আল আমিন মুহাম্মাদ : এক বনে এক কাঠুরিয়া বাস করতো। সে খুব গরীব ও সৎলোক ছিলো। দুই ছেলেমেয়ে আর বিবিকে নিয়ে তার দুঃখের সংসার। সারাদিন কাট কেটে বাজারে বিক্রি করে সংসার চলে কোনমত। পরিবারে কারোর কোনো শখ-আল্লাদ পুরণ করতে পারে না কাঠুরিয়া।
একদিন বনে কাট কাটতে গিয়ে হঠাৎ একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেলো আশেপাশে। গিয়ে দেখলো একটা পরীর বাচ্চা কেমন করে কাঁদছে। দেখতে খুব সুন্দর! দুটো পাখনাও গজাচ্ছে কেবল। এখনো উড়তে শিখিনি মনে হচ্ছে। কাঠুরিয়া কেমন যেন একটু ভয় পেয়ে গেলো। তবুও জিজ্ঞেস করলো- কে তুমি মা? কাঁদছো কেন?
চোখ মুছতে মুছতে পরির বাচ্চাটি বলল- আমি আম্মুর কাছে যাবো, আমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে চলো।
কাঠুরিয়া চিন্তা করলো- সে কি ব্যাপার! পরির বাচ্চাকে আমি তার মায়ের কাছে নিয়ে যাবো সেটা কি সম্ভব? আমি তো মানুষ।
বাচ্চাটি বললো- আমাকে আগে আপনার বাড়িতে নিয়ে চলুন। তারপর যেতে যেতে সব বলবো।
বাড়ি পোঁছার আগেই তার এই দূর্দশার কথা খুলে বললো মেয়েটি। সে এক রাজার মেয়ে। তাকে ছিনতাইকরীরা ধরে এনেছিলো এক জঙ্গলে। তার গায়ের সমস্ত স্বর্ণালংকার নিয়ে তাকে ছেঁড়ে দেবে বলে। কিন্তু অনেক কৌশল করে সেখান থেকে সে পালিয়ে এসেছে এই জঙ্গলে। তারা হয়তো লোকালয়ে তাকে খুঁজতে আসবে না।
বলতে বলতে বাড়িতে পৌঁছালো দুজন। পরিবারের সবাই মেয়েটিকে দেখে তো অবাক! এ কাকে নিয়ে এলে? সবার একই প্রশ্ন।
কাঠুরিয়া সব কথা খুলে বললো তার পরিবারকে।
আর ছেলেমেয়েকে বললো- এখন থেকে তোমাদের সঙ্গে এ থাকবে। পাখনা গজালে উড়াল দেওয়া শিখলে তারপরে চলে যাবে।
ওরা রাজি হয়ে গেলো সাথে সাথে।
রাতে শোবার সময় মেয়েটি গায়ের সব গয়না খুলে কাঠুরিয়ার কাছে দিয়ে বলল- এই নিন আমার গয়নাগাটি। আপনার কাছে থাক। আমি যখন চলে যাবো তখন নিয়ে যাবো।
কাঠুরিয়া বলল- আচ্ছা ঠিক আছে মা।
বলার পরে বাক্সের ভিতরে খুব যতœ করে রেখে দিলো কাঠুরিয়া।
বিবি দেখে লোভ সামলাতে পারছিলো না। তাই ঘুমানোর আগে স্বামীকে বলল- আচ্ছা এত গয়নাগাটি! ওখান থেকে আমার জন্য কিছু রেখে দিলে কেমন হয়। ও কখনই টের পাবে না।
কাঠুরিয়া রেগেমেগে আগুন হয়ে গেলো। বিবিকে বলল- তুমি জানো? এটা আমাদের কাছে আমানত রাখা হয়েছে। কখনই এটা খেয়ানত করা যাবে না। তাহলে আল্লাহ পাক আমাদের উপরে অখুশি হবেন।
বিবি কথার জবাব দিতে পারলো না। স্বামীর সততার কাছে হেরে গেলো।
কিন্তু একটা প্রশ্ন করলো স্বামীকে। বললো- আচ্ছা একে তো আমাদের সংসার ঠিকমত চলে না তারমধ্যে আবার তাকে রাখা কি ঠিক হলো?
