নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তারের মধ্যে দেশে গত এক দিনে আরও ৯ হাজার ৫০০ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। একদিনে এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল সর্বশেষ গত বছরের ১২ আগস্ট, সেদিন ১০ হাজার ১২৬ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল।
গতকাল বুধবার নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ১১ শতাংশে, যার মানে হল, প্রতি চারজনের নমুনা পরীক্ষায় একজন কোভিড রোগী পাওয়া গেছে
দৈনিক শনাক্ত রোগীর এই হার গতবছরের ১৩ আগস্টের পর সর্বোচ্চ। সেদিন শনাক্তের হার ছিল ২৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪২ হাজার ২৯৪ জনে। তাদের মধ্যে ২৮ হাজার ১৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গত মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩৫ হাজার ৫৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৮ হাজার ৪০৭ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। সে হিসাবে গত একদিনে রোগী বেড়েছে ১ হাজার ৯৩ জন, যা আগের দিনের চেয়ে ১৩ শতাংশের বেশি। সরকারি হিসাবে গত এক দিনে দেশে সেরে উঠেছেন ৪৭৩ জন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ২৬৮ জন সুস্থ হয়ে উঠলেন। এই হিসাবে দেশে এখন সক্রিয় কোভিড রোগীর সংখ্যা ৫৯ হাজার ৮৫০ জন। অর্থাৎ এই সংখ্যক রোগী নিশ্চিতভাবে সংক্রমিত অবস্থায় রয়েছে। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার ৮৪৫ জন। ১০ জানুয়ারি ছিল ১৬ হাজার ৭১৩ জন হয়।
২২৮ শতাংশ রোগী বেড়েছে এক সপ্তাহে: দেশে আগের সপ্তাহের তুলনায় গত এক সপ্তাহে করোনা রোগী বেড়েছে ২২৮ শতাংশ। এ সময় (১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি) করোনায় সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু বেড়েছে ১৮৫ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বুধবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চ্যুয়াল বুলেটিনে সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেন অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম। বুলেটিনে জানানো হয়, গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে ২৭ শতাংশের বেশি পরীক্ষা বেড়েছে। সাত দিনে ২ লাখ ৩ হাজার ১২২টি পরীক্ষা হয়েছে। রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩৪ হাজার ৪০৫ জন। এর আগের সপ্তাহের তুলনায় গত সাত দিনে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার রোগী বেশি শনাক্ত হয়েছে। আগের সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে ২২৮ শতাংশ রোগী বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে করোনায় সংক্রমিত ৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা আগের সপ্তাহের চেয়ে ৩৭ জন বেশি। শনাক্ত, পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বেশিসংখ্যক মানুষ করোনায় সংক্রমিত হচ্ছে। অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনা শনাক্ত বাড়লেও হাসপাতালে করোনা রোগী বাড়েনি। তবে এতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বেশি সংক্রমণ হচ্ছে করোনার অমিক্রন ধরনের। পাশের দেশেও অমিক্রন বেশি ছড়াচ্ছে। সাধারণত কোনো নতুন ভেরিয়েন্ট (ধরন) এলে সেটি পুরোনো ধরনকে প্রতিস্থাপন করে। তবে এখন পর্যন্ত দেশে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে করোনার ডেলটার ধরনই বেশি ছড়াচ্ছে। গত বছর করোনার ডেলটা ধরনের তা-ব দেখা গেছে। তাই অসতর্ক হওয়ার সুযোগ নেই। ঢাকা ও রাঙামাটির পর আরও ১০ জেলাকে করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া মধ্যম ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে ৩২ জেলা। আর এখন পর্যন্ত ঝুঁকিমুক্ত ১৬ জেলা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত এক সপ্তাহের তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানিয়েছে। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার যে বিষয়টি বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে বর্তমান যে করোনা ব্যবস্থাপনা, তার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এটি একেবারেই প্রশাসনিক বিষয়। অধিদপ্তরের কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়। কোনো জেলাকে নির্দিষ্ট করা হয়নি। জেলায় পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের সংখ্যাকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে। এই পরিসংখ্যান কোনো সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে না।
মহামারীর বছর গড়ানোর পর ডেল্টার দাপটে বাংলাদেশে দিনে রোগী শনাক্তের হার ৩২ শতাংশে উঠেছিল ২০২১ সালে। তবে এরপর সংক্রমণের হার কমতে কমতে নেমেছিল ২ শতাংশের নিচে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু এরমধ্যেই বিশ্বে শুরু হয় ওমিক্রনের ত্রাস। জানুয়ারির শুরু থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। ১২ জানুয়ারি যেখানে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা তিন হাজারের নিচে ছিল, সাত দিনের মাথায় তা বেড়ে তিন গুণের বেশি হল। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক আহমেদ মনে করেন, একদিনে ৩০ থেকে ৫০ হাজার রোগী শনাক্তেরও আশঙ্কা আছে, যদি যথেষ্ট পরিমাণে নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের মধ্যে গতবছর আগস্টে এক দিনে ৫০ হাজারের বেশি নমুনাও পরীক্ষা হয়েছিল। সেখানেব গত এক দিনে পরীক্ষা হয়েছে ৩৮ হাজারের মত।
মহামারীর পুরো সময়ে পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৭২ শতাংশ।
গত এক দিনে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৬ হাজার ৯৫২ জনই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৭৩ শতাংশের বেশি। মেহেরপুর আর নড়াইল ছাড়া দেশের বাকি ৬২ জেলাতেই নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।
সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনায় দেশের জেলাগুলোকে উচ্চ, মাঝারি ও স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ভাগ করে যথাক্রমে রেড বা লাল, ইয়েলো বা হলুদ ও গ্রিন বা সবুজ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ ১২ জেলাকে উচ্চ ঝুঁকির লাল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর মাঝারি ঝুঁকির হলুদ এলাকায় রয়েছে ৩১ জেলা
গত এক দিনে যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ১০ জন পুরুষ, ২ জন নারী। তাদের ৮ জন ছিলেন ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা। ২ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ১ জন খুলনা রাজশাহী এবং ১ জন সিলেট বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। তাদের মধ্যে ৬ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি, ৬ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ছিল। আটজন সরকারি হাসপাতালে, তিনজন বেসরকারি হাসপাতালে এবং একজন বাসায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এ বছর ১২ জানুয়ারি তা ১৬ লাখ পেরিয়ে যায়। তার আগে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক বিস্তারের মধ্যে গত বছরের ২৮ জুলাই দেশে রেকর্ড ১৬ হাজার ২৩০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ২০২০ সালের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত বছর ৫ ডিসেম্বর কোভিডে মোট মৃত্যু ২৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তার আগে ৫ অগাস্ট ও ১০ অগাস্ট ২৬৪ জন করে মৃত্যুর খবর আসে, যা মহামারীর মধ্যে এক দিনের সর্বোচ্চ সংখ্যা। বিশ্বে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫৫ লাখ ৫৬ হাজার ছাড়িয়েছে। আর শনাক্ত হয়েছে ৩৩ কোটি ৪৩ লাখের বেশি রোগী।
শনাক্তের হার ২৫% ছাড়াল, একদিনে সাড়ে ৯ হাজার
ট্যাগস :
শনাক্তের হার ২৫% ছাড়াল
জনপ্রিয় সংবাদ