ঢাকা ১১:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
গুচ্ছ বনাম স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষা

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কোন পথে?

  • আপডেট সময় : ০৫:৩৮:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
  • ১৫ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

ড. খালিদুর রহমান

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) একটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। ২৫ আগস্ট ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনটি বিভাগ নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষাদান, গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি শুধু সিলেট নয়, গোটা দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে এক স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষার প্রসার, আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নিবিড় সম্পর্ক- এ তিনটি উপাদানই বিশ্ববিদ্যালয়টির সাফল্যের মূলভিত্তি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মান, বিশেষত শিক্ষার্থীর গুণগত মান নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অনেকেই মনে করেন, গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতির প্রবর্তন এই মান-অবনতির অন্যতম প্রধান কারণ।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল—বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আধুনিক জ্ঞানের প্রসার ঘটানো এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একত্রে এনে একটি প্রাণবন্ত একাডেমিক পরিবেশ গড়ে তোলা। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একটি স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সারা দেশ থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই করত।

ওই পরীক্ষার বৈশিষ্ট্য ছিল- প্রশ্নের মান, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাশক্তি যাচাই এবং নতুন ধরনের প্রশ্ন কাঠামো। ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কিংবা খুলনা—দেশের সব প্রান্ত থেকেই অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী সিলেটে এসে ভর্তি হতো। শাবিপ্রবির ক্যাম্পাস একসময় ছিল বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের এক মেলবন্ধনস্থল। এই বৈচিত্র্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা, গবেষণা ও সংস্কৃতিতে এক অনন্য সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল।

কোভিড-১৯ মহামারির সময় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রক্রিয়াকে সহজ করার উদ্দেশ্যে চালু হয় “গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতি”। এর মাধ্যমে দেশের প্রায় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় একত্রে একটি অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা নেয়। শুরুতে এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল প্রশংসনীয়—শিক্ষার্থীদের আর্থিক ও ভৌগোলিক ঝামেলা কমানো, পরীক্ষার সংখ্যা হ্রাস করা এবং সময় বাঁচানো। কিন্তু বাস্তবে এই পদ্ধতি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমস্যার জন্ম দেয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এর অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান।

গুচ্ছ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের মান নির্ধারিত হয়েছিল অংশগ্রহণকারী সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয় করে। ফলে প্রশ্নের কঠিনতা তুলনামূলকভাবে কম রাখা হয়, যাতে সব স্তরের শিক্ষার্থীই সুযোগ পায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় উচ্চমানের বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন ও সমস্যা সমাধানভিত্তিক মূল্যায়ন হারিয়ে যায়; যা শাবিপ্রবির নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল।

ফলাফল হলো, অনেক সময় তুলনামূলকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীরাও শাবিপ্রবিতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছিল। অন্যদিকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিচ্ছিল- যেহেতু গুচ্ছের মাধ্যমে তারা সহজেই কাছের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারত। ফলে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের গুণগত মান ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। আগের মতো প্রতিযোগিতামূলক ও সক্রিয় শিক্ষার পরিবেশ আর দেখা যায় না। ক্লাসে আগ্রহ, গবেষণায় অংশগ্রহণ, কিংবা নতুন প্রযুক্তি-নির্ভর চিন্তাধারার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

শাবিপ্রবির অনেক শিক্ষকই খোলাখুলিভাবে বলেছেন—ভালো মানের শিক্ষার্থী না পেলে শিক্ষাদান ও গবেষণার মান ধরে রাখা কঠিন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম এমনভাবে সাজানো যে তা মেধাবী ও অনুসন্ধিৎসু মননসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য।

