ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ : গত ২৩ দিনে অর্থাৎ চলতি মে মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এপ্রিলের তুলনায় করোনার সংক্রমণরেখা নি¤œমুখী। যেখানে মার্চের শেষ থেকে পুরো এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন সংক্রমণ ও মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছিল, মৃত্যুর সংখ্যা প্রায়ই ১০০ ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, সেখানে গত সপ্তাহে মৃত্যুর সংখ্যা নেমে এসেছে যথাক্রমে ২২ ও ২৫-এ। কমছে সংক্রমণের হারও। এপ্রিল থেকে ঘোষিত বিধিনিষেধ ও লকডাউন কার্যকর করার পর থেকেই দেশে ক্রমশ সংক্রমণের হার কমে আসে। পাশাপাশি সব পর্যায়ে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য নানান প্রচার-প্রচারণা ছিল লক্ষণীয়। তার সুফল আমরা এক মাসের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।
কিন্তু নতুন করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল। সংক্রমণ এড়াতে এই ঈদে ‘কর্মস্থলে অবস্থান’ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ছুটি কমিয়ে ৩ দিনে করা হয়। পাশাপাশি বন্ধ করে দেওয়া হয় গণপরিবহন এবং খুলে দেওয়া হয় শপিং মল। কিন্তু যে দেশের মানুষ, ‘আসি যাই, মাইনে পাই’ প্রবাদে বিশ্বাস করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের সামনে অন্তত ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার জন্য কোনও বিধিনিষেধই ধোপে টেকানো যায়নি। তার প্রমাণ দিচ্ছে পরিসংখ্যান। দৈনিক প্রথম আলোর একটি সংবাদে উঠে এসেছে, সব গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও এ বছর ঈদে ঢাকা ছেড়েছে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ! পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যখন মৃতদেহ সৎকারের জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না, নেপালে যখন অসহায় মানুষ চেয়ে চেয়ে প্রিয়জনের চলে যাওয়া দেখছে, তখন আমরা দেখছি কীভাবে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ হেঁটে, রিকশায়, ভ্যানে, মোটরসাইকেল, পণ্যবাহী ট্রাকে চেপে বাড়ি ফিরছে। কীভাবে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ফেরিতে চেপে নদী পার হচ্ছে। এমনকি হাজার হাজার মানুষ গাদাগাদি করে কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে তাও দেখতে পাচ্ছি। এসব স্থানে ছিল না কোনও সামাজিক দূরত্বের বালাই, বেশিরভাগ মানুষকে সেই অর্থে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতেও দেখা যায়নি। দেশে যখন সংক্রমণের হার কমছে,তখন এহেন পরিস্থিতি আবারও আমাদের এপ্রিল মাসের অবস্থায় নিয়ে যায় কিনা, তা দেখার বিষয়। তাছাড়া, এই মানুষগুলো ঈদ শেষ করে যখন ঢাকায় ফিরছে, তখনও একই দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। সার্বিকভাবে মনে হয়, আমরা করোনা মোকাবিলায় আবারও একটা বিপজ্জনক অবস্থায় পড়তে পারি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মে মাসের শেষ সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য বড় পরীক্ষা- বর্তমান সংক্রমণ অনেকগুণ বেড়ে যাতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, গত এক বছরে করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা অনেক বেড়েছে, তবে তা করোনা যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট নয়। অন্তত ঈদকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া মানুষগুলো করোনা মোকাবিলায় নতুন অন্তরায় সৃষ্টি করবে। করোনা প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞরা যেসব জনস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রস্তাবনা ও পরামর্শ দিয়েছিলেন তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করে আমরা হাসপাতালের মাধ্যমে রোগী সামলানোর দিকে বেশি নজর দিয়েছি। যার কারণে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মহামারি নিয়ন্ত্রণ বা সংক্রমণ রোধে পৃথিবীতে কোনও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি, তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে চলা ও টিকা ব্যবস্থা করা ও মানুষকে টিকা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করাই সমাধান।
বাংলাদেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি : মে মাসের শুরু থেকে দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমতে শুরু করে। ২২ মে পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৭২৬ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ১২ হাজার ৩৪৮ জন। সর্বমোট সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ২৯ হাজার ৭৯৮ জন। করোনার সংক্রমণ রোধে এপ্রিলের শুরুতে ১ সপ্তাহ শর্তসাপেক্ষে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে এর সুফলের আশাই পুরো দেশে আবারও দুই সপ্তাহের জন্য লকডাউন করা হয়। ঈদকে কেন্দ্র করে সকল পরিবহন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু তা যেমন সাধারণ মানুষকে ঢাকা ছাড়তে আটকাতে পারেনি, তেমনই এর ফলাফল কী,তা আমরা নির্দিষ্ট ১৪ দিন পরই মে মাসের শেষে বুঝতে পারবো। তাছাড়া সম্প্রতি আইডিসিআর দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) শনাক্ত করে এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে করোনা সংক্রমণ ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যা বাংলাদেশের জন্য একটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা হতে পারে।
