নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদে ঢাকায় ‘সম্প্রীতি সমাবেশ ও শান্তি শোভাযাত্রা’ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
গতকাল মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আয়োজিত এই সমাবেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস রুখে দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। ঢাকা ছাড়াও দেশের সব জেলা, মহানগর, উপজেলায় এমন সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের পর শান্তি শোভাযাত্রা উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি আওয়ামী লীগ ও এর সব সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং দেশের সচেতন মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়িয়ে তা প্রতিহত করার আহ্বান জানান।
দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশে শেখ হাসিনা আছেন, আওয়ামী লীগ আছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধ করব। হিন্দু ভাইদের বলব, আপনাদের ভয় নেই, শেখ হাসিনা আপনাদের সঙ্গে আছেন, আওয়ামী লীগ আপনাদের সঙ্গে আছে।’
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টকারীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ রাজপথ ছাড়ে নাই। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নির্দেশে সারা বাংলাদেশে আজ সম্প্রীতি সমাবেশ হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ রাজপথে আছে। যত দিন না এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিষদাঁত আমরা ভেঙে দিতে পারব, তত দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাজপথে থাকবে, রাস্তায় থাকবে।’
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারতে মুসলমান আছে, তাদের জানমালের কথাও আমাদের ভাবতে হবে।’ সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মোকাবিলা করে সমুচিত জবাব দিতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রস্তুত আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলন ও নির্বাচনে ব্যর্থ বিএনপি আজ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উসকে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। ওবায়দুল কাদের বলেন, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। সাম্প্রদায়িক এই অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, এদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আসতে থাকে। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী সমাবেশে সমবেত হয়। বেলা ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, গুলিস্তান, নুর হোসেন স্কয়ার (জিরো পয়েন্ট) লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এ সময় তারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে।
সমাবেশ শেষে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে শোভাযাত্রা বের হয়। শোভাযাত্রাটি বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। সমাবেশ ও শোভাযাত্রার পর যুবলীগসহ দলের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনও পৃথক পৃথক সমাবেশ করে।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, মির্জা আজম ও আফজাল হোসেন, উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় সদস্য আব্দুল আউয়াল শামীম, শাহাবুদ্দিন ফরাজী প্রমুখ।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিকদের আট দফা দাবি
নিজস্ব প্রতিবেদক : সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে রাজধানীতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন দেশের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সাংবাদিকরা। এসময় তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা, ওয়াজ মাহফিলে সাম্প্রদায়িক ও নারীবিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধের উদ্যোগ নেওয়াসহ আট দফা দাবি জানান। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিকদের যৌথ উদ্যোগে গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৫টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই সমাবেশ হয়।
শাহদাত হোসেন নিপুর সঞ্চালনায় সমাবেশে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজাম-প, বাড়িঘর, দোকানপাটে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলা, ভাঙচুর, হত্যার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সাংবাদিকেরা বক্তব্য রাখেন।
এ সময় বক্তারা বলেন, কুমিল্লার এক পূজাম-পে কোরান শরীফ অবমাননা করা হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে যেভাবে পূজাম-পে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে, তা গভীর ষড়যন্ত্রমূলক। এর রেশ ধরে চাঁদপুর, নোয়াখালী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করেছে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। সরকারের বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। আমরা দেখেছি অতীতেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর হামলা করা হয়েছে, যার একটিরও সঠিক তদন্ত হয়নি, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। একাত্তরে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী গত পঞ্চাশ বছরে প্রতিটি সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস-আঁতাত করে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় যেতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিসর্জন দিয়েছে। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ উপড়ে ফেলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
সমাবেশে আট দফা দাবি তুলে ধরেন সাহিত্যিক স্বকৃত নোমান। দাবিগুলো হলো-
১. এবারের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করা।
২. রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, কুমিল্লা, হাজীগঞ্জ, নোয়াখালী ও রংপুরে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার প্রকৃত কারণ জনসম্মুখে প্রকাশ করা ও প্রতিটি ঘটনার বিচার করা। অতীতে সাম্প্রদায়িক হামলার হোতা অভিযুক্ত অনেক ব্যক্তিকে রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রকাশ্যে কর্মরত দেখা যায়। তাদেরকে চিহ্নিত করে বহিস্কার ও বিচার করা।
৩. ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ধর্মসভা তথা ওয়াজ মাহফিলে সাম্প্রদায়িক ও নারীবিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া
৪. স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক থেকে সাম্প্রদায়িক পাঠ বিলুপ্ত করে অসাম্প্রদায়িক পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।
৫. বহু জাতি এবং বহু ধর্মসম্প্রদায়ের এই দেশের সংবিধান থেকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বাতিল করা।
৬. সাম্প্রদাায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সরকারি উদ্যোগে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আন্তঃধর্মীয় সংলাপের আয়োজন করা।
৭. সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দেশের সংস্কৃতিচর্চার (নাটক, গান, নৃত্য, যাত্রাপালা, পালাগান, বাউলগান) প্রসার ঘটানো। পাশাপাশি স্বাধীন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাণিত করা। এবং
৮. দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে পাঠাগার ও সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন করা।
সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে বক্তৃতা করেন, লেখক আনিসুল হক, চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা, কবি চঞ্চল আশরাফ, সাংবাদিক আহমাদ মোস্তফা কামাল, সাংবাদিক মনির হায়দার, জুলহাস নূস, এফ এম শাহীন, ঝর্ণা রহমান, মাসুদ পথিক, মৌটুসি বিশ্বাস, নাজমুল হক প্রধান, কবি টোকন ঠাকুর, লেখক পারভেজ হোসেন, রেজা ঘটক, মুনা চৌধুরী, লীনা পারভীন, মাসুম আজিজুল বাসার, শাকিরা পারভীন সোমা, হুমায়ূন কবীর ঢালী, কবি শাহেদ কায়েস, মোজাফফর হোসেন, লোপা মমতাজ, মুভিয়ানার বেলায়েত হোসেন মামুন, কানিজ আকলিমা সুলতানা, জোবায়দা নাসরিন, কৃষ্ণা সরকার, আলতাফ শাহনেওয়াজ, আফরোজা সোমা প্রমুখ।
এ সময় অন্যদের মধ্যে ইশরাত তানিয়া, মামুন খান, আহমেদ শিপলু, অরবিন্দ চক্রবর্তী, লেখক ও সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, খালেদ রাহী, জয়দীপ দে, রনি রেজা, অপু মেহেদী, মানজারে হাসান মুরাদ, রঞ্জনা বিশ্বাস, অপর্ণা হালদার, জাহারা জাহান পার্লিয়া, রিপন আহসান ঋতু, দুর্জয় খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
শান্তির পক্ষে সমাবেশ, ‘সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস’ রুখে দেওয়ার প্রত্যয়
ট্যাগস :
শান্তির পক্ষে সমাবেশ
জনপ্রিয় সংবাদ