ড. বিশ্বজিৎ রায় : গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে-ঘুরে লোকগান সংগ্রহ আমার নেশা। কথায় বলে, ঢেঁকি যেখানেই যায়, সেখানেই ধান ভানে। এই প্রবাদ বচন মিথ্যে নয়, একেবারে ঠিক। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে বিভিন্ন পাঠদানের পাশাপাশি ছাত্রদের দিয়ে গবেষণার কাজও করাই। ‘গবেষণা পত্র তৈরি’ ওদের একটা সেমিস্টারের বিষয়ও বটে। সেখানে গিয়ে এবার ওরা তুলে আনলো চমৎকার ক’টি গান এবং কিছু তথ্য- যা এতদিন নগর জীবনে বসে একরকম জেনেছি, আর গবেষণায় উঠে আসলো অন্যরকম তথ্য। যেমন-‘পূবালী বাতাসে’ গানটির সুরকার সিরাজউদ্দীন খান পাঠান।
আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে পূবালি বাতাসে
বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি আমারনি কেউ আসেরে
যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে
অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠেরে
গাঙে দিয়া যায়রে কত নায়-নাইওরির নৌকা সখি রে
মায়ে-ঝিয়ে-বইনে বইনে হইতেছে যে দেখারে
আমি যে ছিলাম গো সখি বাপের গলার ফাঁস সখি রে
আমারে যে দিয়া গেল সীতা বনবাসরে
আমারে নিল না নাইওর পানি থাকতে তাজা সখি রে
দিনের পথ আধলে যাইতাম রাস্তা হইত সোজারে
কতজনায় যায়রে নাইওর এই না আষাঢ় মাসে সখি রে
উকিল মুন্সীর হইব নাইওর কার্তিক মাসের শেষেরে
আমরা সবাই জানি হাওড় বেষ্টিত অঞ্চল নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ। এই অঞ্চলের প্রকৃতি মানুষের গলায় সুর এনে দেয়। অজস্ত্র বাউলের সন্ধান মেলে এসব অঞ্চলে। এমনি এক অন্ধ বাউলের সন্ধান পায় আমার ছেলেমেয়েরা। অন্ধ শিল্পীর বয়ানে উঠে আসে- একবার হাওরে নৌকায় যাত্রাকালে প্রচ- ঝড় ওঠে। ঝড়ের কবলে পড়ে সকল যাত্রী যখন সৃষ্টিকর্তার নাম নিচ্ছে, তখন এই অন্ধ বাউল গুণগুণিয়ে কণ্ঠে সুর ভাঁজছেন। সবাই তাঁর উপর বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু তিনি কোনও সাড়াই দিলেন না। এক সময় ঝড় থামলো। যাত্রীরা নানা রকম ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করছেন তাঁকে। তিনি বললেন, আমি উকিল মুন্সীর একটা গান করছিলাম। সবাই জানতে চাইলো কী গান? তিনি তখন এই গানটি গেয়ে শোনালেন। উপস্থিত সকলে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরলো।
এবারে মূল কথায় ফিরা যাক। এই অন্ধ বাউলের নাম সিরাজউদ্দীন খান পাঠান। বয়স ৭০। নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৯৭ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বংশীবাদক পরে লোকগানের বিখ্যাত শিল্পী বারী সিদ্দিকী তাঁর কাছে গানটি শোনেন। এই বাউলকে দিয়ে গানটি রেকর্ড করাবেন বলে পুরো গানটি তিনি গলায় তুলে নেন। কিন্তু মাসখানেক পরে দেখা যায়, গানটি বারী সিদ্দিকী একটু পরিবর্তন করে এবং দুই অন্তরা ফেলে দিয়ে নিজেই রেকর্ড করে বসলেন। তিনি সেখানে সুরকার হিসেবে সিরাজউদ্দীন খান পাঠানের নামটাও উল্লেখ করেননি। আমরা এক বাক্যে স্বীকার করি, শ্রদ্ধেয় বারী সিদ্দিকী গানটি জনপ্রিয় করেছেন এবং অগণিত শ্রোতামনে জায়গা করে নিয়েছেন। তারপরও বলবো, যিনি গানটির সুরকার তাঁর ঋণ স্বীকার করা উচিত ছিল। সিরাজউদ্দীন অভিযোগের সুরে জানালেন, এই গানটির যে চারটি লাইন বারী করেননি সেখানে দুটি লাইনে গানের মূল ভাব নিহিত ছিল। সেই লাইন দু’টি হলো-
‘আমি যে ছিলাম গো সখি বাপের গলার ফাঁস সখি রে
আমারে যে দিয়া গেল সীতা বনবাসরে ’
এই বিকৃতি তাঁকে কষ্ট দেয়। গানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়ে গাওয়া হলে রচয়িতার গানের প্রতি অবিচার করা হয়। লোকগানের রচয়িতাদের গানে বেশ কয়েকটি অন্তরা থাকে। একজন শিল্পী গান করতে গিয়ে ইচ্ছে মতো অন্তরা ফেলে দেন। এই অভিযোগে অভিযুক্ত অনেক শিল্পী। কিন্তু এমন হওয়া একেবারেই কাম্য নয়। একজন বাউলের বা গানের স্রষ্টার সন্তানসম একেকটি গান। সেখানে বাণী বা সুরের ব্যত্যয় হওয়া উচিত নয়। যা আজ অহরহ হচ্ছে। উকিল সুন্সী (১৮৮৫-১৯৭৮) কে তিনি স্বশরীরে পেয়েছেন ও তাঁর সঙ্গে চলেছেন।
লেখক: লোকসঙ্গীত গবেষক, শিল্পী ও সংগঠক
নরংযধলরঃনংংংঢ়@মসধরষ.পড়স