ঢাকা ০১:২৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শব্দদূষণ: জাতিগতভাবে শীর্ষে থাকার কালিমা ঘোচাতেই হবে

  • আপডেট সময় : ১০:৪৬:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ মে ২০২২
  • ১১৪ বার পড়া হয়েছে

বিধান চন্দ্র পাল : শব্দদূষণের বিষয়টি পরিবেশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। শব্দ সহনীয় মাত্রায় থাকলে সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে। আর শব্দ অসহনীয় মাত্রার হয়ে গেলে সেটা পরিবেশকে দূষিত, অতিষ্ঠ এবং মানুষ ও প্রাণীর অবস্থানের অর্থাৎ বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলবে। শব্দদূষণ বিষয়টির সাথে মানুষের স্বাস্থ্যেরও ঘনিষ্ঠ সংশ্লেষ রয়েছে।
বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণে এই বছরের জানুয়ারি মাসেও বায়ুদূষণে ঢাকা বিশ্বের এক নম্বর স্থানে ছিল। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) শব্দদূষণ নিয়ে সম্প্রতি (মার্চ, ২০২২) এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের ৬১টি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে শব্দদূষণ সবচেয়ে বেশি হয় ঢাকায়। অর্থাৎ শব্দদূষণেও ঢাকা শীর্ষে। এই খবর নতুন করে কম-বেশি সবার মাঝেই উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

উদ্বেগের বড় কারণ, শব্দ এখন দূষণের পর্যায়ে চলে গেছে। অর্থাৎ দূষণের সংজ্ঞা অনুসারে শব্দ এখন পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। শব্দদূষণের কারণে মানুষের অকালমৃত্যু ঘটছে। শব্দদূষণের কারণে হৃদরোগীর তালিকায় নতুন করে অনেক নাম যুক্ত হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো এ বিষয়গুলো আমাদের দেশেও ঘটছে বলেই আমি অনুমান করি। ফলে আমার ধারণা, এ বিষয়গুলো নিয়ে যদি নির্ভরযোগ্য গবেষণা পরিচালনা করা যায় তাহলে এর প্রকৃত একটি চিত্র উঠে আসবে এবং যা বের করে আনাটা এখন খুবই জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) ১৯৯৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী, মানুষের জন্য ঘরের ভেতরে শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবল। ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। অবশ্য ২০১৮ সালের হালনাগাদ নির্দেশিকায় সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালাতেও একই মাত্রাকে সহনীয় বা সর্বোচ্চ মাত্রা হিসেবে ধরা হয়েছে। অথচ ঢাকার এ মাত্রা ১১৯ ডেসিবল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবল।
শব্দদূষণের প্রধান উৎস হলো সড়কে যানজটের সময়ে যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, উড়োজাহাজ, ট্রেন, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কর্মকা-ে সৃষ্ট শব্দ। এসব শব্দ মানমাত্রার চেয়ে বেশি হলেই সেটা মানুষের শরীরের জন্য ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
প্রসঙ্গত, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, পুরো দেশেই শব্দদূষণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে। যানজটের শব্দের পাশাপাশি নির্মাণ কাজের শব্দ, উচ্চস্বরে মাইক বাজানো হয়ে থাকে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবল বা তার বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। উন্নত বিশ্বের অনেক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চ শব্দ মানুষের ঘুমেও সমস্যা তৈরি করে। উচ্চ শব্দে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও উদ্বেগজনিত সমস্যা হয়ে থাকে। দিনের পর দিন শব্দদূষণের শিকার শিশুদের মনোযোগ রাখার ক্ষমতা এমনকি কোনো কিছু পড়ার ক্ষমতাও হ্রাস পেতে পারে।
রাস্তায় বের হলে ঢাকা শহরের শব্দদূষণের মাত্রা কতটা ভয়াবহ তা যে কেউ সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে। এছাড়া আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি যে, গত ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে উচ্চ শব্দের কারণে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে অভিযোগ করার হার ১৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। বছরজুড়ে রাতে গান-বাজনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান, নির্মাণকাজ, পটকা, ডিজে পার্টি, আতশবাজি ইত্যাদির কারণে শিশু, পরীক্ষার্থী, বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষদের সমস্যা হচ্ছে, এছাড়া কম-বেশি সবারই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে।
আমরা জানি যে, ২০০৬ সালে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা জারি করা হয়েছে। সেই বিধি অনুযায়ী, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা ও সেইসঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা আইনত দ-নীয়। কিন্তু সেই আইনের কোনো প্রয়োগই নেই, স্বাভাবিকভাবেই দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদাহরণও আমরা দেখতে পাই না। ফলে ঢাকায় বসবাসকারীসহ যারাই নিয়মিতভাবে ঢাকায় বিভিন্ন কারণে যাতায়াত করছেন অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি বিশেষভাবে শব্দদূষণের কারণে তারাই মাত্রাতিরিক্ত হারে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু কর্মকা- পরিচালনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। যেমন, উন্মুক্ত স্থানে ইট ভাঙার যন্ত্র চালানো যাবে না। উচ্চ শব্দ হয় এমনভাবে ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করা থেকে শুরু করে টাইলস কাটার বিকট শব্দও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নির্দেশনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে, এসব নির্দেশনা ঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের।

