ক্রীড়া প্রতিবেদক: সুলতানা খাতুনের বলে সুইপ করার চেষ্টায় ব্যাটে লাগাতে পারলেন না আর্লিন কেলি। বল প্যাডে লাগতেই জোরাল আবেদন। মুহূর্তেই সেই আবেদন রূপ নিল উদযাপনে। আম্পায়ার ততক্ষণে আঙুল তুলে দিয়েছেন। আইরিশ ইনিংস শেষ ৩০ ওভারের আগেই! বাংলাদেশের সেই উদযাপন তাই স্রেফ একটি উইকেটের নয়, রেকর্ডগড়া ব্যবধানে ম্যাচ জয়েরও। জয়ের ভিতটা গড়া হয়েছিল ম্যাচের প্রথম ভাগেই। প্রায় দেড় বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে দুর্দান্ত এক ইনিংস উপহার দেন শারমিন আক্তার। অভিজ্ঞ ব্যাটারের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসে ২৫২ রানের পুঁজি পায় বাংলাদেশ, ওয়ানডেতে যা তাদের দলীয় সর্বোচ্চ। এই রান এমনিতেই আয়ারল্যান্ডের ধরাঁছোয়ার বাইরে ছিল। তারা পারেনি লড়াই জমাতেও। গুটিয়ে গেছে মাত্র ২৮.৫ ওভারে ৯৮ রানেই। মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বুধবার ১৫৪ রানের এই জয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। গত বছরের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১১৯ রানের জয় ছিল আগের রেকর্ড। আইসিসি উইমেন’স চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ তিন ম্যাচের এই সিরিজ থেকে নিগার সুলতানার দলের লক্ষ্য পূর্ণ ছয় পয়েন্ট। ২ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম পদক্ষেপ নিলেন তারা। চ্যাম্পিয়নশিপে ১৯ ম্যাচে তাদের এখন ১৫ পয়েন্ট। শারমিনের পাশাপাশি পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংস খেলেন ফারজানা হক। বরাবরের মতোই ধীরস্থির ব্যাটিংয়ে ৬১ রান করতে ১১০ বল খেলেন দেশের সফলতম ব্যাটার। সবসময়ই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে বড় সমস্যা অতিরিক্ত ডট খেলার প্রবণতা। এই ম্যাচেও শুরুতে সেই চেনা চক্রে ছিলেন ফারজানা, মুর্শিদা খাতুনরা। তবে তিন নম্বরে নামা শারমিন দারুণ ব্যাটিংয়ে বদলে দেন চিত্র। ইনিংসজুড়ে উইকেটের চারদিকে শট খেলেছেন ২৮ বছর বয়সী ব্যাটার। আগের ৩৫ ম্যাচে যার গড় ছিল মাত্র ১৬.৫২ আর স্ট্রাইক রেট ছিল ৪৬.৭১, সেই ব্যাটার চমক দেন উন্নতির ছাপ রেখে। পায়ের দারুণ ব্যবহার, পাওয়ার হিটিংসহ চমৎকারভাবে ইনিংস সাজান তিনি।
ক্যারিয়ারের চতুর্থ পঞ্চাশছোঁয়া ইনিংসটিকে একটুর জন্য প্রথম সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে পারেননি তিনি। তবে ৮৯ বলে ৯৬ রানের ইনিংসটিতে গোটা দুয়েক কীর্তি ঠিকই গড়ে ফেলেন। বাংলাদেশের হয়ে দ্রুততম ওয়ানডে সেঞ্চুরির রেকর্ড নিজের করে নেন তিনি। গোটা ইনিংসে চার মারেন ১৪টি, সেটিও বাংলাদেশের রেকর্ড। সকালে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে উদ্বোধনী জুটিতে ১১২ বলে ৫৯ রান করেন মুর্শিদা ও ফারজানা। প্রথম পাওয়ার প্লের দশ ওভারে তারা খেলেন ৪৫টি ডট বল। প্রথম ২৫ ওভারে ডট বলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৫টি। ২৯ রানে দুবার জীবন পেয়েও বেশি দূর যেতে পারেননি মুর্শিদা। ৬১ বলে ৩৮ রান করে আউট হন বাঁহাতি ওপেনার। বাংলাদেশের রান রেট তখন তিনের সামান্য বেশি। শারমিন ক্রিজে যাওয়ার পর রানের গতি প্রায় নতুন প্রাণ। পরপর দুই চারে যাত্রা শুরুর পর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। আইরিশ বোলারদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে ফিফটিতে পৌঁছে যান ৪১ বলে। বাংলাদেশের হয়ে দ্রুততম ফিফটি এটি। ২০২১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪৪ বলে ফিফটি করে এতদিন রেকর্ডটি ছিল রুমানা আহমেদের।
