমাদের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এ খাতে সরকার ভালোভাবেই উৎরে গিয়েছে বলতেই হবে। কিন্তু, এ দেড় বছরেও শিক্ষা নিয়ে কোন সুদূরপ্রসারী টেকসই সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়নি। একটি উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেড় বছর সময় কি যথেষ্ট নয়? করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে আমরা অনেক সচেতন, শিক্ষার ভ্যাকসিন আসবে কবে?
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।