ইউএনইপি-এর প্রতিবেদনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশি শব্দ তৈরি করে এমন যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে কাজ করা এবং সামাজিক বা বিনোদমূলক অনুষ্ঠানে শব্দ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে।
অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ট্রাফিক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ধরনের দূষণের পরিমাপ দেখে সাধারণত অনুমান করা হয়ে থাকে কোন শহর কতটুকু বাসযোগ্য। ফলে শব্দদূষণ থেকে নিস্তার পেতে হলে আমাদেরকে একদিকে আইন মেনে চলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, অন্যদিকে মানসিকতার পরিবর্তন করাটাও জরুরি হবে। যাতে আমাদের দেশের নাগরিকরা যখন বিদেশে যান কিংবা দেশের ভেতরেই ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করেন তখন এক ধরনের আচরণ আর অন্যান্য স্থানে আচরণ যাতে ভিন্ন না হয়।
অনেকে নিজের বাসায়, শপিংমলের বিভিন্ন দোকানে বিশেষভাবে ইলেক্ট্রনিক্স দোকানগুলোতে, কমিউনিটি সেন্টারে, বাসার ছাদে কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে উচ্চ স্বরে গান বাজানোকে কোনো অপরাধই মনে করেন না। এর প্রতিবাদ বা প্রতিকার চাইতে গেলে আবার উল্টো হেনস্তার শিকার হতে আমরা দেখেছি। রাজধানীতে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শুধু মারধর নয়, মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। অর্থাৎ শব্দদূষণ যে একটি বড় অপরাধ তা জনমনে প্রতিষ্ঠা করাটাই এখন মূখ্য করণীয় হবে। এজন্য শব্দদূষণের বিষয়ে জরুরিভিত্তিতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে প্রতিকারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। একটি সর্বাত্মক কর্মসূচি গ্রহণের কথাও গুরুত্ব সহকারে এজন্য ভাবা যেতে পারে।
ঢাকাসহ যেকোনো শহরের শব্দদূষণ কমাতে নাগরিক সচেতনতা বিশেষভাবে জরুরি। বিশেষ করে যথেচ্ছাচারে যানবাহনের হর্ন বাজানো বন্ধ করতে হবে। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৮৮ ধারা অনুযায়ী, উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজালে অনধিক ৩ মাসের কারাদ- বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। অযথা হর্ন বাজানো বন্ধে পুলিশের ভূমিকা এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করা নেই ফলে সদিচ্ছা থাকলেও পুলিশ এক্ষেত্রে কিছুই করতে পারে না। সুতরাং সেটা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন।
পাশাপাশি আমার মনে হয়, প্যারিসের মতো ঢাকার রাস্তায় সড়কবাতির ওপরে যদি রাডার লাগানোর ব্যবস্থা করা যেত তাহলে হয়তো ভালো হতো। যে রাডারের মাধ্যমে রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে তা যদি সীমা অতিক্রম করে তাহলে গাড়ির লাইসেন্স প্লেট সেটি শনাক্ত করে রাখতে পারে। ফলে পরবর্তী সময়ে জরিমানা ধার্য করে তা খুব সহজেই কার্যকরও করা যেতে পারে।
সর্বোপরি গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করে হর্নের বড় উৎস প্রাইভেট গাড়ি এবং মোটরসাইকেলের বৃদ্ধি ও ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। শব্দদূষণের কারণে সামগ্রিকভাবে আমাদের কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, কোন বয়সী মানুষের কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি শব্দদূষণের কারণে কর্মক্ষমতাও কমে যাচ্ছে কিনা এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়মিতভাবে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। যাতে গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করে ওই অনুসারে শব্দদূষণ বন্ধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়। পরিশেষে, স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা এক জিনিস নয়। রাতে ঘুমের সমস্যা, ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষায় ব্যাঘাত, নাগরিক স্বাস্থ্যহানিসহ অন্যের নানা ধরনের গুরুতর অসুবিধার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে খেয়াল ও খুশিমতো শব্দদূষণ করাটা অনেক বড় অপরাধ, এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতাও বটে। সেই স্বেচ্ছাচারিতা প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছে– যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। ফলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ, গবেষণা, ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি এবং আইনের যথাযথ ও কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে জাতিগতভাবে শীর্ষে থাকার কালিমা ঘুচাতে আমরা সমর্থ হব– সেটাই আমার মতো অন্য সবারই আন্তরিক প্রত্যাশা!
লেখক : গবেষক ও সংস্কৃতিকর্মী। প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রভা অরোরা এবং সদস্য, নির্বাহী পরিষদ, নগর গবেষণা কেন্দ্র (সিইউএস, ঢাকা)।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সুপার ফোরের শুভযাত্রা বাংলাদেশের

