ঢাকা ০৩:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

শান্তিময় সমাজ গড়তে চাই মহানবির আদর্শ অনুসরণ

  • আপডেট সময় : ০৮:২৬:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫
  • ১১ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

মাহমুদ আহমদ

বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে জমানায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে সময়ের মানুষ ছিল মোশরেক। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আরব ছিল একটি পরস্পর বিরোধী জাতি। তাদের মধ্যে বহু মারাত্মক পাপের প্রচলন ছিল।

মদের প্রতি সাংঘাতিকভাবে আসক্ত ছিল আরবরা। মদের নেশায় বেহুঁশ হওয়া কিংবা মাতলামি করা তাদের কাছে কোনো দূষণীয় ব্যাপারই ছিল না বরং তা প্রশংসার ব্যাপার ছিল। কোনো অভিজাত ব্যক্তির আভিজাত্যের চিত্রসমূহের মধ্যে এই চিত্র থাকারও প্রয়োজন ছিল যে, তিনি তার বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদেরকে জোর করে মদ খাওয়াবেন।

ধনী ব্যক্তিদের জন্য জরুরি ছিল, দিনে পাঁচবার মদের আসর বসানো এবং এই ধরনের আসর ছিল তাদের জাতীয় ক্রীড়া। জুয়া খেলাকে তারা বদান্যতা ও গৌরবের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। যুদ্ধের সময় তারা জুয়ার মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা সংগ্রহ করতো। সেই যুগে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। কোনো কোনো জাতির মধ্যে পিতা কর্তৃক আপন কন্যাকে হত্যা করাটা সম্মানের বিষয় ছিল।

ওই যুগে দাস প্রথা একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল। তারা আশ-পাশের গোত্রের লোকজন ধরে এনে গোলাম বানিয়ে রাখতো। গোলামদের কোনো হক বা অধিকার ছিল না। প্রত্যেক মালিক তার গোলামের সাথে যেমন খুশি ব্যবহার করতো। এতে কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা ছিল না; এমনকি হত্যা করলেও কেউ কোনো অভিযোগের সম্মুখীন হতো না।

দাসীদের সাথে যৌনাচার মালিকদের জন্য বৈধ বলে স্বীকার করা হতো। দাসীদের সন্তানরাও গোলামরূপে গণ্য হতো। নিজের ঔরসজাত সন্তানের মা হলেও দাসী দাসীই থাকতো।

‘রাসুল করিম (সা.) গোলামদের সঙ্গে আহার করতেন এবং গম ভাঙানোর সময় গোলামরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি তাদের সাহায্য করতেন। বাজার থেকে জিনিসপত্র ঘরে বহন করে নিয়ে যাওয়াকে তিনি হেয় মনে করতেন না। ধনী-গরিবের সঙ্গে একইভাবে মুসাফাহা (করমর্দন) করতেন; সর্বপ্রথম সালাম করতেন। তিনি কোনো নিমন্ত্রণকে অবজ্ঞা করতেন না- যদিও বা ওই নিমন্ত্রণ শুধু খেজুরের হতো। তিনি দুঃখীদের পরিত্রাণ দান করতেন। তিনি কোমল হৃদয়ের অধিকারী ও দয়ালু ছিলেন। তার আচার-ব্যবহার উত্তম ছিল’।

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে জন্মগ্রহণ করেন মানবতার সর্বোত্তম আদর্শ হজরত মুহাম্মদ (সা.)। বাল্যকাল থেকেই তার প্রকৃতিতে মানবের কল্যাণ করার বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হতো। মানুষের লড়াই ঝগড়ার মধ্যে তিনি কখনও নিজেকে জড়াতেন না। বরং লড়াই ও কলহ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টাই করতেন।

আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে তিনি (সা.) প্রথম কোরআনি ওহি যখন লাভ করেন, তখন হজরত খাদিজার (রা.) কাছে এলেন। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তিনি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। হজরত খাদীজা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে’? তিনি পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলেন এবং বললেন, ‘আমার মতো দুর্বল মানুষ এত বড়ো বোঝা কেমন করে বইবে?’ হজরত খাদীজা (রা.) তখন তাকে বলেছিলেন, ‘খোদার কসম!’ এই বাণী আল্লাহতায়ালা আপনার ওপর এ জন্য নাজিল করেননি যে, তিনি আপনাকে অযোগ্য ও অকৃতকার্য প্রমাণিত করবেন এবং আপনার সঙ্গ ছেড়ে দেবেন। খোদা কি কখনও এমন করতে পারেন?

