প্রত্যাশা ডেস্ক: চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা এবং পানগাঁও আইসিটি পরিচালনায় দুই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ডেনমার্কের এপি মোলার মায়ের্সক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস লালদিয়া ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেডলগ এসএ পরিচালনা করবে পানগাঁও আইসিটি।
বিদেশিদের দিয়ে বন্দর পরিচালনা নিয়ে নানামুখী সমালোচনার মধ্যে এ চুক্তি হলো। বন্দর ব্যবহারকারী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিজ্ঞ বিদেশি অপারেটররা বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনা করলে দেশ লাভবান হবে। তবে তা চুক্তির শর্তের ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করছে।
সূত্রের বরাত দিয়ে একটি অনলাইন সংবাদসংস্থা জানিয়েছে, অবৈধ দখলে থাকা লালদিয়া থেকে বসতি উচ্ছেদ করে তাতে বন্দরের জেটি নির্মাণের উপযোগী করা হয়। আর চট্টগ্রাম বন্দর নিজস্ব ১৫৬ কোটি টাকা অর্থায়নে পানগাঁও আইসিটি নির্মাণ করলেও ১০ বছর ধরে কার্যকর করা যায়নি।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত সোমবার (১৭ নভেম্বর) ঢাকার একটি হোটেলে আলাদা দুই অনুষ্ঠানে চুক্তি দুটি সই হয়। লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নিয়ে চুক্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান এবং এপিএম টার্মিনালসের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টেইন ভ্যান ডোঙ্গেন সই করেন। পানগাঁও আইসিটি নিয়ে করা চুক্তিতে সই করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও মেডলগ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম আনিসুল মিল্লাত।
যা আছে চুক্তিতে: চুক্তি অনুযায়ী, এপিএম টার্মিনালস চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এবং পরিচালনায় ৩৩ বছরের জন্য দায়িত্ব পেয়েছে। এই সময়ের প্রথম তিন বছরে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরবর্তী ৩০ বছর পরিচালনার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পাবলিক-পার্টনারশিপের (পিপিপি) চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া চরে টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ৫৫ কোটি ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ছয় হাজার ৭শ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করবে এপিএম টার্মিনালস। চুক্তি স্বাক্ষরের দিনই সাইনিং মানি হিসেবে ২৫০ কোটি টাকা পেয়েছে বাংলাদেশ।
চুক্তি অনুযায়ী লালদিয়া টার্মিনালে বছরে আট থেকে দশ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা থাকবে। এর মধ্যে আট লাখ পর্যন্ত প্রতি টিইইউএসে বাংলাদেশ পাবে ২১ ডলার করে। এর চেয়ে বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হলে প্রতি টিইইউএসের জন্য ২৩ ডলার করে পাবে বাংলাদেশ।
রাজধানী ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালটি (পিআইসিটি) ২২ বছর পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে মেডলগ এসএ। চুক্তি অনুযায়ী মেডলগ পানগাঁও টার্মিনালে মোট চার কোটি ডলার, যা বর্তমানে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। চুক্তি স্বাক্ষরের দিনই সাইনিং মানি হিসেবে ১৮ কোটি টাকা পেয়েছে বাংলাদেশ।
জানা যায়, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ২০২১ সালের জুনে বাংলাদেশের সঙ্গে ডেনমার্ক সরকারের জি টু জি সমঝোতা হয়। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিপিং কোম্পানি মায়ের্সক লাইন্সের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস। এপিএম টার্মিনালস বিশ্বের ৩৩টি দেশে ৬০টি টার্মিনাল ও বন্দর পরিচালনা করছে।
লালদিয়া ও পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনা নিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে বন্দর বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক সদস্য জাফর আলম বলেন, বিশ্বের বড় বড় দেশের বন্দরগুলো পরিচালনা করছে গ্লোবাল অপারেটররা। ভারতের আটটি বড় বন্দরও পরিচালনা করে গ্লোবাল টার্মিনাল অপারেটররাই। আগে যখন প্রাইভেট বিনিয়োগ পাওয়া যেত না, তখন সরকার নিজের টাকায় বন্দর-টার্মিনাল এগুলো বানাতো। এখন বড় বড় বিনিয়োগ সরকারের করার সময় নেই। তিনি বলেন, ‘বিদেশি অপারেটর বলে কোনো কথা নেই। এগুলো গ্লোবাল অপারেটর। এপিএম টার্মিনালও একটি গ্লোবাল টার্মিনাল। এখন আশপাশের দেশ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, ভারত, পাকিস্তান সব দেশের বন্দর ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল অপারেটররাই অপারেশন করছে। এখন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের বসে থাকার কোনো কারণ নেই।’
এই বন্দর বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, মোট কথা হলো- সরকার কীভাবে দিচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করবে। তবে লালদিয়া গ্লোবাল অপারেটরদের দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। এতে বন্দরগুলো প্রযুক্তিনির্ভর হবে। দেশ এগিয়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা সুবিধা পাবেন।
দুই টার্মিনালের চুক্তির বিষয়ে কথা হলে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘এটি একটি ভালো উদ্যোগ। বিশেষ করে লালদিয়ায় শতভাগ বিনিয়োগকারী আসবে। বর্তমান বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। লালদিয়ার চরটি হলো কর্ণফুলী নদীর মোহনার দিকে। লালদিয়ায় টার্মিনাল হলে ১১ মিটার কিংবা তারও কিছু বেশি ড্রাফটের জাহাজ ঢুকতে পারবে।’
‘ওখানে এপিএম টার্মিনাল জেটি বানালে একটি মডার্ন জেটি হবে। তারা (এপিএম) নিজেদের প্ল্যান অনুযায়ী করবে। বিশ্বে বন্দর পরিচালনায় তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে লালদিয়ায় টার্মিনাল নির্মাণ করবে। এতে অন্যরাও তাদের কাছ থেকে শিখতে পারবে।’
পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যর্থ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পানগাঁও আইসিটিকে অপারেশন করে বন্দর সফল হতে পারেনি। কারণ বন্দরের তো নিজস্ব কনটেইনার নেই। এখন পানগাঁও সুইজারল্যান্ডের মেডলগ এসএকে দেওয়া হয়েছে। মেডলগ একটি আন্তর্জাতিক সুপরিচিত কোম্পানি। তারা (মেডলগ) তাদের টেকনোলজি, গবেষণা পানগাঁওয়ে কাজে লাগাবে। মেডলগের নিজস্ব যেসব কনটেইনার রয়েছে, সেগুলোও যদি তারা পানগাঁওয়ে হ্যান্ডেল করে তাহলে টার্মিনালটি লাভজনক হয়ে উঠবে।’
তিনি বলেন, ‘এপিএম টার্মিনাল মায়ের্কস লাইন্সের প্রতিষ্ঠান। তাতে দেখা যাবে লালদিয়ায় শুধু মায়ের্কস লাইন্সের কনটেইনার হ্যান্ডেল হলেই অন্যদের কনটেইনার নামাতে হবে না। এতে বর্তমান বন্দরের মূল জেটির কনটেইনার জট আরো কমে যাবে। বিদেশি বিনিয়োগ এলে প্রতিযোগিতা বাড়বে। এতে কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জও কমে আসবে।’
সানা/আপ্র/১৯/১১/২০২৫



















