নিজস্ব প্রতিবেদক : নড়াইলে এক শিক্ষককে পুলিশের সামনে জুতার মালা পরানোর ঘটনায় কার কতটুকু গাফিলতি ছিল- তা খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে গতকাল বুধবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা পর্যালোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে কথা বলেন তিনি। বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য সমালোচনায় থাকা ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে এক কলেজ ছাত্রের ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে নড়াইলের ঘটনার সূত্রপাত। স্থানীয়দের ভাষ্য, গত ১৭ জুন সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ওই ছাত্রের পোস্ট দেওয়ার পরদিন কলেজে গেলে কিছু মুসলমান ছাত্র তাকে ওই পোস্ট মুছে ফেলতে বলেন।
ওই সময় ‘অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন’ এমন কথা রটানো হলে উত্তেজনা তৈরি হয়। অধ্যক্ষ ও দুজন শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদেরও সংঘর্ষ বাঁধে। ওই সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজের ছাত্র ও স্থানীয়রা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়। ওই ঘটনার কিছু ছবি ও ভিডিও ফেইসবুকে আসে, যাতে পুলিশের উপস্থিতিও দেখা যায়। সামাজিক মাধ্যম ও দেশের বিভিন্ন স্থানে এর প্রতিবাদ চলছে। প্রশাসনের সামনে এ ঘটনা ঘটায় নড়াইলের ডিসি-এসপিরও বিচার দাবি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “দেখুন অকস্মাৎ অনেক ঘটনা ঘটে যায়, যেগুলো হঠাৎ করেই ঘটে যায়। এই ঘটনায় আমরা সত্যিই দুঃখিত, এ ধরনের একজন শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছে উত্তেজিত জনতা। আমাদের ডিসি-এসপি তাৎক্ষণিকভাবে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল..। “সেখানে এত মানুষের উত্তেজনা হয়েছিল, আমরা যা শুনেছি। তারপরও আসল ঘটনাটা কী হয়েছিল সেটা জেনে আপনাদেরকে জানাব।”
ঘটনাটি খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “মনে হয়েছে, উত্তেজিত জনতা এত বেশি একত্র হয়ে গিয়েছিল, সেখানে ডিসি-এসপির কিছু করার আগেই ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। প্রিন্সিপালকে জুতার মালা পরানোর ঘটনা আসলে এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা।“
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “প্রিন্সিপালকে জুতার মালা পরানোর পর আমরা হঠাৎ করেই দেখছি; আমরা ফেইসবুক নামক যন্ত্রে খুব বেশি নিজের কথা, অন্যের কথা প্রচার করে থাকি কিংবা লাইক দিয়ে থাকি। সেখানে আমরা বলব… না জেনে না শুনে- নিজের কথা না বুঝে ফেইসবুকে কোনো উক্তি বা কমেন্টস না করার জন্য আমি পরামর্শ দেব। “
নড়াইলের ঘটনায় পুলিশের কোনো অবহেলা ছিল কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে আসাদুজ্জামান খান বলেন, “আমি তো বলেছি, কেউ কোনো দায়িত্ব অবহেলা করলে- পুলিশ করুক কিংবা আমাদের জেলা প্রশাসক করুক কিংবা যেই করুক, কিংবা কোনো জনপ্রতিনিধি করে থাকুক, সেখানে সবাই ছিল, আমি শুনতে পেয়েছি। সেখানে কার কতখানি গাফিলতি রয়েছে, সেই অনুযায়ী আমরা খতিয়ে দেখছি।”
উত্ত্যক্তের ঘটনায় শাসন করায় গত শনিবার সাভারের হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে (৩৭) স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে তারই প্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। দুই দিন পর ওই শিক্ষকের মৃত্যু ঘটে। বুধবার ভোরে ওই ছাত্রের বাবা উজ্জ্বল হোসেনকে কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যার এ ঘটনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এটা নিয়ে কী বলব…! যারা আমাদের শিক্ষা দেন তাদেরকে যদি ছাত্র হত্যা করে- তাহলে আমাদের কতখানি নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে, আপনারাই চিন্তা করুন! “তবে আমাদের যেটা করণীয়- সেটা করেছি, আমরা তার বাবাকে ধরেছি, শিগগিরই তাকেও ধরব এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।”
