ঢাকা ১২:২১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫

লবণ আন্দোলনে পুরুষদের পেছনে ফেলে নেতৃত্বে ছিলেন নারীরা

  • আপডেট সময় : ০৮:৪৫:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫
  • ৬ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

নারী ও শিশু ডেস্ক: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন’। অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপে ১৯৩০-৩১ সালজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় লবণ সত্যাগ্রহ। এই আন্দোলনে নারীরা যে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন, তা সামনে নিয়ে এসেছে সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া কতগুলো ছবি। এসব ছবিতে প্রমাণ মিলেছে, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া ওই আন্দোলনে নারীরা শুধু অংশগ্রহণই করেননি; বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের পেছনে ফেলে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ১৯৩০ সালে লবণ উৎপাদনে ব্রিটিশ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নোনাজল থেকে লবণ সংগ্রহ করেছিলেন গান্ধী। তার এই কর্মসূচির মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো আইন অমান্য করার আন্দোলনের সূচনা হয়। দেশজুড়ে শুরু হয় বিদেশি পণ্য বর্জন, লবণ উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা অমান্য এবং লাঠিধারী পুলিশের সামনে বিক্ষোভ।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এই আন্দোলনের দুটি দিক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ওই সময়টিতে নারীরা নজিরবিহীন হারে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। শুরুতে গান্ধী তাদের অংশগ্রহণে আপত্তি জানালেও নারী নেত্রীদের চাপে তিনি সিদ্ধান্ত বদলান।

দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস নেতারা রেডিও, চলচ্চিত্র এবং ফটোগ্রাফির মতো আধুনিক মিডিয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে পৌঁছেছিল।

ওই ইতিহাসকেই আবারো সামনে নিয়ে এসেছে দুই দশক আগে লন্ডনের এক নিলামে ওঠা একটি ছোট ছবির অ্যালবাম। ধূসর রঙের ছোট অ্যালবামের মলাটে লেখা ছিল, ‘ওল্ড কংগ্রেস পার্টিকে এল নার্সি’। এই নামটি কার, তা কেউই জানত না। আর টাইপরাইটারে লেখা ক্যাপশনে ছিল অসংখ্য ভুল। তাই অ্যালবামটি দীর্ঘদিন গুরুত্বহীনভাবে অদেখা অবস্থায়ই পড়ে ছিল দিল্লির আলকাজি ফাউন্ডেশনে। ২০১৯ সালে ফাউন্ডেশনের কিউরেটর এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক ওই অ্যালবামটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন এবং রীতিমতো বিস্মিত হন।

ছবিগুলোয় তারা দেখতে পান- ১৯৩০ সালে বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) রাস্তায় উত্তেজনা, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, আহত স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্ধার, বৃষ্টিতে ভিজে মিছিল আর সর্বোপরি নারীদের নেতৃত্ব! গবেষক সুমাথি রামাস্বামী বলেন, ‘প্রথম দেখায়ই নারীদের সক্রিয় উপস্থিতি চোখে পড়ে।’

এক ছবিতে দেখা যায়, গুজরাটের সাহসী কংগ্রেস নেত্রী লীলাবতী মুনশি সরকারি লবণ কেন্দ্র দখল করতে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। অন্য ছবিতে তাকে দেখা যায় একটি ব্রিটিশ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বয়কট কর্মসূচি চালাচ্ছেন। চারপাশে ব্রিটিশ পুলিশ। কিন্তু তিনি তার কর্মসূচিতে অটল। স্লিভলেস ব্লাউজে তার সেই দৃঢ় ভঙ্গি নারীর নতুন আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

নারীরা যে শুধু নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তা নয়, ছবিগুলোয় প্রমাণ পাওয়া যায়- ‘দেশ সেবিকা’ নামে শুধু নারীদের একটি বাহিনী পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে পতাকা রক্ষা করছেন, লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অংশ হিসেবে চৌপাট্টি সৈকতে হাজারো নারী সমুদ্রের পানি থেকে লবণ তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, অনেক নারী নিজেদের সন্তান, বিশেষ করে কন্যাদেরও আন্দোলনে নিয়ে এসেছিলেন, যেন নতুন প্রজন্মও আন্দোলনের চেতনায় গড়ে ওঠে।

ছবিগুলোয় আরো দেখা যায়, বোম্বের রাস্তায় নারীদের লম্বা মিছিল, আর দুই পাশে পুরুষরা দাঁড়িয়ে ছিলেন দর্শকের ভূমিকায়। এই উল্টোচিত্র সমাজের পরিবর্তনকে ইঙ্গিত করেছিল।

গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, শুধু গান্ধী নন; বোম্বের সাধারণ মানুষই এই আন্দোলনকে বৃহৎ রূপ দিয়েছিল। ক্যামেরা সেই সত্যকে ধরেছে, যেখানে দেখা যায়- নারীরা পুলিশের মুখোমুখি, জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন, বয়কট সংগঠিত করছেন, গ্রেফতার হচ্ছেন।

অ্যালবামটিতে তখনকার দিনে বোম্বের নগর রূপও দেখা যায়। বর্তমানে এই ছবিগুলো ‘ফটোগ্রাফিং সিভিল ডিজ-অবিডিয়েন্স’ নামে একটি বইয়ের আকারে নতুনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় এক শতাব্দী পরও ছবিগুলোতে নারীদের দৃঢ়তা, নেতৃত্ব ও আত্মমর্যাদা অম্লান। ছবিগুলো যেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্মৃত নায়িকাদের প্রতি প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিচ্ছে।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

