ঢাকা ০৬:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লেখা একটি দুঃসাহসিক অভিযান: গীতাঞ্জলি শ্রী

  • আপডেট সময় : ১২:০৪:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ জুন ২০২২
  • ১০৪ বার পড়া হয়েছে

কুমার দীপ : ীতাঞ্জলি শ্রী। মূল নাম গীতাঞ্জলি পা-ে। পা-ের পরিবর্তে মায়ের নামের ‘শ্রী’ নিজের নামের শেষে যুক্ত করেছেন। সাহিত্যপাড়ার বাইরে ইতোমধ্যেই চাউর হয়েছে এই নাম। ২০২২ সালে সাহিত্যে বুকার পুরস্কার জয় করেছেন তিনি। তিনিই প্রথম ভারতীয় লেখক, যিনি সরাসরি ইংরেজি ভাষায় না লিখেও অত্যন্ত সম্মানজনক এই পুরস্কারটি পেলেন। বুকারপ্রাপ্তির জন্য অবশ্য হিন্দি ভাষায় লিখিত তাঁর ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হতে হয়েছে। লেখক-অনুবাদক ডেইজি অরওয়েল উপন্যাসটিকে ‘ঞড়সন ড়ভ ঝধহফ’ নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
গীতাঞ্জলি শ্রী’র জন্ম উত্তর প্রদেশে। বর্তমানে বাস করছেন দিল্লিতে। বাবা ছিলেন সিভিল সার্ভেন্ট, তাঁরই কাজের সূত্রে শৈশবের বড়ো একটি সময় তিনি উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় কাটিয়েছেন। নতুন দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ গীতাঞ্জলি জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসের উপরে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। ডক্টরেট করেছেন বরোদার এমএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
১৯৫৭ সালে জন্মগ্রহণকারী গীতাঞ্জলি শ্রী’র প্রথম গল্প ‘বেলপত্র’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে, একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে। তবে গল্পকার হিসেবে তাঁর পরিচিতি আসে ১৯৯১ সালে ‘অনুগুঞ্জ’ প্রকাশিত হলে। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘গধর’। বুকারের আগে তিনি কয়েকটি ভারতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। বুকার পুরস্কার ঘোষণার আগে যে লম্বা তালিকা হয়, সেখানে তাঁর নাম দেখেই তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। পুরস্কার জয়ের পরে রীতিমতো অভিভূত হয়েছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমি কখনও বুকারের স্বপ্ন দেখিনি। আমি কখনও ভাবিনি যে আমি পারবো। কী বিশাল স্বীকৃতি, আমি বিস্মিত, আনন্দিত, সম্মানিত এবং বিনীত।’ অনুবাদক ডেইজি অরওয়েলকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
গীতাঞ্জলি শ্রী’র ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসের মূর চরিত্র ৮০ বছরের একজন বৃদ্ধা, যিনি স্বামীর মৃত্যুর পরে জীবন থেকে স্বভাবতই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর একসময় সহসা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতোই জেগে উঠেছেন তিনি। বের হয়ে পড়েছেন নিজের জন্য বেঁধে দেওয়া সীমানার বাইরে। দেশভাগের খড়গের আঘাতে আলাদা হয়ে যাওয়া জন্মভূমি পাকিস্তানে ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা চলে আসে তাঁর মাথায়। সীমান্তের কাঁটাতার তাকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করলেও দমিয়ে রাখতে পারে না। শুরু হয় নতুন যাত্রা। সেই যাত্রারই শিল্পসমৃদ্ধ ও মানবিক সহানুভূতিশীল গল্প বলেছেন গীতাঞ্জলি শ্রী।
সাত শতাধিক পাতার এই উপন্যাস যখন বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কারে ভূষিত হলো, স্বভাবতই সাড়া পড়ে গেল চারদিকে। তবে আপাতত উপন্যাসটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা নয়, আমরা লেখকের একটি সাক্ষাৎকারের বঙ্গানুবাদ তুলে ধরতে চাই যা এই লেখক এবং তাঁর লেখা সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে পারে।
নিউজ নাইন ওয়েব পোর্টাল-এ গীতাঞ্জলি শ্রী’র এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় সেই সময়ে, যখন বুকার পুরস্কার ২০২২ প্রদানের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিভিন্ন লেখকদের নিয়ে একটি লম্বা তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন চিন্তন গিরিশ মোদি, যিনি নিজে লেখক, সাংবাদিক, বই আলোচক এবং ভাষ্যকার।
চিন্তন গিরিশ: আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য আপনার বই মনোনীত হয়েছে। এ-বিষয়ে আপনার অনুভূতি কী?