করোনা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত উদ্যোগসমূহ: দেশে করোনা প্রতিরোধে সরকারিভাবে নানান প্রশংসনীয় উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। দেশের জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাত নতুন একটি মহামারি এবং রোগ প্রতিরোধে নিয়ে কাজ করছে যা সরকার গুরুত্ব সহকারে সহায়তা করছে। করোনা মোকাবিলায় দেশব্যাপী হাজার হাজার চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, কয়েক লাখ স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যারা চিকিৎসকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। তৈরি করা হয়েছে করোনা জাতীয় কর্মকৌশল, জাতীয় চিকিৎসা প্রদানের নীতিমালা এবং করোনা সতর্কতায় জনসচেতনতামূলক প্রচারণা ও তথ্য বিতরণ।
অনেক উন্নত দেশগুলো যখন টিকা পেতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন সরকার দেশে বিনামূল্যে করোনার গণটিকা কার্যক্রম শুরু করে। ইতোমধ্যে ৩০ লাখের অধিক মানুষ গ্রহণ করেছেন। প্রথম ডোজের পর এখন দেশব্যাপী দ্বিতীয় ডোজের করোনার টিকা প্রদান কার্যক্রম চলছে এবং আগামীতে আরও ২৫-৩০ লাখ ডোজ টিকা সংগ্রহ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় করে শুরু থেকে নানান কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে করোনার প্রথম ঢেউয়ে ১৩ দফা নির্দেশনা জারি করে, যার চোখে পড়ার মতো ফলাফল এনে দিয়েছিল। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়েও ১৮ দফা নির্দেশনাও এই উদ্যোগের অংশ। এটার সমন্বিত বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনা আক্রান্তদের জন্য পৃথক বেড রাখা, রাজধানীতে করোনা আক্রান্তদের জন্য হাসপাতাল বরাদ্দ করা, কিট সরবরাহ করা, বিদেশ ফেরতদের জন্য কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা, মসজিদ-মন্দিরসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, সকলকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা; ইত্যাদি বিষয়ে শুরু থেকে কাজ করে এসেছে। এছাড়াও করোনা সতর্কতায় জনসচেতনতামূলক প্রচারণা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য বিতরণ ও মিডিয়াগুলো জনস্বাস্থ্যবিদের নিয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
লকডাউনকালে সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি ঘরে ঘরে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেওয়া,খাতওয়ারি প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদান করে অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সর্বোপরি দেশে করোনা আক্রান্তরা যেন ঘরে বসেই বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পান; তার জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার হেল্পলাইনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
এই করোনাকালীন দেশের টেলিহেলথ ও টেলিমেডিসিন সেবা দারুণভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। যেমন, স্বাস্থ্য বাতায়ন-১৬২৬৩ একাই করোনাকালীন এক কোটির অধিক মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকা-কে জোরদার করেছে, যা সরকারের জন্য এক বিশাল অর্জন এবং জনগণ জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছে।
তারপরও কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। সরকারিভাবে জনসাধারণের কাছে করোনার সঠিক তথ্য আসার ক্ষেত্রে বাঁধা ছিল। মানুষ নানান সময়ে নানান মাধ্যম থেকে নতুন নতুন তথ্য পেয়েছে যা তথ্যের বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। সরকারিভাবে এসব তথ্য বিভ্রান্তি মোকাবিলায় কাজ করার সুযোগ ছিল। সেক্ষেত্রে করোনা মোকাবিলা আরও গতি পেতো বলে মনে করি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষগুলোর মাধ্যমে করোনা সারাদেশে কতটা ছড়িয়ে পড়েছে, সেই ঝুঁকি।
সমাধানের পথ : ১) সংক্রমণ হার কমাতে প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা: আগামী ১৪ দিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ৬৫ লাখ মানুষ ছুটি শেষে আবারও ঢাকাসহ সারা দেশে ঢুকেছে এবং ঢুকছে। যেহেতু গণপরিবহনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়নি, তাই ফেরাটা হবে আগের মতো কষ্ট করেই। এবার শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশকেই পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। এত মানুষকে কোয়ারেন্টিন করাও বিশাল চ্যালেঞ্জ। সেক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার পাশাপাশি সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি চলমান বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে।
২) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার: করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্ক্রিনিং, কন্টাক্ট ট্রেসিং, বেশি বেশি পরীক্ষা ও আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। অন্তত আগামী ১ মাস কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে যেসব মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন তাদের স্বেচ্ছায় আইসোলেশনে যেতে হবে। এই কাজে স্বয়ংক্রিয় লোকেশন ট্র্যাকিং মোবাইল অ্যাপও সংযুক্ত থাকে, যার মাধ্যমে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। ইতোমধ্যে বেশি সংক্রমিত দেশগুলো এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ফল পেয়েছে। আমরা আমাদের সংক্রমণপ্রবণ এলাকাগুলোতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারি। টেলিহেলথ সেবা-স্বাস্থ্য বাতায়ন-১৬২৬৩ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
