আফজাল হোসেন
আমাদের দুটো করে মাথা। একটাকে লোকে দেখতে পায়- আর একটা থাকে লুকানো। দেখা যায় না। যো দেখা যায়, তাকে নিয়ে মানুষ কাজ করে, ঘোরে, বসে, শোয়, স্বপ্ন দেখে, প্রার্থনা করে, সম্পর্ক বানায়, ভুল ও ঠিক বাছাবাছি ইত্যাদি অনেক কিছু করে। মোটকথা সে ই জীবন যাপন করায়। তাহলে দ্বিতীয় মস্তক কেনো?
দুই নম্বর মাথাটা জানে, সে মানুষের। মানুষই তার মালিক- কিন্তু তাকে দেখা যায় না। সে গোপন মাথা- এ জন্য তার গৌরব আছে আবার আসলটা নয় বলে আছে অনেক রাগ। ভাবে, দুই নম্বর তাতে কি, আমিও তো একটা মাথা। দেখতে পাওয়া মাথাটা যদি সকল কাজের কাজি হয়- আমি কি অযথা, আমি দামহীন? রেগেমেগে ঠিক করে, দেখিয়ে দিতে হবে- কে বেশী দামী, কার কতো জোর!
অদৃশ্য মাথাটার প্রাণপন চেষ্টা বিশেষ হতে হবে। দ্রুত বিশেষ হয়ে ওঠার জন্য বেছে নেয় সহজ পথ। একেবারে আদি অকৃত্রিম বাঙালি স্বভাব। বিশেষ হওয়ার শত উপায় থাকা সত্ত্বেও বহু অলস বাঙালির ঝোঁক শর্টকাট, সহজের দিকেই।
বিশেষ হয়ে উঠতে আজব আজব কাণ্ড-কারবারের কথা অনেকের জানা। তারা এক জেলার নামে সাতা সমিতি বানায়। এক সমিতিতে বিশেষ হওয়া যায়নি বলে আর এক সমিতি বানিয়ে হয়ে যায় বিশেষ। আরও একদল বিশেষ হয়ে উঠতে চায় বলে বানিয়ে ফেলে আর একটা সমিতি। এইভাবে ডিম ফুটে বেরুতেই থাকে সমিতির বাচ্চা কাচ্চা। শুধু সমিতি নয়, এই বিশিষ্টপ্রেমীরা নানা দিকে নজর রাখে- খোঁজে, কোথায়, কোন ডালে বসে আছে সুবর্ণ সুযোগেরা।
ধর্ম পালনের বেলাতেও অদৃশ্য বা দ্বিতীয় মস্তকের ভূমিকা রয়েছে। হয়তো বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে একটা মসজিদ। মসজিদ মানে আল্লাহর ঘর কিন্তু যে বান্দা দ্বিতীয় মস্তকের খপ্পরে পড়ে গেছে, তার মনে ঘুরতে থাকে অন্য কথা- পরের জমিতে, তার বাড়ির কাছে বানানো মসজিদে নামাজ পড়তে যাবে তুমি? মান ইজ্জতের দফারফা হয়ে যাবে। নিজেকে বড় বানাও। বানিয়ে ফেলো বাড়ির কাছে নিজের মসজিদ। বিশেষ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করোনা, করা উচিৎ হবে না হে। অদৃশ্য মস্তকের নিরন্তর উস্কানি এড়াতে পারে না মানুষ।
বিশেষ হয়ে ওঠার জন্য মানুষ মানুষের জীবননাশও করে। খাদ্যে বিষ মেশায়, নকল অষুধ বানায়, মৃতেরও চিকিৎসা করা হয়েছে বলে টাকা আদায় করে। যে কোনো প্রতারণা করে অনেক টাকার মালিক হতে চায় একদল। তারা বিশ্বাস করে টাকা বড় বানাতে পারে, সমাজের বিশেষ মানুষ বানিয়ে দেবে।
মানুষের মানুষ হিসাবে যা করণীয়, অদৃশ্য মাথাটার কুটিল জটিল বুদ্ধিতে তারা চলে বলে আর করে উল্টোটা।
বহুকাল থেকেই অদৃশ্য বা দুই নম্বর মাথার খায়েশ- মানুষকে নিজের মতো নিয়ন্ত্রণ করবে। মানুষের মনস্তত্ত্ব সে ভালো বোঝে। জানে, সরল আনন্দ নয়; মানুষ চায় অদ্ভুত আনন্দ। স্বাভাবিক, সুন্দরে তাদের মন ভরে না- তাদের দেহ ও মন চায় বিশেষ আকর্ষণ, অধিক উত্তেজনা। দ্বিতীয় মস্তক তুড়িতে তুড়িতে অবিরত সরবরাহ করে চলে সেসবই- যা যা আকর্ষণীয়, অদ্ভুত, উত্তেজনাপূর্ণ।
মানুষ এখন আলাপে আগ্রহী নয়, তর্কেও নয়; আগ্রহ, উৎসাহ হামলে পড়ায়। সমালোচনা বলতে বোঝে, কে কতটা হিংস্র তার প্রমাণ দিতে পারা। বিরোধিতা বলতে বোঝে দৈহিক আক্রমণ। ভিন্নমত মানে, চরম শত্রু খুঁজে পাওয়া।
দ্বিতীয় মস্তকের সর্বনাশা “ফুঁ” কোথায় নেই! মানুষ রোজ বিনোদন হিসাবে রাজনীতি দেখে, ধর্মকথা শোনে- সেসব নিত্যই নিয়ম করে দেখানো, শোনানো ও গেলানো হয়। সর্বনাশা “ফুঁ” য়ে সমগ্র গণমাধ্যম সদা সর্বদাই মহাউত্তেজনাপূর্ণ।
দ্বিতীয় মস্তক বলে, দেখো। মানুষ দেখে। প্রাণভরে দেখে, শোনে মানুষের নিন্দা মন্দ, নারীর চরিত্র নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া, আপত্তিকর এবং অশোভন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। কদর্য কুৎসিত যত কিছু আছে- সবই অন্ধকার থেকে উল্লাস করে টেনেহিঁচড়ে আনা হচ্ছে আলোতে।
দ্বিতীয় মস্তকের পাগলা ঘোড়া দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আসল মাথাটা এইসব দেখে হতবাক, দিশেহারা। বুঝতে পারছে, সে শক্ত হয়ে বসে আছে ঘাড়ের উপরে কিন্তু তাকে ভুলে প্রবল উৎসাহে দ্বিতীয় মাথার কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে মানুষ।
মানুষের সাথে শয়তানকেও পাঠানো হয় পৃথিবীতে। শয়তানের ছায়া নেই। ছায়া নেই বলে তার মায়াও নেই। মানুষের ছায়াতে আমরা কেবল একটা মাথাকেই দেখতে পাই। যোকে দেখা যায় না সেটাই চাবুক মেরে হুকুম করছে- হাট হাট। হুকুমে দৌড়াচ্ছে মানুষ।
মানুষ হওয়ার গৌরব বুঝলাম না- শয়তানের ঘোড়া হওয়া কি অধিক আনন্দ ও উত্তেজনাপূর্ণ?
লেখক: অভিনেতা, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা
(বানানরীতি ও মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