লবণ আন্দোলনে পুরুষদের পেছনে ফেলে নেতৃত্বে ছিলেন নারীরা

আপডেট সময় : ০৮:৪৫:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫

নারী ও শিশু ডেস্ক: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন’। অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপে ১৯৩০-৩১ সালজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় লবণ সত্যাগ্রহ। এই আন্দোলনে নারীরা যে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন, তা সামনে নিয়ে এসেছে সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া কতগুলো ছবি। এসব ছবিতে প্রমাণ মিলেছে, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া ওই আন্দোলনে নারীরা শুধু অংশগ্রহণই করেননি; বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের পেছনে ফেলে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ১৯৩০ সালে লবণ উৎপাদনে ব্রিটিশ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নোনাজল থেকে লবণ সংগ্রহ করেছিলেন গান্ধী। তার এই কর্মসূচির মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো আইন অমান্য করার আন্দোলনের সূচনা হয়। দেশজুড়ে শুরু হয় বিদেশি পণ্য বর্জন, লবণ উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা অমান্য এবং লাঠিধারী পুলিশের সামনে বিক্ষোভ।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এই আন্দোলনের দুটি দিক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ওই সময়টিতে নারীরা নজিরবিহীন হারে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। শুরুতে গান্ধী তাদের অংশগ্রহণে আপত্তি জানালেও নারী নেত্রীদের চাপে তিনি সিদ্ধান্ত বদলান।

দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস নেতারা রেডিও, চলচ্চিত্র এবং ফটোগ্রাফির মতো আধুনিক মিডিয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে পৌঁছেছিল।

ওই ইতিহাসকেই আবারো সামনে নিয়ে এসেছে দুই দশক আগে লন্ডনের এক নিলামে ওঠা একটি ছোট ছবির অ্যালবাম। ধূসর রঙের ছোট অ্যালবামের মলাটে লেখা ছিল, ‘ওল্ড কংগ্রেস পার্টিকে এল নার্সি’। এই নামটি কার, তা কেউই জানত না। আর টাইপরাইটারে লেখা ক্যাপশনে ছিল অসংখ্য ভুল। তাই অ্যালবামটি দীর্ঘদিন গুরুত্বহীনভাবে অদেখা অবস্থায়ই পড়ে ছিল দিল্লির আলকাজি ফাউন্ডেশনে। ২০১৯ সালে ফাউন্ডেশনের কিউরেটর এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক ওই অ্যালবামটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন এবং রীতিমতো বিস্মিত হন।

ছবিগুলোয় তারা দেখতে পান- ১৯৩০ সালে বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) রাস্তায় উত্তেজনা, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, আহত স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্ধার, বৃষ্টিতে ভিজে মিছিল আর সর্বোপরি নারীদের নেতৃত্ব! গবেষক সুমাথি রামাস্বামী বলেন, ‘প্রথম দেখায়ই নারীদের সক্রিয় উপস্থিতি চোখে পড়ে।’

এক ছবিতে দেখা যায়, গুজরাটের সাহসী কংগ্রেস নেত্রী লীলাবতী মুনশি সরকারি লবণ কেন্দ্র দখল করতে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। অন্য ছবিতে তাকে দেখা যায় একটি ব্রিটিশ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বয়কট কর্মসূচি চালাচ্ছেন। চারপাশে ব্রিটিশ পুলিশ। কিন্তু তিনি তার কর্মসূচিতে অটল। স্লিভলেস ব্লাউজে তার সেই দৃঢ় ভঙ্গি নারীর নতুন আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

নারীরা যে শুধু নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তা নয়, ছবিগুলোয় প্রমাণ পাওয়া যায়- ‘দেশ সেবিকা’ নামে শুধু নারীদের একটি বাহিনী পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে পতাকা রক্ষা করছেন, লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অংশ হিসেবে চৌপাট্টি সৈকতে হাজারো নারী সমুদ্রের পানি থেকে লবণ তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, অনেক নারী নিজেদের সন্তান, বিশেষ করে কন্যাদেরও আন্দোলনে নিয়ে এসেছিলেন, যেন নতুন প্রজন্মও আন্দোলনের চেতনায় গড়ে ওঠে।

ছবিগুলোয় আরো দেখা যায়, বোম্বের রাস্তায় নারীদের লম্বা মিছিল, আর দুই পাশে পুরুষরা দাঁড়িয়ে ছিলেন দর্শকের ভূমিকায়। এই উল্টোচিত্র সমাজের পরিবর্তনকে ইঙ্গিত করেছিল।

গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, শুধু গান্ধী নন; বোম্বের সাধারণ মানুষই এই আন্দোলনকে বৃহৎ রূপ দিয়েছিল। ক্যামেরা সেই সত্যকে ধরেছে, যেখানে দেখা যায়- নারীরা পুলিশের মুখোমুখি, জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন, বয়কট সংগঠিত করছেন, গ্রেফতার হচ্ছেন।

অ্যালবামটিতে তখনকার দিনে বোম্বের নগর রূপও দেখা যায়। বর্তমানে এই ছবিগুলো ‘ফটোগ্রাফিং সিভিল ডিজ-অবিডিয়েন্স’ নামে একটি বইয়ের আকারে নতুনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় এক শতাব্দী পরও ছবিগুলোতে নারীদের দৃঢ়তা, নেতৃত্ব ও আত্মমর্যাদা অম্লান। ছবিগুলো যেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্মৃত নায়িকাদের প্রতি প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিচ্ছে।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