গীতাঞ্জলি শ্রী: এই ধরনের তালিকায় থাকাটা যে-কারো কাছেই নিশ্চিতভাবে বিস্ময়করের চেয়ে কম কিছু হতে পারে না। কঠোরতা এবং বিচক্ষণতার জন্য বুকার ইতোমধ্যে প্রশংসার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। এই খবরের মধ্য দিয়ে আমার ভেতরে একটি মহৎ অনুভূতি তৈরি হচ্ছে।
এই স্বীকৃতি আমার নিজের থেকে এবং লেখক হিসেবে আমার কাজের এক ধরনের অদ্ভূত দূরত্ব দান করে এবং বিস্ময়ের সঙ্গে আমার বইয়ের দিকে এবং আমার নিজের দিকে উৎসুক চোখে তাকাতে বাধ্য করে। তবে ব্যাপারটি আমার জন্য স্বতঃসিদ্ধ আদর্শবাদী কিছু নয়। একজন লেখককে লিখতে হয়, সহজভাবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে, খারাপ সময়, ভালো সময়, বুকার মুহূর্ত, নন-বুকার মুহূর্ত… সব সময়ই লিখতে হয়।
চিন্তন গিরিশ: আপনার হিন্দি বই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক বুকারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এর আগে আর কোনো হিন্দি বই এই তালিকায় কেন জায়গা পায়নি বলে আপনি মনে করেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: এটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন এবং আমরা সবাই তা শুনতে চাই। এটা নিশ্চিত, আমার উপন্যাসই প্রথম দীপ্তিময় উপন্যাস নয়, যা উক্ত তালিকায় থাকার উপযুক্ত। আমার আগে অনেক বড়ো বড়ো কাজ হয়েছে কিন্তু হিন্দি জগতের বাইরে ক’জন তাদেরকে জানেন? অনুবাদ এবং বিভিন্ন ভাষায় কথোপকথন এ-ধরনের কাজকে বাইরে নিয়ে আসার একমাত্র পথ। কেন এটি ঘটল না তা সম্পূর্ণ রাজনীতির বিষয় হতে পারে, কিন্তু দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত কর্মী ইত্যাদির ক্ষেত্রেও মৌলিক সমস্যা রয়েছে। বিষয়টি আমাদেরকে সংলাপের দিকে নিয়ে যায় এবং এ-নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন।
আমাদের এই সত্যের মুখোমুখি হতে হবে যে, অপর্যাপ্ততার কারণে অনেক সাহিত্যকর্ম সমসাময়িক বৃত্তের বাইরে থেকে যায়। এমন সত্যেরও মোকাবিলা করতে হয় যে, অপেক্ষাকৃত মূর্খতার সঙ্গে, এমনকি খুব বুদ্ধিমান লোকেরাও ধরে নেয় যে, যেহেতু এটা দেখা যায়নি বা তারা এটা দেখেনি, সেহেতু এটা নেই। এখন এটা বলাই যথেষ্ট যে, আমি ভাগ্যবতী এজন্যে যে এই মুহূর্তে আমি দৃশ্যমান। আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই টিলড এক্সিসকে ( প্রেস, যেখান থেকে ‘রেত সমাধি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত), ধন্যবাদ ডেইজি ( ডেইজি রকওয়েল, যিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন), এবং ধন্যবাদ জানাতে চাই অ্যানি মন্টাটকে (ফ্রান্সের দক্ষিণ এশিয়া স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক ও লেখক), যিনি প্রথমে এটি ‘অনুবাদ অসম্ভব’ বলেছেন এবং উপন্যাসটি ফরাসিতে অনুবাদ করেছেন।
চিন্তন গিরিশ: পিছনে ফিরে তাকালে রেত সমাধি লেখার সময়ের সবচেয়ে আনন্দদায়ক ও বেদনাদায়ক মুহূর্তগুলো কী ছিলো?