আপনি তো সেই ব্যক্তি- যিনি আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে উত্তম আচরণ করেন, গরিব ও অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্য করেন, তাদের বোঝা নিজে বহন করেন। যে চরিত্র গুণ এদেশ থেকে উঠে গেছে তা সবই আপনার মাধ্যমে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আপনি অতিথির সেবাকারী, দুঃখী মানুষের সহায়তাকারী। এই রকম মানুষকে কি আল্লাহতায়ালা কখনও পরীক্ষার মধ্যে ফেলে রাখতে পারেন?

মানবতার রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা দেখুন- একবার এক জিহাদের ময়দানে উসামা বিন যায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে এক ব্যক্তির লড়াই হচ্ছিল। উসামা বিন যায়েদ লোকটিকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন এবং হত্যা করতে উদ্যত হন। এমন সময় অবিশ্বাসী লোকটি সম্পূর্ণ কলেমা নয়, বরং এর প্রথমাংশ পাঠ করে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়। তথাপি উসামা তাকে হত্যা করেন।

ঘটনাটি হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর কাছে রিপোর্ট করা হলে তিনি (সা.) উসামাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, সে ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তুমি তাকে কেন হত্যা করলে? উত্তরে উসামা বলেছিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! সে তো প্রাণের ভয়ে ইসলাম কবুল করেছিল। হজরত রাসুল করিম (সা.) তখন বলেছিলেন ‘তুমি কী তার হৃদয় ফেড়ে দেখেছিলে যে, সে সত্য সত্যই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, না প্রাণের ভয়ে এ কথা উচ্চারণ করেছিল?

রাসুল পাক (সা.) অতঃপর বলতে লাগলেন, কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে তুমি কি করে তোমার কাজকে সঠিক সাব্যস্ত করবে?

হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেন, যখন কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে তখন তুমি কী করবে? রাসুল করিম (সা.)-এর এরূপ ভয়ানক অসন্তুষ্টি দেখে উসামা ভীষণ ঘাবড়ে যান। আর হজরত রাসুল পাক (সা.) তখনো ওই কথাই বারবার বলছিলেন যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যখন তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে, তখন তুমি কি করবে? উসামা পরে বলেছিলেন, ‘হায়! আমি যদি এই ঘটনার পরে ইসলাম গ্রহণ করতাম।’

ওই ঘটনা এবং আরো নানা ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বলপূর্বক মুসলমান বানানো ইসলামি ‘জিহাদের উদ্দেশ্য কখনই ছিল না এবং সে যুগে বলপূর্বক কাউকে মুসলমান করাও হয়নি, কোনো যুদ্ধ বন্দিকেও না। ইসলাম কখনো তরবারির দ্বারা প্রসার লাভ করেনি, ইসলাম প্রসার লাভ করেছে হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর উন্নত আদর্শ, মানব প্রেম, তবলিগ ও ক্ষমার দৃষ্টান্তের মাধ্যমে।

হাদিসে উল্লেখ রয়েছে-মহানবি (সা.) কখনো বিধবা ও অভাবী লোকদের সহচর্যকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতেন না আর তাদেরকে এড়িয়েও চলতেন না। বরং তিনি তাদের অভাব মোচন করে দিতেন (মসনদ দারেমী)।

হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘হজরত রাসুল করিম (সা.) কখনো কাউকেও প্রহার করেননি- না কোনো মহিলাকে, না কোনো খাদেমকে। তবে তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছেন। যদি তিনি কখনো কারো দ্বারা কষ্ট পেতেন তবুও তিনি তার প্রতিশোধ নিতেন না। কিন্তু যখন আল্লাহর বর্ণিত পবিত্র স্থানসমূহকে অপবিত্র করা হতো, তখন তিনি আল্লাহতায়ালার জন্য এর প্রতিশোধ নিতেন’ (মুসলিম)।

হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল করিম (সা.) গোলামদের সাথে আহার করতেন এবং গম ভাঙানোর সময় গোলামরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি তাদের সাহায্য করতেন। বাজার হতে জিনিসপত্র ঘরে বহন করে নিয়ে যাওয়াকে তিনি হেয় মনে করতেন না। ধনী দরিদ্রের সঙ্গে একইভাবে মুসাফাহা (করমর্দন) করতেন। সর্বপ্রথম সালাম করতেন। তিনি কোনো নিমন্ত্রণকে অবজ্ঞা করতেন না যদিও বা সেই নিমন্ত্রণ শুধু খেজুরের হতো। তিনি দুঃখীদের পরিত্রাণ দান করতেন। তিনি কোমল হৃদয়ের অধিকারী ও দয়ালু ছিলেন। তার আচার-ব্যবহার উত্তম ছিল’ (মিশকাত)।