‘আশুলিয়া ও নড়াইলের ঘটনা শিক্ষাঙ্গনে অশনি সংকেত’ : সাভারে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা এবং নড়াইলে এক কলেজ অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তার ঘটনাকে শিক্ষাঙ্গনের জন্য ‘অশনি সংকেত’ হিসেবে বর্ণনা করছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই মোর্চা শিক্ষকদের ওপর এ ধরনের আক্রমণ বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি জড়িতদের বিচার দাবি করেছে। শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮১ জন শিক্ষকের স্বাক্ষর রয়েছে সেখানে।
গত শনিবার দুপুরের দিকে সাভারের হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্র। তাকে স্টাম্প বেধড়ক পেটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার ভোরে তিনি মারা যান। অপরদিকে গত ১৮ জুন নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাকে হেনস্থা করে কলেজের ছাত্র ও স্থানীয়রা। বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য সমালোচনায় থাকা ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে ফেইসবুকে এক ছাত্রের ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে নড়াইলেনর ওই ঘটনার সূত্রপাত হয়। এসব ঘটনাকে ‘অশনি সংকেত’ হিসেবে বর্ণনা করে বিবৃতিতে বলা হয়, “পদ্মা সেতু উদ্বোধন-উৎসবের ডামাডোলে ঢাকা পড়ে গেছে অন্তত দুটি ঘটনা। এই দুটি ঘটনায় শিক্ষক হিসেবে আমরা ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। “শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনও উচ্ছৃঙ্খল জনতার বা কখনও বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে আক্রান্ত ও অপমানিত হচ্ছেন, মৃত্যুবরণ করছেন। শিক্ষকদের যে সম্মান এই সমাজ দিত একসময়, আজকাল তা তো উপেক্ষিতই, সঙ্গে জুটছে সহিংসতা এমনকি মৃত্যুও।”
বর্তমান সমাজ-রাষ্ট্র বাস্তবতায় শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র কথা তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, “শিক্ষা ব্যবস্থাকে যেনতেন রকমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তা দিয়ে কেরানি-আমলা হবে; কিন্তু শিক্ষার যে মূল লক্ষ্য, জ্ঞানচর্চা ও মানবিক মূল্যবোধের লালন, সেসবের অস্তিত্ব যেন নেই সেখানে। শিক্ষকদের প্রাপ্য মূল্য-মর্যাদা দিচ্ছে না আজকের সমাজ।”
হিন্দু শিক্ষকদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধের দাবি জানিয়ে নেটওয়ার্ক বলছে, “লক্ষণীয় বিষয় হল, আক্রান্ত শিক্ষকরা হিন্দু সম্প্রদায়ের। অন্তত প্রথম ঘটনাটিকে আক্রমণকারী ‘সংখ্যাগরিষ্ঠরা’ দেখেছে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে।” মুন্সীগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র ম-লের ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়, “এ বছরের এপ্রিল মাসে হৃদয় চন্দ্র ম-লের ক্লাসের আলোচনাকে গোপনে ধারণ করে অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছিল তারই ছাত্র। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি ইসলাম অবমাননা করেছেন। ফলে ওই শিক্ষককে কারাবাস করতে হয়।”
২০১৬ সালে একটি ঘটনা তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, “নারায়ণগঞ্জে সেসসময় এক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সবার সামনে কান ধরে উঠ-বস করান স্থানীয় সংসদ সদস্য। স্পষ্টভাবে বলা ভালো, সারা দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অনুভূতি নিয়ে কতিপয় গোষ্ঠীর অসহিষ্ণুতা বিস্তারের অপচেষ্টা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। “এর মাধ্যমে ক্লাসরুম থেকে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। অল্পতেই তাদের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু অনুভূতি যতই নাজুক হোক, তার প্রতিক্রিয়া খুবই আগ্রাসী।” ‘সংখ্যাগুরুর দাপটে’ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না মন্তব্য করে বিবৃতিতে বলা হয়, “তারা যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। দেশের সংবিধান-আইন-কানুনে যাই লেখা থাক, প্রশাসন ও রাজনীতিবিদরা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের’ পক্ষেই কাজ করে চলেছে।”
শিক্ষক হেনস্তায় কার কী দায়, খতিয়ে দেখা হচ্ছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ট্যাগস :
শিক্ষক হেনস্তায় কার কী দায়
জনপ্রিয় সংবাদ