গীতাঞ্জলি শ্রী: হ্যাঁ, এতে আনন্দ ও বেদনা দুটোই ছিল। দেখুন, লেখা একটি দুঃসাহসিক অভিযান এবং এটা সেই সমুদ্রযাত্রায় বের হওয়া- যেটা আনন্দ, উদ্বেগ, ঝুঁকি সবকিছুতে পূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই আমি তখন সেই যাত্রাসঙ্গী হিসেবে পুরো সময় ধরে আবেগের পূর্ণ স্বরগ্রামে ছিলাম। একটি সৃজনশীল কাজ সুবিন্যাস্তভাবে প্রোগ্রাম করা কোনো ফলাফল নয়। একটি বীজ থেকে এটি অঙ্কুরিত হয় এবং এরপর এটি তার নিজস্ব রঙ ও বিন্যাসের মাধ্যমে স্বতন্ত্র গল্প তৈরি করে। প্রাথমিকভাবে লেখক এটির সূত্রপাত করতে পারেন কিন্তু ধীরে ধীরে এর চরিত্রগুলো তাদের প্রবণতা এবং সম্ভাবনার দ্বারা লেখককে প্রভাবিত করতে শুরু করে।
‘রেত সমাধি’ গড়ে ওঠে এগিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা নিয়ে এবং এটি হয়ে ওঠে সীমানা অতিক্রমের উচ্ছ্বাসের নির্দেশনা। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী এটি কাজ করতে শুরু করে এবং নতুন কিছু উদ্ঘাটন করতে থাকে। বিভিন্ন স্তরে- চরিত্রসমূহ, তাদের দক্ষতা, প্রকৃতি, তাদের গল্প, তাদের কী আছে এই সবকিছুই সীমানা প্রত্যাখ্যান করতে থাকে এবং তা পার হয়ে যেতে থাকে। এটি নিজেকে মুক্ত এবং উচ্ছ্বসিত হওয়ার অধিকার প্রকাশ করে এবং বিশ্বের বিচিত্রতার আনন্দ উপভোগ করে। কিন্তু স্বাধীনতা অনুপ্রাণিত করার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্নও করে। আপনি কোনো কিছু বারবার চাপ দিতে পারবেন কিন্তু একেবারে অপসারণ করতে পারেন না। আপনি পাগল হতে পারেন কিন্তু তা-কোনো একটি পদ্ধতি ছাড়া নয়।
উপন্যাসটি সকল ধরনের বাঁক নিয়েছিল এবং সেগুলি আমাকে উত্তেজিত করেছিল তাদের অনিশ্চয়তার সাথে। অনেক বছর আগে, এই নতুন পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল, যা আমি যে পৃথিবীতে বাস করতাম তার ঐশ্বর্য ও বহুত্বে পূর্ণ ছিল। হয়তো অন্যকিছুও ছিল। দৈনন্দিন এবং সাধারণ ঘটনাবলির সংঘাতে বড়ো ঐতিহাসিক ও মানবিক ঘটনার অনুরণন সূচিত হয়েছিল। তখন থেকে গল্পগুলি নিজস্ব বিন্যাসের জাল তৈরি করছিল।
উপন্যাসটি আমাকে আনন্দের এবং একইসঙ্গে জটিল ভূখ-ের দিকে নিয়ে গেছে, যেখানে অনেকেই আমাকে তাদের গল্প বলেছে, যাদের মধ্যে পাখি, প্রাণী এবং দরজার মতো চলৎশক্তিহীন বস্তুও রয়েছে। আমি তাদের কোলাহলে আনন্দিত হয়েছি এবং শোকাহত হয়েছি দেশভাগের মতো তাদের বেদনাদায়ক মূর্খতায়। এবং তখনই উপন্যাসটি সমাপ্ত হয়েছে। তারপরও আমি উপন্যাসটি প্রকাশকের হাতে তুলে দিতে পারিনি। কেন পারিনি, তা আমি বলতে পারবো না। যে-কণ্ঠস্বরটি ‘যেতে দাও’ বলে, তা আমার মধ্যে ছিল না। এমন নয় যে, আমি উপন্যাসটিতে আরও কাজ করছিলাম, কিন্তু এটি আমাকে ছেড়ে যেতে প্রস্তুত ছিল না।
মনে পড়ে সেই দিনগুলো আমার কাছে বিশেষভাবে বেদনাদায়ক ছিল। এটা গর্ভাবস্থার ভারত্বের সাথে তুলনীয়, যার মেয়াদ পূর্ণ হয়ে গেছে কিন্তু এখনও সন্তান জন্ম দিয়ে পারেনি! আমি নিজেকে ভারী ও ভয়ঙ্কর বোধ করছিলাম এবং উদ্বিগ্ন ছিলাম এজন্যে যে, কিছু ভুল হয়ে গেলে আমি মারা যাবো অথবা এমনটি হবে। এইসব ভাবনা আমাকে অসুস্থ করে তোলে। কিন্তু সেই মুহূর্তটি এলো এবং আমি প্রেসে দিলাম। এই ভার থেকে আমি মুক্ত হলাম এবং এটি আমাকে মুক্তি দিলো !