শব্দদূষণ: জাতিগতভাবে শীর্ষে থাকার কালিমা ঘোচাতেই হবে

আপডেট সময় : ১০:৪৬:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ মে ২০২২

বিধান চন্দ্র পাল : শব্দদূষণের বিষয়টি পরিবেশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। শব্দ সহনীয় মাত্রায় থাকলে সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে। আর শব্দ অসহনীয় মাত্রার হয়ে গেলে সেটা পরিবেশকে দূষিত, অতিষ্ঠ এবং মানুষ ও প্রাণীর অবস্থানের অর্থাৎ বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলবে। শব্দদূষণ বিষয়টির সাথে মানুষের স্বাস্থ্যেরও ঘনিষ্ঠ সংশ্লেষ রয়েছে।
বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণে এই বছরের জানুয়ারি মাসেও বায়ুদূষণে ঢাকা বিশ্বের এক নম্বর স্থানে ছিল। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) শব্দদূষণ নিয়ে সম্প্রতি (মার্চ, ২০২২) এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের ৬১টি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে শব্দদূষণ সবচেয়ে বেশি হয় ঢাকায়। অর্থাৎ শব্দদূষণেও ঢাকা শীর্ষে। এই খবর নতুন করে কম-বেশি সবার মাঝেই উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