শাবিপ্রবির কোর্সগুলো বিশ্লেষণ, সমস্যা সমাধান, গবেষণা ও উদ্ভাবনের ওপর নির্ভরশীল। গড়পড়তা শিক্ষার্থী এখানে টিকে থাকতে গেলেও যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। যখন ভর্তি পরীক্ষার মান নিচের দিকে যায়, তখন পাঠদানের মানও স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রভাবিত হয়। এ প্রভাব শুধু ক্লাসরুমেই নয়; গবেষণার ফলাফল, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ কিংবা পেটেন্ট অর্জনের ক্ষেত্রেও পড়ছে। এক সময় যে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গবেষণায় দেশের শীর্ষে, সেখানে এখন তেমন সাফল্যের খবর তুলনামূলকভাবে কম শোনা যায়।

আরেকটি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে ভর্তি প্রবণতায়। গুচ্ছ পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। এতে করে শাবিপ্রবির পূর্বের বৈচিত্র্যময় ছাত্রসমাজ সংকুচিত হয়েছে।

আগে সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসত।র ফলে বিভিন্ন অঞ্চল, সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার মেলবন্ধন ঘটত। এটি ছিল শাবিপ্রবির সাংস্কৃতিক প্রাণশক্তির অন্যতম উৎস। এখন সেই বৈচিত্র্য ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে; যা দীর্ঘমেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তচিন্তা ও একাডেমিক পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালে শাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ পুনরায় স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার, শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিক- সবার কাছেই স্বাগত উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়টি তার আগের একাডেমিক কঠোরতা ও মেধাভিত্তিক বাছাই প্রক্রিয়ায় ফিরতে পারবে—এমন প্রত্যাশা করছেন সবাই। এতে করে শুধু শিক্ষার্থীর মানই নয়, গবেষণার গতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক মর্যাদাও পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

শাবিপ্রবি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়। এটি দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার একটি মডেল। এখানে চালু হওয়া শিক্ষাদান পদ্ধতি, সেমিস্টারভিত্তিক মূল্যায়ন, ক্রেডিট সিস্টেম কিংবা আইসিটিনির্ভর প্রশাসন পরবর্তীকালে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করেছে। তাই এ প্রতিষ্ঠানের মানে পতন শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা নয়। এটি পুরো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্যও সতর্ক সংকেত। ভালো শিক্ষার্থী, যোগ্য শিক্ষক ও মানসম্পন্ন প্রশাসনিক কাঠামো- এ তিনের সমন্বয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের চাবিকাঠি। এর যে কোনো একটিতে ঘাটতি দেখা দিলে শিক্ষার মান টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

গুচ্ছ পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল সহজীকরণ। কিন্তু তা যেন মান-হ্রাসের কারণ না হয়—এই ভারসাম্য রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষত গবেষণাভিত্তিক ও প্রযুক্তিমুখী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি ‘একই ধরনের ভর্তি কাঠামো’ প্রয়োগ করা বাস্তবসম্মত নয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একাডেমিক দর্শন ও কাঠামো রয়েছে; যা অনুযায়ী তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা উচিত।

শাবিপ্রবি যে পথে হাঁটছে অর্থাৎ পুনরায় স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষার পথে ফিরে আসা—সেটিই হওয়া উচিত অন্যান্য বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও অনুসরণযোগ্য উদাহরণ।

মোট কথা, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একসময় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার গৌরব ছিল। গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতির প্রভাবে সেই গৌরব কিছতা ম্লান হয়েছে বটে, কিন্তু এখনো দেরি হয়নি। স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষা পুনরায় চালুর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি আবারো ওই পুরনো মেধা, প্রাণশক্তি ও উদ্ভাবনের ধারায় ফিরে আসতে পারে- যদি এই সিদ্ধান্ত ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করা যায়।

এখন সময় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রশাসন ও সরকার—সবাইকে একসাথে ভাবার। শিক্ষা শুধু ভর্তি পরীক্ষার সংখ্যা কমানোর ব্যাপার নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের প্রক্রিয়া। আর সেই প্রক্রিয়ার মান ধরে রাখাই হতে হবে শাবিপ্রবির আগামী পথচলার মূল অঙ্গীকার।

লেখক: অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান ফায়ার সার্ভিস ডিজির

গুচ্ছ বনাম স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষা

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কোন পথে?

আপডেট সময় : ০৫:৩৮:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫

ড. খালিদুর রহমান

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) একটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান। ২৫ আগস্ট ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনটি বিভাগ নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষাদান, গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি শুধু সিলেট নয়, গোটা দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে এক স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষার প্রসার, আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নিবিড় সম্পর্ক- এ তিনটি উপাদানই বিশ্ববিদ্যালয়টির সাফল্যের মূলভিত্তি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মান, বিশেষত শিক্ষার্থীর গুণগত মান নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অনেকেই মনে করেন, গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতির প্রবর্তন এই মান-অবনতির অন্যতম প্রধান কারণ।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল—বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আধুনিক জ্ঞানের প্রসার ঘটানো এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একত্রে এনে একটি প্রাণবন্ত একাডেমিক পরিবেশ গড়ে তোলা। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একটি স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সারা দেশ থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই করত।

ওই পরীক্ষার বৈশিষ্ট্য ছিল- প্রশ্নের মান, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাশক্তি যাচাই এবং নতুন ধরনের প্রশ্ন কাঠামো। ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কিংবা খুলনা—দেশের সব প্রান্ত থেকেই অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী সিলেটে এসে ভর্তি হতো। শাবিপ্রবির ক্যাম্পাস একসময় ছিল বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের এক মেলবন্ধনস্থল। এই বৈচিত্র্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা, গবেষণা ও সংস্কৃতিতে এক অনন্য সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল।

কোভিড-১৯ মহামারির সময় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রক্রিয়াকে সহজ করার উদ্দেশ্যে চালু হয় “গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতি”। এর মাধ্যমে দেশের প্রায় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় একত্রে একটি অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা নেয়। শুরুতে এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল প্রশংসনীয়—শিক্ষার্থীদের আর্থিক ও ভৌগোলিক ঝামেলা কমানো, পরীক্ষার সংখ্যা হ্রাস করা এবং সময় বাঁচানো। কিন্তু বাস্তবে এই পদ্ধতি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমস্যার জন্ম দেয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এর অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান।

গুচ্ছ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের মান নির্ধারিত হয়েছিল অংশগ্রহণকারী সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয় করে। ফলে প্রশ্নের কঠিনতা তুলনামূলকভাবে কম রাখা হয়, যাতে সব স্তরের শিক্ষার্থীই সুযোগ পায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় উচ্চমানের বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন ও সমস্যা সমাধানভিত্তিক মূল্যায়ন হারিয়ে যায়; যা শাবিপ্রবির নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল।

ফলাফল হলো, অনেক সময় তুলনামূলকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীরাও শাবিপ্রবিতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছিল। অন্যদিকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিচ্ছিল- যেহেতু গুচ্ছের মাধ্যমে তারা সহজেই কাছের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারত। ফলে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের গুণগত মান ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। আগের মতো প্রতিযোগিতামূলক ও সক্রিয় শিক্ষার পরিবেশ আর দেখা যায় না। ক্লাসে আগ্রহ, গবেষণায় অংশগ্রহণ, কিংবা নতুন প্রযুক্তি-নির্ভর চিন্তাধারার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

শাবিপ্রবির অনেক শিক্ষকই খোলাখুলিভাবে বলেছেন—ভালো মানের শিক্ষার্থী না পেলে শিক্ষাদান ও গবেষণার মান ধরে রাখা কঠিন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম এমনভাবে সাজানো যে তা মেধাবী ও অনুসন্ধিৎসু মননসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য।

শাবিপ্রবির কোর্সগুলো বিশ্লেষণ, সমস্যা সমাধান, গবেষণা ও উদ্ভাবনের ওপর নির্ভরশীল। গড়পড়তা শিক্ষার্থী এখানে টিকে থাকতে গেলেও যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। যখন ভর্তি পরীক্ষার মান নিচের দিকে যায়, তখন পাঠদানের মানও স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রভাবিত হয়। এ প্রভাব শুধু ক্লাসরুমেই নয়; গবেষণার ফলাফল, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ কিংবা পেটেন্ট অর্জনের ক্ষেত্রেও পড়ছে। এক সময় যে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গবেষণায় দেশের শীর্ষে, সেখানে এখন তেমন সাফল্যের খবর তুলনামূলকভাবে কম শোনা যায়।

আরেকটি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে ভর্তি প্রবণতায়। গুচ্ছ পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। এতে করে শাবিপ্রবির পূর্বের বৈচিত্র্যময় ছাত্রসমাজ সংকুচিত হয়েছে।

আগে সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসত।র ফলে বিভিন্ন অঞ্চল, সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার মেলবন্ধন ঘটত। এটি ছিল শাবিপ্রবির সাংস্কৃতিক প্রাণশক্তির অন্যতম উৎস। এখন সেই বৈচিত্র্য ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে; যা দীর্ঘমেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তচিন্তা ও একাডেমিক পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালে শাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ পুনরায় স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার, শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিক- সবার কাছেই স্বাগত উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়টি তার আগের একাডেমিক কঠোরতা ও মেধাভিত্তিক বাছাই প্রক্রিয়ায় ফিরতে পারবে—এমন প্রত্যাশা করছেন সবাই। এতে করে শুধু শিক্ষার্থীর মানই নয়, গবেষণার গতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক মর্যাদাও পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

শাবিপ্রবি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়। এটি দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার একটি মডেল। এখানে চালু হওয়া শিক্ষাদান পদ্ধতি, সেমিস্টারভিত্তিক মূল্যায়ন, ক্রেডিট সিস্টেম কিংবা আইসিটিনির্ভর প্রশাসন পরবর্তীকালে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করেছে। তাই এ প্রতিষ্ঠানের মানে পতন শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা নয়। এটি পুরো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্যও সতর্ক সংকেত। ভালো শিক্ষার্থী, যোগ্য শিক্ষক ও মানসম্পন্ন প্রশাসনিক কাঠামো- এ তিনের সমন্বয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের চাবিকাঠি। এর যে কোনো একটিতে ঘাটতি দেখা দিলে শিক্ষার মান টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

গুচ্ছ পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল সহজীকরণ। কিন্তু তা যেন মান-হ্রাসের কারণ না হয়—এই ভারসাম্য রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষত গবেষণাভিত্তিক ও প্রযুক্তিমুখী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি ‘একই ধরনের ভর্তি কাঠামো’ প্রয়োগ করা বাস্তবসম্মত নয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একাডেমিক দর্শন ও কাঠামো রয়েছে; যা অনুযায়ী তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা উচিত।

শাবিপ্রবি যে পথে হাঁটছে অর্থাৎ পুনরায় স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষার পথে ফিরে আসা—সেটিই হওয়া উচিত অন্যান্য বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও অনুসরণযোগ্য উদাহরণ।

মোট কথা, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একসময় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার গৌরব ছিল। গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতির প্রভাবে সেই গৌরব কিছতা ম্লান হয়েছে বটে, কিন্তু এখনো দেরি হয়নি। স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষা পুনরায় চালুর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি আবারো ওই পুরনো মেধা, প্রাণশক্তি ও উদ্ভাবনের ধারায় ফিরে আসতে পারে- যদি এই সিদ্ধান্ত ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করা যায়।

এখন সময় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রশাসন ও সরকার—সবাইকে একসাথে ভাবার। শিক্ষা শুধু ভর্তি পরীক্ষার সংখ্যা কমানোর ব্যাপার নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের প্রক্রিয়া। আর সেই প্রক্রিয়ার মান ধরে রাখাই হতে হবে শাবিপ্রবির আগামী পথচলার মূল অঙ্গীকার।

লেখক: অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