চিন্তন গিরিশ: আপনার বইগুলো ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, সার্বিয়ান এবং কোরিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অনুবাদে কী অর্জিত হয়েছে এবং কী হারিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমরা জানি, একজন ভালো অনুবাদক মূল পাঠ্যের আক্ষরিক উপস্থাপন করেন না, বরং অনূদিত ভাষা এবং তার চারপাশের সংস্কৃতিতে সেটিকে সৃজনশীল স্থানান্তরের চেষ্টা করেন। আমি মনে করি, আমার অনুবাদকদের নিয়ে আমি ভাগ্যবতী। তাঁরা আমার এবং আমার কাজের সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরি করেছেন কিন্তু পরে তাদের নিজেদের অধিকার অনুসারে সৃজনশীল হয়েছেন।
একজন ভালো লেখকের সঙ্গে আমিও কাজ করেছি। কিছু ভাষায় আমি কখনও অনূদিত লেখা পড়তে পারিনি, কিন্তু তাদের পাঠক বা শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া আমাকে সেই সম্পর্কে একটা নির্দেশনা দিয়েছে। অন্য একটি ভাষায় যখন কোনো লেখা অনূদিত হয়, তখন এতে নতুন একটি পালক যুক্ত হয়। অনুবাদে কী হারিয়েছে? আমার নিজস্ব শব্দ, গন্ধ, মলা (নাক বা কান মলা বা বিশেষ কোনো স্পর্শ) এবং মোচড়।
চিন্তন গিরিশ: ডেইজি অরওয়েলের অনুবাদ সম্পর্কে আপনার মতামত শেয়ার করতে পারবেন কি? আপনি কি তাঁর হাতে আপনার বই দিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমি বিভিন্ন লোকের কাছে এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনেছি যে, তিনি একটি দারুণ কাজ করেছেন এবং বুকার লিস্টে যোগ হওয়া সেই কাজেরই সমর্থন। আমি একা যদি বিচারক হতাম, নিজেকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আপনি লক্ষ্য করুন, আমি বিষয়ানুগ এবং আমার নিজের পাঠ্যের সাথে খুবই সম্পর্কযুক্ত।
আপনার অনুবাদকের সঙ্গে আপনি যে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, তা কাজে সাহায্য করে। খুব দ্রুত ডেইজি এবং আমার মধ্যে একটি সহজ সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছি। তাঁর সন্দেহ এবং মতপার্থক্য আমাদেরকে আলোচনার দিকে পরিচালিত করে এবং আমরা একটি সিদ্ধান্তে একমত হতে পারি। এমনকি কখনও কখনও দ্বিমতও পোষণ করতে পারি।
যে পুঙ্খানুপুঙ্খতার সঙ্গে তিনি হিন্দি পাঠে জড়িত ছিলেন ছিলেন, তা প্রকাশ পেতো তিনি যখন তাঁর সন্দেহ প্রকাশ করতেন, এমনকি একটি পয়েন্ট বা শব্দ সম্পর্কে কম-বেশি পরিষ্কার ধারণা রাখতে চাইতেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আত্মবিশ্বাসের প্রেরণা দিয়েছে। তিনি ইতোমধ্যে খাদিজা মাতুর এবং কৃষ্ণা সবতীর মতো লেখা অনুবাদ করেছেন। এবং তিনি একেবারে রামানুজনের ছাত্রীদের চেয়ে কম নন।
চিন্তন গিরিশ: আপনি বর্তমানে কী কাজ করছেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী : একটি উপন্যাস সমাপ্ত করেছি কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেকে চুপচাপ বসে থাকতে দিচ্ছি।
চিন্তন গিরিশ: আপনার সমসাময়িক প্রিয় লেখক কারা?