আল্লাহতাআলা মহানবির (সা.) মাধ্যমে ন্যায়ের তুলাদণ্ড তুলে ধরেন এবং ইনসাফ ও রহমতের শাসন কায়েম করেন। ফলে তিনি (সা.) ঘোষণা করলেন- কারো ওপরে আর জুলুম হবে না। ধর্মের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ থাকবে না, জবরদস্তি থাকবে না। নারী ও ক্রীতদাসের প্রতি যে জুলুম করা হচ্ছে, তা শেষ করা হবে এবং শয়তানের হুকুমতের স্থলে এক আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক এমনই হলো, জুলুম অত্যাচারের রাজত্বের পর দলে দলে লোকেরা রাসুল করিম (সা.)-এর আদর্শ দেখে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন।

মুসলমানদের একের পর এক বিজয় হতে লাগলো। মদিনার পৌত্তলিকরাও ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে মুসলমানদের অন্ধকার রজনী কেটে গেল, উদিত হলো নতুন সূর্যের, মক্কা মুসলমানদের অধীন চলে আসলো। অল্পদিনের মধ্যেই সারা আরবে ইসলামি পতাকা পত পত করে উড়তে থাকলো।

এত অল্প সময়ে ইসলামের বিজয়ের পিছনে কোন শক্তি কাজ করেছিল? এর পেছনে হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর মানব প্রেম ও দোয়ার বরকতেই ইসলামের বিজয় ও অন্ধকার যুগকে আলোকিত করেছিল। তাই আমরাও যদি সেই মহান রাসুলের অনুসরণ করি এবং সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করি, মানব প্রেমি হই; তাহলেই সমাজ থেকে সব অশান্তি দূর করা সম্ভব হবে। আসুন, সবাই সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ হই আর হানাহানি বন্ধ করে শ্রেষ্ঠনবির (সা.) অতুলনীয় জীবনাদর্শ অনুসরণ করে শান্তিময় সমাজ গড়ি। আল্লাহপাক আমাদেরকে এর তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

শান্তিময় সমাজ গড়তে চাই মহানবির আদর্শ অনুসরণ

আপডেট সময় : ০৮:২৬:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫

মাহমুদ আহমদ

বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে জমানায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে সময়ের মানুষ ছিল মোশরেক। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আরব ছিল একটি পরস্পর বিরোধী জাতি। তাদের মধ্যে বহু মারাত্মক পাপের প্রচলন ছিল।

মদের প্রতি সাংঘাতিকভাবে আসক্ত ছিল আরবরা। মদের নেশায় বেহুঁশ হওয়া কিংবা মাতলামি করা তাদের কাছে কোনো দূষণীয় ব্যাপারই ছিল না বরং তা প্রশংসার ব্যাপার ছিল। কোনো অভিজাত ব্যক্তির আভিজাত্যের চিত্রসমূহের মধ্যে এই চিত্র থাকারও প্রয়োজন ছিল যে, তিনি তার বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদেরকে জোর করে মদ খাওয়াবেন।

ধনী ব্যক্তিদের জন্য জরুরি ছিল, দিনে পাঁচবার মদের আসর বসানো এবং এই ধরনের আসর ছিল তাদের জাতীয় ক্রীড়া। জুয়া খেলাকে তারা বদান্যতা ও গৌরবের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। যুদ্ধের সময় তারা জুয়ার মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা সংগ্রহ করতো। সেই যুগে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। কোনো কোনো জাতির মধ্যে পিতা কর্তৃক আপন কন্যাকে হত্যা করাটা সম্মানের বিষয় ছিল।

ওই যুগে দাস প্রথা একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল। তারা আশ-পাশের গোত্রের লোকজন ধরে এনে গোলাম বানিয়ে রাখতো। গোলামদের কোনো হক বা অধিকার ছিল না। প্রত্যেক মালিক তার গোলামের সাথে যেমন খুশি ব্যবহার করতো। এতে কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা ছিল না; এমনকি হত্যা করলেও কেউ কোনো অভিযোগের সম্মুখীন হতো না।

দাসীদের সাথে যৌনাচার মালিকদের জন্য বৈধ বলে স্বীকার করা হতো। দাসীদের সন্তানরাও গোলামরূপে গণ্য হতো। নিজের ঔরসজাত সন্তানের মা হলেও দাসী দাসীই থাকতো।

‘রাসুল করিম (সা.) গোলামদের সঙ্গে আহার করতেন এবং গম ভাঙানোর সময় গোলামরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি তাদের সাহায্য করতেন। বাজার থেকে জিনিসপত্র ঘরে বহন করে নিয়ে যাওয়াকে তিনি হেয় মনে করতেন না। ধনী-গরিবের সঙ্গে একইভাবে মুসাফাহা (করমর্দন) করতেন; সর্বপ্রথম সালাম করতেন। তিনি কোনো নিমন্ত্রণকে অবজ্ঞা করতেন না- যদিও বা ওই নিমন্ত্রণ শুধু খেজুরের হতো। তিনি দুঃখীদের পরিত্রাণ দান করতেন। তিনি কোমল হৃদয়ের অধিকারী ও দয়ালু ছিলেন। তার আচার-ব্যবহার উত্তম ছিল’।

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে জন্মগ্রহণ করেন মানবতার সর্বোত্তম আদর্শ হজরত মুহাম্মদ (সা.)। বাল্যকাল থেকেই তার প্রকৃতিতে মানবের কল্যাণ করার বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হতো। মানুষের লড়াই ঝগড়ার মধ্যে তিনি কখনও নিজেকে জড়াতেন না। বরং লড়াই ও কলহ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টাই করতেন।

আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে তিনি (সা.) প্রথম কোরআনি ওহি যখন লাভ করেন, তখন হজরত খাদিজার (রা.) কাছে এলেন। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তিনি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। হজরত খাদীজা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে’? তিনি পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলেন এবং বললেন, ‘আমার মতো দুর্বল মানুষ এত বড়ো বোঝা কেমন করে বইবে?’ হজরত খাদীজা (রা.) তখন তাকে বলেছিলেন, ‘খোদার কসম!’ এই বাণী আল্লাহতায়ালা আপনার ওপর এ জন্য নাজিল করেননি যে, তিনি আপনাকে অযোগ্য ও অকৃতকার্য প্রমাণিত করবেন এবং আপনার সঙ্গ ছেড়ে দেবেন। খোদা কি কখনও এমন করতে পারেন?

আপনি তো সেই ব্যক্তি- যিনি আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে উত্তম আচরণ করেন, গরিব ও অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্য করেন, তাদের বোঝা নিজে বহন করেন। যে চরিত্র গুণ এদেশ থেকে উঠে গেছে তা সবই আপনার মাধ্যমে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আপনি অতিথির সেবাকারী, দুঃখী মানুষের সহায়তাকারী। এই রকম মানুষকে কি আল্লাহতায়ালা কখনও পরীক্ষার মধ্যে ফেলে রাখতে পারেন?

মানবতার রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা দেখুন- একবার এক জিহাদের ময়দানে উসামা বিন যায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে এক ব্যক্তির লড়াই হচ্ছিল। উসামা বিন যায়েদ লোকটিকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন এবং হত্যা করতে উদ্যত হন। এমন সময় অবিশ্বাসী লোকটি সম্পূর্ণ কলেমা নয়, বরং এর প্রথমাংশ পাঠ করে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়। তথাপি উসামা তাকে হত্যা করেন।

ঘটনাটি হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর কাছে রিপোর্ট করা হলে তিনি (সা.) উসামাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, সে ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তুমি তাকে কেন হত্যা করলে? উত্তরে উসামা বলেছিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! সে তো প্রাণের ভয়ে ইসলাম কবুল করেছিল। হজরত রাসুল করিম (সা.) তখন বলেছিলেন ‘তুমি কী তার হৃদয় ফেড়ে দেখেছিলে যে, সে সত্য সত্যই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, না প্রাণের ভয়ে এ কথা উচ্চারণ করেছিল?

রাসুল পাক (সা.) অতঃপর বলতে লাগলেন, কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে তুমি কি করে তোমার কাজকে সঠিক সাব্যস্ত করবে?

হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেন, যখন কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে তখন তুমি কী করবে? রাসুল করিম (সা.)-এর এরূপ ভয়ানক অসন্তুষ্টি দেখে উসামা ভীষণ ঘাবড়ে যান। আর হজরত রাসুল পাক (সা.) তখনো ওই কথাই বারবার বলছিলেন যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যখন তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে, তখন তুমি কি করবে? উসামা পরে বলেছিলেন, ‘হায়! আমি যদি এই ঘটনার পরে ইসলাম গ্রহণ করতাম।’

ওই ঘটনা এবং আরো নানা ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বলপূর্বক মুসলমান বানানো ইসলামি ‘জিহাদের উদ্দেশ্য কখনই ছিল না এবং সে যুগে বলপূর্বক কাউকে মুসলমান করাও হয়নি, কোনো যুদ্ধ বন্দিকেও না। ইসলাম কখনো তরবারির দ্বারা প্রসার লাভ করেনি, ইসলাম প্রসার লাভ করেছে হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর উন্নত আদর্শ, মানব প্রেম, তবলিগ ও ক্ষমার দৃষ্টান্তের মাধ্যমে।

হাদিসে উল্লেখ রয়েছে-মহানবি (সা.) কখনো বিধবা ও অভাবী লোকদের সহচর্যকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতেন না আর তাদেরকে এড়িয়েও চলতেন না। বরং তিনি তাদের অভাব মোচন করে দিতেন (মসনদ দারেমী)।

হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘হজরত রাসুল করিম (সা.) কখনো কাউকেও প্রহার করেননি- না কোনো মহিলাকে, না কোনো খাদেমকে। তবে তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছেন। যদি তিনি কখনো কারো দ্বারা কষ্ট পেতেন তবুও তিনি তার প্রতিশোধ নিতেন না। কিন্তু যখন আল্লাহর বর্ণিত পবিত্র স্থানসমূহকে অপবিত্র করা হতো, তখন তিনি আল্লাহতায়ালার জন্য এর প্রতিশোধ নিতেন’ (মুসলিম)।

হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল করিম (সা.) গোলামদের সাথে আহার করতেন এবং গম ভাঙানোর সময় গোলামরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি তাদের সাহায্য করতেন। বাজার হতে জিনিসপত্র ঘরে বহন করে নিয়ে যাওয়াকে তিনি হেয় মনে করতেন না। ধনী দরিদ্রের সঙ্গে একইভাবে মুসাফাহা (করমর্দন) করতেন। সর্বপ্রথম সালাম করতেন। তিনি কোনো নিমন্ত্রণকে অবজ্ঞা করতেন না যদিও বা সেই নিমন্ত্রণ শুধু খেজুরের হতো। তিনি দুঃখীদের পরিত্রাণ দান করতেন। তিনি কোমল হৃদয়ের অধিকারী ও দয়ালু ছিলেন। তার আচার-ব্যবহার উত্তম ছিল’ (মিশকাত)।

আল্লাহতাআলা মহানবির (সা.) মাধ্যমে ন্যায়ের তুলাদণ্ড তুলে ধরেন এবং ইনসাফ ও রহমতের শাসন কায়েম করেন। ফলে তিনি (সা.) ঘোষণা করলেন- কারো ওপরে আর জুলুম হবে না। ধর্মের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ থাকবে না, জবরদস্তি থাকবে না। নারী ও ক্রীতদাসের প্রতি যে জুলুম করা হচ্ছে, তা শেষ করা হবে এবং শয়তানের হুকুমতের স্থলে এক আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক এমনই হলো, জুলুম অত্যাচারের রাজত্বের পর দলে দলে লোকেরা রাসুল করিম (সা.)-এর আদর্শ দেখে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন।

মুসলমানদের একের পর এক বিজয় হতে লাগলো। মদিনার পৌত্তলিকরাও ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে মুসলমানদের অন্ধকার রজনী কেটে গেল, উদিত হলো নতুন সূর্যের, মক্কা মুসলমানদের অধীন চলে আসলো। অল্পদিনের মধ্যেই সারা আরবে ইসলামি পতাকা পত পত করে উড়তে থাকলো।

এত অল্প সময়ে ইসলামের বিজয়ের পিছনে কোন শক্তি কাজ করেছিল? এর পেছনে হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর মানব প্রেম ও দোয়ার বরকতেই ইসলামের বিজয় ও অন্ধকার যুগকে আলোকিত করেছিল। তাই আমরাও যদি সেই মহান রাসুলের অনুসরণ করি এবং সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করি, মানব প্রেমি হই; তাহলেই সমাজ থেকে সব অশান্তি দূর করা সম্ভব হবে। আসুন, সবাই সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ হই আর হানাহানি বন্ধ করে শ্রেষ্ঠনবির (সা.) অতুলনীয় জীবনাদর্শ অনুসরণ করে শান্তিময় সমাজ গড়ি। আল্লাহপাক আমাদেরকে এর তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