কাঠুরিয়া হেসে জবাবা দিলো- রিজিকের মালিক আল্লাহ। তার উপরেই ভরসা করি সবসময়। তিনি অবশ্যই আমাদের দেখবেন।
তুমি কোন চিন্তা করো না।
বিবি বললো- আচ্ছা, তুমি যদি পারো তো রাখো।
পরদিন সকাল বেলা। মেয়েটির পাখনা যদি লোকালয়ের কেউ দেখে ফেলে, তাহলে তাকে অনেক জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে; এই ভেবে কাঠুরিয়া ছেলেমেয়েদের সবাইকে ডেকে বলল- শোন, তোমরা যখন পাড়ার সাথীদের সাথে খেলতে যাবে তখন পরির কথা কাউকে বলবে না।
আর পরি মা, তুমিও বাইরে গেলে কখনই গায়ের জামা খুলবে না। তাহলে তোমার পাখনা গজানো সবাই দেখে ফেলবে।
পরি জবাব দিলো- ঠিক আছে বাবা। আপনি যা বলবেন সেটাই করবো।
তারপর নিজের ছেলেমেয়েকে লক্ষ্য করে কাঠুরিয়া বলল- তোমরা এই পরি মা-কে আপন বোনের মত মনে করবে। তাকে নিয়ে একসাথে খেলবে। তোমরা আজ থেকে আপন তিন ভাইবোন।
তারাও জবাব দিলো- ঠিক আছে বাবা তা-ই হবে।
কাঠুরিয়া শুনে খুব সন্তুষ্ট হলেন।
এভাবে পাঁচ-ছয় বছর কেটে যাওয়ার পর পরির সম্পূর্ণ পাখনা গজালো। এখন সে উড়তে পারে। তার দেশে যেতে এখন সে সম্পূর্ণ পারদর্শী।এখন তাকে চলে যেতে হবে। তাই বিদায় নেওয়ার কথা
কাঠুরিয়াকে বলতে এই ক’দিন ধরে সাহস পাচ্ছে না। এতদিন কাঠুরিয়ার কাছে নিজ সন্তানের মত থেকে অনেক আপন করে নিয়েছে তাদের। ছেঁড়ে যেতে মন চাচ্ছে না কিছুতেই । কাঠুরিয়ার পরিবারও সেই একই ভাবে আবেগাপ্লুত । তারপরও কঠিন বাস্তবকে মেনে নিতেই হবে সবাইকে। পরির আনমনা ভাব দেখে কাঠুরিয়ায় বুঝতে পারলো সে তার নিজ দেশে যেতে চাইছে। তাই পরিকে বলল- মা, তোমার তো সম্পূর্ণ পাখনা গজিয়েছে। এখন তোমাকে তো বিদায় নিতে হবে।
বলার সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেললো পরি। তার কান্না দেখে পরিবারের সবারই চোখে জল চলে এলো।
কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করলো ওখানে।
তারপর কাঠুরিয়া বলল- দাঁড়াও মা।
এই বলে সে মেয়েটির সেই আমানত রাখা গয়নাগাটি নিয়ে আসলো।
তারপর মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল- এই যে মা তোমার জিনিস। দেখো তো সবকিছু ঠিক আছে কি না।
মেয়েটি কাঠুরিয়ার সততায় একেবারে সিক্ত হয়ে গেলো। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না। কাঠুরিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল- বাবা! আপনি আমাকে নিজের সন্তানের মত আদর সোহাগ দিয়ে এতদিন বুকে আগলে রেখেছেন। আমি কোনোদিন এই ঋণ শোধ করতে পারবো না।
কাঠুরিয়া কেঁদে কেঁদে বলল- না মা! ওমন কথা বলতে নেই। আমি তো শুধু আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছি। কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে তুমি আমাকে মাফ করে দিও মা।
পরি কাঠুরিয়াকে একটা ধমক দিয়ে বলল- চুপ করো বাবা! চুপ করো! আর কোনোদিন এমন কথা মুখে আনবে না।
তারপর অনেকটা জোর করে সমস্ত গয়নাগাটি কাঠুরিয়ার হাতে দিয়ে বললো- বাবা, এইগুলো তোমাকে দিয়ে গেলাম। আমি চলে গেলাম বাবা! আমার জন্য দোয়া করবে।
কাঠুরিয়ার বিবি এটা দেখে নিজের কাছে নিজে খুব লজ্জা পেলো। আর মনে মনে বললো- লোভের চেয়ে ভালোবাসা সত্যিই অনেক বড়।
এত ধনসম্পদ পেয়েও কাঠুরিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। সেই সাথে পরিবারের সবাইও কান্না শুরু করলো। একেই বলে সত্যিকার ভালোবাসা! পবিত্র আতœার পবিত্র বন্ধন।
তারপর কাঠুরিয়া সোনার অলংকারগুলো বিক্রি করে অনেক টাকার মালিক হয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস শুরু করলো।