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমরা এই মুহূর্তে অতিপ্রাচুর্যময় পৃথিবীতে আছি। এটা একইসঙ্গে চমৎকার এবং হতাশার। আমি প্রচুর পড়ি, কিন্তু অগোছালোভাবে। প্রিয় লেখকদের তালিকা, আরও প্রিয় কাজের তালিকা- এসব চলবে এবং চলতে থাকবে। আমি শুধু কয়েকজন সমসাময়িক হিন্দি লেখকের কথা উল্লেখ করি, যাদের লেখা আমি পড়েছি এবং যাদের কাজ আমি বিশেষভাবে পছন্দ করি। এমনকি এটা খুবই অসম্পূর্ণ একটি তালিকা। কৃষ্ণা সবতী, নির্মল ভার্মা, কৃষ্ণ বলদেব বেদ, বিনোদ কুমার শুক্ল, মঞ্জুর এহতেশাম, মৃণাল পা-ে, মৃদুলা গার্গ, মমতা কালিয়া, অভিলেশ, জ্ঞান চতুর্বেদী, সারা রাই, অলকা সারাওগী, প্রত্যক্ষ, নীলাক্ষি সিং, চন্দন পা-ে প্রমুখ।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

লেখা একটি দুঃসাহসিক অভিযান: গীতাঞ্জলি শ্রী

আপডেট সময় : ১২:০৪:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ জুন ২০২২

কুমার দীপ : ীতাঞ্জলি শ্রী। মূল নাম গীতাঞ্জলি পা-ে। পা-ের পরিবর্তে মায়ের নামের ‘শ্রী’ নিজের নামের শেষে যুক্ত করেছেন। সাহিত্যপাড়ার বাইরে ইতোমধ্যেই চাউর হয়েছে এই নাম। ২০২২ সালে সাহিত্যে বুকার পুরস্কার জয় করেছেন তিনি। তিনিই প্রথম ভারতীয় লেখক, যিনি সরাসরি ইংরেজি ভাষায় না লিখেও অত্যন্ত সম্মানজনক এই পুরস্কারটি পেলেন। বুকারপ্রাপ্তির জন্য অবশ্য হিন্দি ভাষায় লিখিত তাঁর ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হতে হয়েছে। লেখক-অনুবাদক ডেইজি অরওয়েল উপন্যাসটিকে ‘ঞড়সন ড়ভ ঝধহফ’ নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
গীতাঞ্জলি শ্রী’র জন্ম উত্তর প্রদেশে। বর্তমানে বাস করছেন দিল্লিতে। বাবা ছিলেন সিভিল সার্ভেন্ট, তাঁরই কাজের সূত্রে শৈশবের বড়ো একটি সময় তিনি উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় কাটিয়েছেন। নতুন দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ গীতাঞ্জলি জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসের উপরে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। ডক্টরেট করেছেন বরোদার এমএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
১৯৫৭ সালে জন্মগ্রহণকারী গীতাঞ্জলি শ্রী’র প্রথম গল্প ‘বেলপত্র’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে, একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে। তবে গল্পকার হিসেবে তাঁর পরিচিতি আসে ১৯৯১ সালে ‘অনুগুঞ্জ’ প্রকাশিত হলে। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘গধর’। বুকারের আগে তিনি কয়েকটি ভারতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। বুকার পুরস্কার ঘোষণার আগে যে লম্বা তালিকা হয়, সেখানে তাঁর নাম দেখেই তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। পুরস্কার জয়ের পরে রীতিমতো অভিভূত হয়েছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমি কখনও বুকারের স্বপ্ন দেখিনি। আমি কখনও ভাবিনি যে আমি পারবো। কী বিশাল স্বীকৃতি, আমি বিস্মিত, আনন্দিত, সম্মানিত এবং বিনীত।’ অনুবাদক ডেইজি অরওয়েলকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
গীতাঞ্জলি শ্রী’র ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসের মূর চরিত্র ৮০ বছরের একজন বৃদ্ধা, যিনি স্বামীর মৃত্যুর পরে জীবন থেকে স্বভাবতই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর একসময় সহসা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতোই জেগে উঠেছেন তিনি। বের হয়ে পড়েছেন নিজের জন্য বেঁধে দেওয়া সীমানার বাইরে। দেশভাগের খড়গের আঘাতে আলাদা হয়ে যাওয়া জন্মভূমি পাকিস্তানে ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা চলে আসে তাঁর মাথায়। সীমান্তের কাঁটাতার তাকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করলেও দমিয়ে রাখতে পারে না। শুরু হয় নতুন যাত্রা। সেই যাত্রারই শিল্পসমৃদ্ধ ও মানবিক সহানুভূতিশীল গল্প বলেছেন গীতাঞ্জলি শ্রী।
সাত শতাধিক পাতার এই উপন্যাস যখন বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কারে ভূষিত হলো, স্বভাবতই সাড়া পড়ে গেল চারদিকে। তবে আপাতত উপন্যাসটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা নয়, আমরা লেখকের একটি সাক্ষাৎকারের বঙ্গানুবাদ তুলে ধরতে চাই যা এই লেখক এবং তাঁর লেখা সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে পারে।
নিউজ নাইন ওয়েব পোর্টাল-এ গীতাঞ্জলি শ্রী’র এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় সেই সময়ে, যখন বুকার পুরস্কার ২০২২ প্রদানের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিভিন্ন লেখকদের নিয়ে একটি লম্বা তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন চিন্তন গিরিশ মোদি, যিনি নিজে লেখক, সাংবাদিক, বই আলোচক এবং ভাষ্যকার।
চিন্তন গিরিশ: আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য আপনার বই মনোনীত হয়েছে। এ-বিষয়ে আপনার অনুভূতি কী?
গীতাঞ্জলি শ্রী: এই ধরনের তালিকায় থাকাটা যে-কারো কাছেই নিশ্চিতভাবে বিস্ময়করের চেয়ে কম কিছু হতে পারে না। কঠোরতা এবং বিচক্ষণতার জন্য বুকার ইতোমধ্যে প্রশংসার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। এই খবরের মধ্য দিয়ে আমার ভেতরে একটি মহৎ অনুভূতি তৈরি হচ্ছে।
এই স্বীকৃতি আমার নিজের থেকে এবং লেখক হিসেবে আমার কাজের এক ধরনের অদ্ভূত দূরত্ব দান করে এবং বিস্ময়ের সঙ্গে আমার বইয়ের দিকে এবং আমার নিজের দিকে উৎসুক চোখে তাকাতে বাধ্য করে। তবে ব্যাপারটি আমার জন্য স্বতঃসিদ্ধ আদর্শবাদী কিছু নয়। একজন লেখককে লিখতে হয়, সহজভাবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে, খারাপ সময়, ভালো সময়, বুকার মুহূর্ত, নন-বুকার মুহূর্ত… সব সময়ই লিখতে হয়।
চিন্তন গিরিশ: আপনার হিন্দি বই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক বুকারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এর আগে আর কোনো হিন্দি বই এই তালিকায় কেন জায়গা পায়নি বলে আপনি মনে করেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: এটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন এবং আমরা সবাই তা শুনতে চাই। এটা নিশ্চিত, আমার উপন্যাসই প্রথম দীপ্তিময় উপন্যাস নয়, যা উক্ত তালিকায় থাকার উপযুক্ত। আমার আগে অনেক বড়ো বড়ো কাজ হয়েছে কিন্তু হিন্দি জগতের বাইরে ক’জন তাদেরকে জানেন? অনুবাদ এবং বিভিন্ন ভাষায় কথোপকথন এ-ধরনের কাজকে বাইরে নিয়ে আসার একমাত্র পথ। কেন এটি ঘটল না তা সম্পূর্ণ রাজনীতির বিষয় হতে পারে, কিন্তু দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত কর্মী ইত্যাদির ক্ষেত্রেও মৌলিক সমস্যা রয়েছে। বিষয়টি আমাদেরকে সংলাপের দিকে নিয়ে যায় এবং এ-নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন।
আমাদের এই সত্যের মুখোমুখি হতে হবে যে, অপর্যাপ্ততার কারণে অনেক সাহিত্যকর্ম সমসাময়িক বৃত্তের বাইরে থেকে যায়। এমন সত্যেরও মোকাবিলা করতে হয় যে, অপেক্ষাকৃত মূর্খতার সঙ্গে, এমনকি খুব বুদ্ধিমান লোকেরাও ধরে নেয় যে, যেহেতু এটা দেখা যায়নি বা তারা এটা দেখেনি, সেহেতু এটা নেই। এখন এটা বলাই যথেষ্ট যে, আমি ভাগ্যবতী এজন্যে যে এই মুহূর্তে আমি দৃশ্যমান। আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই টিলড এক্সিসকে ( প্রেস, যেখান থেকে ‘রেত সমাধি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত), ধন্যবাদ ডেইজি ( ডেইজি রকওয়েল, যিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন), এবং ধন্যবাদ জানাতে চাই অ্যানি মন্টাটকে (ফ্রান্সের দক্ষিণ এশিয়া স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক ও লেখক), যিনি প্রথমে এটি ‘অনুবাদ অসম্ভব’ বলেছেন এবং উপন্যাসটি ফরাসিতে অনুবাদ করেছেন।
চিন্তন গিরিশ: পিছনে ফিরে তাকালে রেত সমাধি লেখার সময়ের সবচেয়ে আনন্দদায়ক ও বেদনাদায়ক মুহূর্তগুলো কী ছিলো?
গীতাঞ্জলি শ্রী: হ্যাঁ, এতে আনন্দ ও বেদনা দুটোই ছিল। দেখুন, লেখা একটি দুঃসাহসিক অভিযান এবং এটা সেই সমুদ্রযাত্রায় বের হওয়া- যেটা আনন্দ, উদ্বেগ, ঝুঁকি সবকিছুতে পূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই আমি তখন সেই যাত্রাসঙ্গী হিসেবে পুরো সময় ধরে আবেগের পূর্ণ স্বরগ্রামে ছিলাম। একটি সৃজনশীল কাজ সুবিন্যাস্তভাবে প্রোগ্রাম করা কোনো ফলাফল নয়। একটি বীজ থেকে এটি অঙ্কুরিত হয় এবং এরপর এটি তার নিজস্ব রঙ ও বিন্যাসের মাধ্যমে স্বতন্ত্র গল্প তৈরি করে। প্রাথমিকভাবে লেখক এটির সূত্রপাত করতে পারেন কিন্তু ধীরে ধীরে এর চরিত্রগুলো তাদের প্রবণতা এবং সম্ভাবনার দ্বারা লেখককে প্রভাবিত করতে শুরু করে।
‘রেত সমাধি’ গড়ে ওঠে এগিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা নিয়ে এবং এটি হয়ে ওঠে সীমানা অতিক্রমের উচ্ছ্বাসের নির্দেশনা। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী এটি কাজ করতে শুরু করে এবং নতুন কিছু উদ্ঘাটন করতে থাকে। বিভিন্ন স্তরে- চরিত্রসমূহ, তাদের দক্ষতা, প্রকৃতি, তাদের গল্প, তাদের কী আছে এই সবকিছুই সীমানা প্রত্যাখ্যান করতে থাকে এবং তা পার হয়ে যেতে থাকে। এটি নিজেকে মুক্ত এবং উচ্ছ্বসিত হওয়ার অধিকার প্রকাশ করে এবং বিশ্বের বিচিত্রতার আনন্দ উপভোগ করে। কিন্তু স্বাধীনতা অনুপ্রাণিত করার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্নও করে। আপনি কোনো কিছু বারবার চাপ দিতে পারবেন কিন্তু একেবারে অপসারণ করতে পারেন না। আপনি পাগল হতে পারেন কিন্তু তা-কোনো একটি পদ্ধতি ছাড়া নয়।
উপন্যাসটি সকল ধরনের বাঁক নিয়েছিল এবং সেগুলি আমাকে উত্তেজিত করেছিল তাদের অনিশ্চয়তার সাথে। অনেক বছর আগে, এই নতুন পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল, যা আমি যে পৃথিবীতে বাস করতাম তার ঐশ্বর্য ও বহুত্বে পূর্ণ ছিল। হয়তো অন্যকিছুও ছিল। দৈনন্দিন এবং সাধারণ ঘটনাবলির সংঘাতে বড়ো ঐতিহাসিক ও মানবিক ঘটনার অনুরণন সূচিত হয়েছিল। তখন থেকে গল্পগুলি নিজস্ব বিন্যাসের জাল তৈরি করছিল।
উপন্যাসটি আমাকে আনন্দের এবং একইসঙ্গে জটিল ভূখ-ের দিকে নিয়ে গেছে, যেখানে অনেকেই আমাকে তাদের গল্প বলেছে, যাদের মধ্যে পাখি, প্রাণী এবং দরজার মতো চলৎশক্তিহীন বস্তুও রয়েছে। আমি তাদের কোলাহলে আনন্দিত হয়েছি এবং শোকাহত হয়েছি দেশভাগের মতো তাদের বেদনাদায়ক মূর্খতায়। এবং তখনই উপন্যাসটি সমাপ্ত হয়েছে। তারপরও আমি উপন্যাসটি প্রকাশকের হাতে তুলে দিতে পারিনি। কেন পারিনি, তা আমি বলতে পারবো না। যে-কণ্ঠস্বরটি ‘যেতে দাও’ বলে, তা আমার মধ্যে ছিল না। এমন নয় যে, আমি উপন্যাসটিতে আরও কাজ করছিলাম, কিন্তু এটি আমাকে ছেড়ে যেতে প্রস্তুত ছিল না।
মনে পড়ে সেই দিনগুলো আমার কাছে বিশেষভাবে বেদনাদায়ক ছিল। এটা গর্ভাবস্থার ভারত্বের সাথে তুলনীয়, যার মেয়াদ পূর্ণ হয়ে গেছে কিন্তু এখনও সন্তান জন্ম দিয়ে পারেনি! আমি নিজেকে ভারী ও ভয়ঙ্কর বোধ করছিলাম এবং উদ্বিগ্ন ছিলাম এজন্যে যে, কিছু ভুল হয়ে গেলে আমি মারা যাবো অথবা এমনটি হবে। এইসব ভাবনা আমাকে অসুস্থ করে তোলে। কিন্তু সেই মুহূর্তটি এলো এবং আমি প্রেসে দিলাম। এই ভার থেকে আমি মুক্ত হলাম এবং এটি আমাকে মুক্তি দিলো !