উদ্বেগের বড় কারণ, শব্দ এখন দূষণের পর্যায়ে চলে গেছে। অর্থাৎ দূষণের সংজ্ঞা অনুসারে শব্দ এখন পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। শব্দদূষণের কারণে মানুষের অকালমৃত্যু ঘটছে। শব্দদূষণের কারণে হৃদরোগীর তালিকায় নতুন করে অনেক নাম যুক্ত হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো এ বিষয়গুলো আমাদের দেশেও ঘটছে বলেই আমি অনুমান করি। ফলে আমার ধারণা, এ বিষয়গুলো নিয়ে যদি নির্ভরযোগ্য গবেষণা পরিচালনা করা যায় তাহলে এর প্রকৃত একটি চিত্র উঠে আসবে এবং যা বের করে আনাটা এখন খুবই জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) ১৯৯৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী, মানুষের জন্য ঘরের ভেতরে শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবল। ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। অবশ্য ২০১৮ সালের হালনাগাদ নির্দেশিকায় সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালাতেও একই মাত্রাকে সহনীয় বা সর্বোচ্চ মাত্রা হিসেবে ধরা হয়েছে। অথচ ঢাকার এ মাত্রা ১১৯ ডেসিবল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবল।
শব্দদূষণের প্রধান উৎস হলো সড়কে যানজটের সময়ে যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, উড়োজাহাজ, ট্রেন, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কর্মকা-ে সৃষ্ট শব্দ। এসব শব্দ মানমাত্রার চেয়ে বেশি হলেই সেটা মানুষের শরীরের জন্য ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
প্রসঙ্গত, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, পুরো দেশেই শব্দদূষণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে। যানজটের শব্দের পাশাপাশি নির্মাণ কাজের শব্দ, উচ্চস্বরে মাইক বাজানো হয়ে থাকে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবল বা তার বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। উন্নত বিশ্বের অনেক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চ শব্দ মানুষের ঘুমেও সমস্যা তৈরি করে। উচ্চ শব্দে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও উদ্বেগজনিত সমস্যা হয়ে থাকে। দিনের পর দিন শব্দদূষণের শিকার শিশুদের মনোযোগ রাখার ক্ষমতা এমনকি কোনো কিছু পড়ার ক্ষমতাও হ্রাস পেতে পারে।
রাস্তায় বের হলে ঢাকা শহরের শব্দদূষণের মাত্রা কতটা ভয়াবহ তা যে কেউ সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে। এছাড়া আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি যে, গত ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে উচ্চ শব্দের কারণে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে অভিযোগ করার হার ১৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। বছরজুড়ে রাতে গান-বাজনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান, নির্মাণকাজ, পটকা, ডিজে পার্টি, আতশবাজি ইত্যাদির কারণে শিশু, পরীক্ষার্থী, বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষদের সমস্যা হচ্ছে, এছাড়া কম-বেশি সবারই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে।
আমরা জানি যে, ২০০৬ সালে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা জারি করা হয়েছে। সেই বিধি অনুযায়ী, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা ও সেইসঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা আইনত দ-নীয়। কিন্তু সেই আইনের কোনো প্রয়োগই নেই, স্বাভাবিকভাবেই দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদাহরণও আমরা দেখতে পাই না। ফলে ঢাকায় বসবাসকারীসহ যারাই নিয়মিতভাবে ঢাকায় বিভিন্ন কারণে যাতায়াত করছেন অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি বিশেষভাবে শব্দদূষণের কারণে তারাই মাত্রাতিরিক্ত হারে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু কর্মকা- পরিচালনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। যেমন, উন্মুক্ত স্থানে ইট ভাঙার যন্ত্র চালানো যাবে না। উচ্চ শব্দ হয় এমনভাবে ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করা থেকে শুরু করে টাইলস কাটার বিকট শব্দও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নির্দেশনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে, এসব নির্দেশনা ঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের।