অন্য প্রান্তে ফারজানা ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১১তম ফিফটি করতে খেলেন ৯৮ বল। এরপর তিনি বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। ফারজানার বিদায়ে ভাঙে ১০৫ বলে ১০৪ রানের জুটি। পরে নিগারের সঙ্গে ৬৪ বলে ৬১ রানের জুটি গড়েন শারমিন। ১০ রানে স্টাম্পিংয়ের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া নিগার ২৪ বলে করেন ২৪ রান। শেষ দিকে একটু ক্লান্তি ভর করে তার ওপর। প্রত্যাশিত দ্রুততায় তখন রান করতে পারেননি। ৩৯ থেকে ৪৯, এই ১০ ওভারে তার ব্যাট থেকে আসে কেবল একটি চার। ওই সময়টায় ৩১ বল খেলে ২৬ রান করতে পারেন তিনি। শতরানের সুযোগ তার পরও ছিল তার। কিন্তু ক্লান্ত এক শটে আউট হয়ে যায় ৪৯তম ওভারের শেষ বলে। তবে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত আড়াইশ পেরিয়ে যায় প্রথমবারের মতো। রান তাড়ায় শুরু থেকেই পিছিয়ে পড়ে আয়ারল্যান্ড। তৃতীয় ওভারে পরপর দুই বলে আইরিশ অধিনায়ক গ্যাবি লুইস ও উইকেটরক্ষক-ব্যাটার এমি হান্টারকে ফেরান মারুফা আক্তার। তৃতীয় উইকেটে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন ওর্লা প্রেন্ডারগাস্ট ও সারাহ ফোর্বস। তবে ৩৮ রানে থামে এই জুটি। মাত্রই বিগ ব্যাশ খেলে আসা প্রেন্ডারগাস্টকে ফেরান নাহিদা আক্তার। কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি ও পরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে টানা দুটি ঝড়ো ফিফটি করা ব্যাটারকে ১৯ রানে থামায় বাংলাদেশ। পরে রান আউটে কাটা পড়েন দলের সর্বোচ্চ ২৫ রান করা ওপেনার ফোর্বস। পরে আর নাহিদা-সুলতানাদের স্পিনের সামনে কেউই টিকতে পারেননি। কিছুক্ষণ একপ্রান্ত আগলে রেখে ২২ রান করেন এই সিরিজের আগেই অধিনায়কত্ব হারানো লরা ডেলানি। আয়ারল্যান্ডের চার ব্যাটার রানের খাতাই খুলতে পারেননি। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ একই মাঠে শনিবার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৫২/৪ (ফারজানা ৬১, মুর্শিদা ৩৮, শারমিন ৯৬, নিগার ২৮, স্বর্ণা ১৩*, সোবহানা ৫*; প্রেন্ডারগাস্ট ৪-০-১৭-০, ক্যানিং ১০-০-৩৫-০, কেলি ১০-০-৪৬-০, সারজেন্ট ১০-০-৫১-২, ডেলানি ৬-০-৩৮-১, ম্যাগুয়েইর ১০-০-৬২-১)
আয়ারল্যান্ড: ২৮.৫ ওভারে ৯৮ (ফোর্বস ২৫, লুইস ৫, হান্টার ০, প্রেন্ডারগাস্ট ১৯, ডেলানি ২২, পল ০, রেমন্ড-হোয়ি ৭, কেলি ৪, ক্যানিং ০, সারজেন্ট ০, ম্যাগুয়েইর ৯*; মারুফা ৪-০-১৮-২, সুলতানা ৮.৫-০-২৩-৩, নাহিদা ৯-১-২৩-৩, ফাহিমা ৩-১-১৪-০, রাবেয়া ৪-০-১৮-০)
ফল: বাংলাদেশ ১৫৪ রানে জয়ী
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ১-০তে এগিয়ে।
প্লেয়ার অব দা ম্যচ: শারমিন আক্তার
শারমিনের দ্যুতিময় ইনিংসে বাংলাদেশের ঝলমলে জয়
জনপ্রিয় সংবাদ