চিন্তন গিরিশ: আপনার বইগুলো ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, সার্বিয়ান এবং কোরিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অনুবাদে কী অর্জিত হয়েছে এবং কী হারিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমরা জানি, একজন ভালো অনুবাদক মূল পাঠ্যের আক্ষরিক উপস্থাপন করেন না, বরং অনূদিত ভাষা এবং তার চারপাশের সংস্কৃতিতে সেটিকে সৃজনশীল স্থানান্তরের চেষ্টা করেন। আমি মনে করি, আমার অনুবাদকদের নিয়ে আমি ভাগ্যবতী। তাঁরা আমার এবং আমার কাজের সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরি করেছেন কিন্তু পরে তাদের নিজেদের অধিকার অনুসারে সৃজনশীল হয়েছেন।
একজন ভালো লেখকের সঙ্গে আমিও কাজ করেছি। কিছু ভাষায় আমি কখনও অনূদিত লেখা পড়তে পারিনি, কিন্তু তাদের পাঠক বা শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া আমাকে সেই সম্পর্কে একটা নির্দেশনা দিয়েছে। অন্য একটি ভাষায় যখন কোনো লেখা অনূদিত হয়, তখন এতে নতুন একটি পালক যুক্ত হয়। অনুবাদে কী হারিয়েছে? আমার নিজস্ব শব্দ, গন্ধ, মলা (নাক বা কান মলা বা বিশেষ কোনো স্পর্শ) এবং মোচড়।
চিন্তন গিরিশ: ডেইজি অরওয়েলের অনুবাদ সম্পর্কে আপনার মতামত শেয়ার করতে পারবেন কি? আপনি কি তাঁর হাতে আপনার বই দিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমি বিভিন্ন লোকের কাছে এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনেছি যে, তিনি একটি দারুণ কাজ করেছেন এবং বুকার লিস্টে যোগ হওয়া সেই কাজেরই সমর্থন। আমি একা যদি বিচারক হতাম, নিজেকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আপনি লক্ষ্য করুন, আমি বিষয়ানুগ এবং আমার নিজের পাঠ্যের সাথে খুবই সম্পর্কযুক্ত।
আপনার অনুবাদকের সঙ্গে আপনি যে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, তা কাজে সাহায্য করে। খুব দ্রুত ডেইজি এবং আমার মধ্যে একটি সহজ সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছি। তাঁর সন্দেহ এবং মতপার্থক্য আমাদেরকে আলোচনার দিকে পরিচালিত করে এবং আমরা একটি সিদ্ধান্তে একমত হতে পারি। এমনকি কখনও কখনও দ্বিমতও পোষণ করতে পারি।
যে পুঙ্খানুপুঙ্খতার সঙ্গে তিনি হিন্দি পাঠে জড়িত ছিলেন ছিলেন, তা প্রকাশ পেতো তিনি যখন তাঁর সন্দেহ প্রকাশ করতেন, এমনকি একটি পয়েন্ট বা শব্দ সম্পর্কে কম-বেশি পরিষ্কার ধারণা রাখতে চাইতেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আত্মবিশ্বাসের প্রেরণা দিয়েছে। তিনি ইতোমধ্যে খাদিজা মাতুর এবং কৃষ্ণা সবতীর মতো লেখা অনুবাদ করেছেন। এবং তিনি একেবারে রামানুজনের ছাত্রীদের চেয়ে কম নন।
চিন্তন গিরিশ: আপনি বর্তমানে কী কাজ করছেন?
গীতাঞ্জলি শ্রী : একটি উপন্যাস সমাপ্ত করেছি কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেকে চুপচাপ বসে থাকতে দিচ্ছি।
চিন্তন গিরিশ: আপনার সমসাময়িক প্রিয় লেখক কারা?
গীতাঞ্জলি শ্রী: আমরা এই মুহূর্তে অতিপ্রাচুর্যময় পৃথিবীতে আছি। এটা একইসঙ্গে চমৎকার এবং হতাশার। আমি প্রচুর পড়ি, কিন্তু অগোছালোভাবে। প্রিয় লেখকদের তালিকা, আরও প্রিয় কাজের তালিকা- এসব চলবে এবং চলতে থাকবে। আমি শুধু কয়েকজন সমসাময়িক হিন্দি লেখকের কথা উল্লেখ করি, যাদের লেখা আমি পড়েছি এবং যাদের কাজ আমি বিশেষভাবে পছন্দ করি। এমনকি এটা খুবই অসম্পূর্ণ একটি তালিকা। কৃষ্ণা সবতী, নির্মল ভার্মা, কৃষ্ণ বলদেব বেদ, বিনোদ কুমার শুক্ল, মঞ্জুর এহতেশাম, মৃণাল পা-ে, মৃদুলা গার্গ, মমতা কালিয়া, অভিলেশ, জ্ঞান চতুর্বেদী, সারা রাই, অলকা সারাওগী, প্রত্যক্ষ, নীলাক্ষি সিং, চন্দন পা-ে প্রমুখ।