ইউএনইপি-এর প্রতিবেদনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশি শব্দ তৈরি করে এমন যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে কাজ করা এবং সামাজিক বা বিনোদমূলক অনুষ্ঠানে শব্দ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে।
অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ট্রাফিক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন ধরনের দূষণের পরিমাপ দেখে সাধারণত অনুমান করা হয়ে থাকে কোন শহর কতটুকু বাসযোগ্য। ফলে শব্দদূষণ থেকে নিস্তার পেতে হলে আমাদেরকে একদিকে আইন মেনে চলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, অন্যদিকে মানসিকতার পরিবর্তন করাটাও জরুরি হবে। যাতে আমাদের দেশের নাগরিকরা যখন বিদেশে যান কিংবা দেশের ভেতরেই ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করেন তখন এক ধরনের আচরণ আর অন্যান্য স্থানে আচরণ যাতে ভিন্ন না হয়।
অনেকে নিজের বাসায়, শপিংমলের বিভিন্ন দোকানে বিশেষভাবে ইলেক্ট্রনিক্স দোকানগুলোতে, কমিউনিটি সেন্টারে, বাসার ছাদে কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে উচ্চ স্বরে গান বাজানোকে কোনো অপরাধই মনে করেন না। এর প্রতিবাদ বা প্রতিকার চাইতে গেলে আবার উল্টো হেনস্তার শিকার হতে আমরা দেখেছি। রাজধানীতে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শুধু মারধর নয়, মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। অর্থাৎ শব্দদূষণ যে একটি বড় অপরাধ তা জনমনে প্রতিষ্ঠা করাটাই এখন মূখ্য করণীয় হবে। এজন্য শব্দদূষণের বিষয়ে জরুরিভিত্তিতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে প্রতিকারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। একটি সর্বাত্মক কর্মসূচি গ্রহণের কথাও গুরুত্ব সহকারে এজন্য ভাবা যেতে পারে।
ঢাকাসহ যেকোনো শহরের শব্দদূষণ কমাতে নাগরিক সচেতনতা বিশেষভাবে জরুরি। বিশেষ করে যথেচ্ছাচারে যানবাহনের হর্ন বাজানো বন্ধ করতে হবে। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৮৮ ধারা অনুযায়ী, উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজালে অনধিক ৩ মাসের কারাদ- বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ। অযথা হর্ন বাজানো বন্ধে পুলিশের ভূমিকা এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করা নেই ফলে সদিচ্ছা থাকলেও পুলিশ এক্ষেত্রে কিছুই করতে পারে না। সুতরাং সেটা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন।
পাশাপাশি আমার মনে হয়, প্যারিসের মতো ঢাকার রাস্তায় সড়কবাতির ওপরে যদি রাডার লাগানোর ব্যবস্থা করা যেত তাহলে হয়তো ভালো হতো। যে রাডারের মাধ্যমে রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে তা যদি সীমা অতিক্রম করে তাহলে গাড়ির লাইসেন্স প্লেট সেটি শনাক্ত করে রাখতে পারে। ফলে পরবর্তী সময়ে জরিমানা ধার্য করে তা খুব সহজেই কার্যকরও করা যেতে পারে।
সর্বোপরি গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করে হর্নের বড় উৎস প্রাইভেট গাড়ি এবং মোটরসাইকেলের বৃদ্ধি ও ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। শব্দদূষণের কারণে সামগ্রিকভাবে আমাদের কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, কোন বয়সী মানুষের কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি শব্দদূষণের কারণে কর্মক্ষমতাও কমে যাচ্ছে কিনা এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়মিতভাবে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। যাতে গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করে ওই অনুসারে শব্দদূষণ বন্ধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়। পরিশেষে, স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা এক জিনিস নয়। রাতে ঘুমের সমস্যা, ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষায় ব্যাঘাত, নাগরিক স্বাস্থ্যহানিসহ অন্যের নানা ধরনের গুরুতর অসুবিধার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে খেয়াল ও খুশিমতো শব্দদূষণ করাটা অনেক বড় অপরাধ, এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতাও বটে। সেই স্বেচ্ছাচারিতা প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছে– যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। ফলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ, গবেষণা, ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি এবং আইনের যথাযথ ও কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে জাতিগতভাবে শীর্ষে থাকার কালিমা ঘুচাতে আমরা সমর্থ হব– সেটাই আমার মতো অন্য সবারই আন্তরিক প্রত্যাশা!
লেখক : গবেষক ও সংস্কৃতিকর্মী। প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রভা অরোরা এবং সদস্য, নির্বাহী পরিষদ, নগর গবেষণা কেন্দ্র (সিইউএস, ঢাকা)।