অর্থনৈতিক প্রতিবেদক : রংপুর অঞ্চলের গৌরবময় ঐতিহ্য শতরঞ্জি ২০২০ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি)। সেই অর্জন উদযাপন করতে বর্ণিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করল ‘কারুপণ্য’। ঢাকার শুক্রাবাদের নন্দিনী ভবনে এই আয়োজনে ‘শতরঞ্জি’র নতুন প্রদর্শনী কেন্দ্রেরও উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ও চিত্রশিল্পী তরুণ ঘোষ। স্বাগত বক্তব্য দেন কারুপণ্যের উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিম। অনুষ্ঠানে শিল্পীরা রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গান পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে শতরঞ্জির ঐতিহ্য, বিবর্তনের ধারাবাহিকতা দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। পাশাপাশি দেশের অন্যান্য হস্তশিল্পের সম্ভাবনার জায়গাটি তুলে ধরতে পাট, বাঁশ, কচুরিপানা, কাশিয়া ও লোহালক্কড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্যের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। শিল্পী মনিরুল ইসলাম উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দেন, যেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মেলায় বাংলাদেশের এই পণ্যগুলোকে বেশি করে উপস্থাপন করা হয়। কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, “বৃটিশরা এই অঞ্চলের সম্পদ লুট করে ৭৫টি নৌকায় করে নিয়ে যায়। তাহলে কী পরিমাণ সম্পদ ছিল এই অঞ্চলে! অনেক আগে থেকেই সমৃদ্ধ ছিলাম আমরা।”
বক্তব্যের ফাঁকে নিজের লেখা কবিতা পড়ে শোনান নির্মলেন্দু গুণ। যেখানে শতরঞ্জি শব্দটিও আসে। এই কবি বলেন, “আমার কবিতায় কিভাবে এই শতরঞ্জি শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম, এখন মনে নাই। তবে আমাদের বাড়িতেও শতরঞ্জির ব্যবহার হত।” রংপুর জেলা তথ্য বাতায়নে বলা হয়েছে, রংপুর শহরের উপকণ্ঠে নিসবেতগঞ্জ গ্রাম, যা শতরঞ্জি শিল্পের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক উর্বর ভূমি। অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকে ব্রিটিশ নাগরিক নিসবেত তৎকালীন রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। সেই সময়ে নিসবেতগঞ্জের নাম ছিল পীরপুর। সেই গ্রামে রং-বেরংয়ের সুতার গালিচা বা শতরঞ্জি তৈরি হত। নিসবেত এসব শতরঞ্জি দেখে মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে তিনি শতরঞ্জির বিপণনের ব্যবস্থা করেন। এ শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য নিশবেতের নামানুসারে শতরঞ্জি সমৃদ্ধ এ গ্রামটির নামকরণও হয় নিসবেতগঞ্জ। উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিম বলেন, “ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল এই অঞ্চল অনেক সমৃদ্ধ, কিন্তু আমরা নিজেদের বুঝতে পারছি না! আমাদের কামার, কুমার, তাঁতিসহ হস্তশিল্প নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের শক্তির যদি সঠিক ব্যবহার করা যায় তবে আমরা আরো ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারব।” হস্তশিল্পে সামগ্রিক উদ্যোক্তা দরকার উল্লেখ করে সেলিম বলেন, “প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের অসংখ্য স্থানীয় পণ্য জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা নিশ্চিত হতে পারে এসব পণ্য উৎপাদনের মধ্য দিয়ে।”
শতরঞ্জি উৎপাদনে কোনো যন্ত্রের ব্যবহার নেই। কেবলমাত্র বাঁশ এবং রশি দিয়ে মাটির উপর সুতো দিয়ে টানা প্রস্তুত করে প্রতিটি সুতা গণনা করে হাত দিয়ে নকশা করে তা তৈরি করা হয়। কোনো জোড়া ছাড়া যে কোনো মাপের শতরঞ্জি তৈরী করা যায়। ১৯৭৬ সালে সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরীর একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু ব্যাপক বাজার সৃষ্টি করতে না পারায় ধীরে ধীরে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। গত ৩ দশক ধরে রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি নিয়ে কাজ করছেন উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিম। ১৯৯১ সাল থেকে কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের হাত ধরে বিশ্ববাজারে শতরঞ্জির প্রবেশ এবং উত্থান। প্রশংসিত হচ্ছে ইউরোপের বাজারেও। বর্তমানে রংপুরের উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার প্রায় ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে শতরঞ্জি। সেলিম বলেন, “প্রতি মাসে আমরা বাংলাদেশ সরকারকে ৩ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছি। সামনে এই বাজার আরও বিস্মৃত হবে বলে মনে করি।”
শতরঞ্জি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথম দিকে শতরঞ্জি নিয়ে কাজ করাটা ভীষণ কঠিন হয়েছিল। অনেকে পেশা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন, তাদের খুঁজে খুঁজে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেছি। অন্তত ১৬টি প্রদর্শনী করেছি। রংপুরে এখন দেড়শতাধিক শতরঞ্জির কারখানা রয়েছে।” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তশিল্প পছন্দ করার বিষয়টি তুলে ধরে সেলিম বলেন, “তিনি বিভিন্ন সময় বিদেশ সফরে গিয়ে শতরঞ্জি উপহার দিয়েছেন। গণভবনেও তিনি শতরঞ্জি ব্যবহার করেন। তার ছেলে জয়ের বিয়েতেও শতরঞ্জি ব্যবহার করেছেন।” আনিসুল হক বলেন, “সেলিমের মতো উদ্যোক্তা দরকার, যারা কচুরিপানা, হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বৈদিশিক মুদ্রা আনবেন।” রংপুর কারুপণ্য লিমিটেড এখন শতরঞ্জি ছাড়াও কামার-কুমারদের তৈরি পণ্য এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পগুলোকে দেশের বাজারে জনপ্রিয় করে তোলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও জনপ্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে জানায় শতরঞ্জির উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ‘কারুপণ্য’। রংপুর জেলার তথ্য বাতায়ন থেকে আরও জানা যায়, মুঘল সম্রাট আকবরের দরবারে শতরঞ্জি ব্যবহার করা হত। ত্রিশ দশকের জমিদার-জোতদারদের ভোজের আসন হিসেবে শতরঞ্জির ব্যবহারের কথা শোনা যায়। সে সময়ে শতরঞ্জি রাজা-বাদশাহ্, বিত্তবানদের বাড়িতে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত। ব্রিটিশ শাসনামলে শতরঞ্জি বার্মা, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হত।
শতরঞ্জি’র জিআই স্বীকৃতির বর্ণাঢ্য উদযাপন
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