৩) টিকাদান কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি ও বিকল্প টিকার খোঁজ করা: গণটিকা কর্মসূচি প্রয়োজনের তুলনায় ধীরগতিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আমরা একটা টিকার ওপর নির্ভরশীল এবং বিকল্প টিকা সংগ্রহের ব্যবস্থা হলেও তা এখনও হাতে এসে পৌঁছায়নি। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ইতোমধ্যে যারা প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন, তাদের বড় একটি অংশ দ্বিতীয় ডোজের টিকার অপেক্ষায় রয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে টিকা মজুত আছে, তাতে আর সপ্তাহখানেক টিকা কার্যক্রম চালানো যাবে। কিন্তু এখনও ক্রয়কৃত টিকা হাতে না পাওয়ার কারণে টিকাদান সম্ভব হচ্ছে না। সমন্বিতভাবে এগুলো নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ১৩ কোটি মানুষের জন্য অন্তত ২৫ কোটি ডোজের দরকার হবে, তবেই আমরা এই করোনা রোগ প্রতিরোধ করতে পারবো। তবে জরুরিভাবে আগে ৫টা শহরে টিকাদান করা প্রয়োজন, তাতে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটাই কমবে।
৪) বয়োজ্যেষ্ঠদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে : পরিবারে পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তির স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, ৮০ ভাগের ওপরে মৃত্যু ৫০ বছরের বেশি বয়সের মানুষের হচ্ছে। বিনা প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। যারা এই মুহূর্তে করোনায় ভুগছেন অথবা মৃদু উপসর্গ দেখা দিয়েছে; দুই পক্ষকেই হাসপাতাল বা ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। রোগীর অবস্থা খারাপ না হলে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে হবে। টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।
৫) হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় : ভারতের অবস্থা থেকে আমাদের দ্রুত শিক্ষা নিতে হবে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের জোগান দিতে হবে। হাসপাতালে করোনার বেড বাড়াতে হবে, আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর ইত্যাদির সংখ্যা বাড়াতে হবে। করোনা প্রতিরোধে তথ্য প্রদান একটি বড় অন্তরায়। এখনও আমরা কোন হাসপাতালে কতগুলো আইসিইউ বেড আছে, কতগুলো ফাঁকা আছে তার কোনও ডাটাবেজ তৈরি করতে পারিনি। যে কারণে করোনা চিকিৎসায় রোগীদের ভোগান্তি বাড়ছে। রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে আইসিইউ বেডের জন্য ছুটছেন। ডিজিটাল ডাটাবেজের মাধ্যমে এগুলো সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে। রোগী ব্যবস্থাপনায় আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ফ্রন্টলাইনারদের সব সময় প্রস্তুত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় জনবল ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। কোভিড-১৯ চিকিৎসার সাথে যারা কাজ করছেন তাদের উৎসাহিত করতে হবে। টেলিমেডিসিন সেবাকে হাসপাতাল সেবার সাথে সংযুক্ত করতে হবে।
৬) মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি: আমাদের মূল করণীয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাস্ক ব্যবহার করা। আমাদের সার্বক্ষণিক এবং সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ঘরের বাইরে গেলেই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও সংস্থা যেগুলো আছে, তাদের জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসতে হবে। সারা দেশের মসজিদ, মন্দির, মহল্লা, ওয়ার্ড; সবখানে করোনার টিকা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
৭) দেশব্যাপী সারভাইলেন্স সিস্টেম ও করোনা প্রতিরোধে গবেষণা: আমাদের করোনা সংক্রান্ত গবেষণায় মনোযোগ দিতে হবে। তাতে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা যাবে। করোনা পরিস্থিতি ১ বছরের বেশি পার হলেও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে করোনা সতর্কতার বিষয়ে তেমন কোনও ক্যাম্পেইন চোখে পড়েনি। সবার কাছে করোনা প্রতিরোধ বিষয়ক তথ্য পৌঁছে দিতে সকল পর্যায়ে সৃজনশীল প্রচারণা দরকার। সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা; এমনকি করপোরেট সংস্থাগুলোও এ কাজে এগিয়ে আসতে পারে। আমরা যতভাবে মানুষের কাছে যেতে পারবো, তত তারা সতর্ক হবে; প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনাও জোরদার হবে।
৮) সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন: দেশে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ প্রণীত হয়েছে। করোনা মহামারিতে সময় এসেছে এই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের। আইনের উদ্দেশ্য পূরণে বিশেষ করে এর ৫ অনুচ্ছেদের ক ও ঘ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল এবং এর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিস্তার থেকে জনগণকে সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে কর্মকৌশল প্রণয়নসহ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সংক্রমিত এলাকাকে সংক্রমণমুক্ত এলাকা থেকে পৃথককরণ, সংক্রমণমুক্ত এলাকায় উক্ত রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ এবং আক্রান্ত এলাকায় পুনঃআবির্ভাব প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির অধীনে আনতে হবে।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন।