ঢাকা ০৩:৫৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫

রৌমারী থেকে পিলখানা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব

  • আপডেট সময় : ০৫:৩৮:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৪৪ বার পড়া হয়েছে

জাকির মজুমদার : আমি তখন ৩০ বছরের যুবক। ক্রাইসিস বা ঘটনা মূল্যায়নের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ভূ-রাজনীতির বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা তেমন ছিল না। সাংবাদিকতার পাঠও ততটা শক্তপোক্ত হয়নি। মফস্বল সাংবাদিকতার ইতি ঘটিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করেছি সবেমাত্র দুই বছর। একটি দৈনিক পত্রিকার ফিচার ডেস্কে চাকরি করছি। ২০০৯ সালে ফেব্রুয়ারির ২৫ ও ২৬ তারিখে বিডিআর হেডকোয়ার্টার পিলখানায় ম্যাসাকার হলো। প্রথম সপ্তাহে পুরো ঘটনার পর্যবেক্ষণ শেষে বলেছিলাম, এটি কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়ির রৌমারী সীমান্তে বিডিআর-বিএসএফ সংঘটিত ঘটনার প্রতিশোধ। আজও আমার অবস্থান একই। তবে এর সঙ্গে আরও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র যে ছিল, সাড়ে ১৭ বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সেই অনুমানকে স্পষ্ট করেছে।

তখন নিজ জেলার বহুল প্রচারিত একটি পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে পিলখানা ম্যাসাকারে ভারতের যোগসন্ধির বিষয়টি অগ্রাহ্য করার ফুরসত নেই বলে উল্লেখ করেছিলাম। এর প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে তখন বেশ বেগ পেতে হয়েছে। পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিলের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল। অবশ্য অঙ্গীকারনামা-মুচলেকায় প্রকাশনা টিকে যায়।

ভারত-বাংলাদেশ রৌমারী সীমান্ত। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল। ভোর ৫টা। বিএসএফ সদস্যরা আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখা পেরিয়ে বাংলাদেশের বড়াইবাড়ি গ্রামে প্রবেশ করে। ভারী অস্ত্রসজ্জিত বেশ বড় একটি বাহিনীকে তাৎক্ষণিক বিডিআর সদস্যরা প্রতিরোধ করে। শুরু হয় সীমান্ত যুদ্ধ। ১৮ এপ্রিল ভোর ৫টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বিএসএফ ও বিডিআরের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এরপর থেমে থেমে পরদিন ১৯ এপ্রিল গভীর রাত পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। দুদিন পর দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর বৈঠকে সীমান্ত যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ব্যাপক হতাহতের শিকার হয়। বাংলাদেশের ভেতর থেকেই বিএসএফের ১৬ সদস্যের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যা পরে বিএসএফকে হস্তান্তর করা হয়। মিথ আছে, এই সীমান্ত যুদ্ধে ভারতের অভ্যন্তরে বেশসংখ্যক বিএসএফ সদস্যের মরদেহ উদ্ধার হয়। বিপরীতে বাংলাদেশের দুইজন বিডিআর সদস্য নিহত হয়েছিলেন।

বিবিসি বাংলাকে রৌমারী সীমান্ত যুদ্ধের প্রেক্ষিত বর্ণনা করেন তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান (বিবিসি বাংলা, ১৮ এপ্রিল ২০২১)। সাক্ষাৎকারের সারমর্ম হলো- সিলেটের পদুয়া সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিএসএফ একটি ক্যাম্প তৈরি করে রেখেছিল। এরপর ২০০১ সালের প্রথম দিকে ভারতের বিএসএফ পদুয়া সীমান্তে তাদের পাশের আরেকটি ক্যাম্পের সাথে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ শুরু করে। বিডিআর বাধা দেয়। কিন্ত বিএসএফ কর্ণপাত করেনি। এই অবস্থায় বিডিআর ওই এলাকায় একটি অস্থায়ী অপারেশনাল ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। তা বাস্তবায়ন করতে গেলে বিএসএফ বিডিআরকে উদ্দেশ্য করে ফায়ার করে। বিডিআরের পাল্টা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সীমান্তে থাকা বিএসএফের প্রায় ৭০ সদস্য একপর্যায়ে আত্মসমর্পণ করে। ফলে ১৯৭২ সালের পর থেকে বিএসএফের দখলে থাকা সিলেটের পদুয়া ক্যাম্প ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল বিডিআর দখলে নেয়। পদুয়ার ঘটনার জেরে দুই দিনের ব্যবধানে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তের বড়ইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্প দখলের জন্য বিএসএফ বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে। ফলে তাদের সঙ্গে বিডিআরের রৌমারী সীমান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

২০০১ সালে সিলেটের পদুয়া এবং রৌমারী সীমান্তে বিএসএফ-বিডিআরের সংঘটিত ঘটনার সময়টি আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ী বছর ছিল। রৌমারী সীমান্ত প্রতিরোধ যুদ্ধের দুই মাস ২৩ দিন পর ক্ষমতা ছাড়ার আগ মুহূর্তে ১১ জুলাই বিডিআর প্রধানের পদ থেকে আ ল ম মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানকে সরিয়ে দেন শেখ হাসিনা।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ও অষ্টম জাতীয় সংসদের শেষ দিন। এদিনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার তাণ্ডব ও জীবন্ত মানুষের ওপর পৈষাচিকতা মানবতার জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এদিন থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে পরিকল্পিতভাবে সংঘাত ও সংকটের দিকে ধাবিত করা হয়। যার হাত ধরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি ও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী। যা সেনা সমর্থিত ফরুদ্দিন আহমেদ ও সেনাপ্রধান মঈনুদ্দিন আহমেদের সরকার আখ্যা পায়। এই সরকারকে স্বাগত ও সমর্থন জানায় আওয়ামী লীগ। ইসলাম তথা ডানপন্থাকে কোণঠাসায় কথিত সন্ত্রাবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (ওয়ার অ্যান্ড টেরর) নীতি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনসহ পশ্চিমা শক্তির দক্ষিণ এশিয়ার মিত্র ভারত বাংলাদেশের রাজনীতির নয়া মেরুকরণ ও ক্ষমতা পরিবর্তনে প্রকাশ্যে কিং মেকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ওইসকল বিশ্বশক্তির সমর্থিত ফখরুদ্দিন ও মঈনুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৬৩ আসনে নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে।

দ্বিতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র এক মাস ২০ দিনের মাথায় ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের আধা সামরিক বাহিনীর হেডকোয়ার্টার রাজধানীর পিলখানায় নির্মম-নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো। বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা ও ১৭ জন বেসামরিক লোক নিহত হন। শেখ হাসিনার ক্ষমতাগ্রহণের হানিমুন পিরিয়ডে বিডিআর ধ্বংস এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার নীল-নকশা বাস্তবায়ন হলো বলা যায়। যা রৌমারী সীমান্ত যুদ্ধের প্রতিশোধ হিসেবে আমরা তখনই আঁচ করতে পেরেছি। অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের প্রতিবাদ, শতভাগ রেশনিং দাবি এবং উচ্চ পদে বিডিআর সদস্যদের পদন্নোতিসহ ২২ দফা দাবিতে কথিত বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা নিধন ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। শুরুতেই কথিত বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়নি। বরং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে ৪৮ ঘণ্টা পর সেনা হত্যার মিশন বাস্তবায়নকারীদের পলায়নও নিশ্চিত করা হয়। আজও মাস্টার মাইন্ডদের শনাক্ত করা হয়নি।

পিলখানার ম্যাসাকার ছিল মূলত অভ্যন্তরীণ ও ভূরাজনীতির স্বার্থ হাসিলের মিশন। এর ধারাবাহিকতায় নির্বাচন ও ভোটব্যবস্থা ধ্বংস, বিরোধী দলগুলোকে নেতৃত্বশূন্য, দমন-পীড়ন-নির্যাতনে বিরোধীদের শক্তিহীন করা, গণতন্ত্র হরণসহ শেখ হাসিনার স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা এবং বাংলাদেশে ভারতের বাধাহীন নিরঙ্কুশ স্বার্থ উদ্ধারের পথকে সুগম করা গেছে। বিগত দেড় দশকের বেশি সময়কাল হাসিনার স্বৈরশাসন এবং বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব ও বাধাহীন আধিপত্য চোখে আঙুল দিয়ে পিলখানার নৃশংসতায় ভারতের যোগসন্ধির অনুমানকে সত্য প্রমাণ করেছে।
পিলখানা ম্যাসাকারের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি এই দুষ্টচক্র বাংলাদেশের শক্তিধর ও দেশপ্রেমিক সীমান্তরক্ষা বাহিনীকে দুর্বল করেছে। সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে মুখোমুখি করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। দুই বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস-অনাস্থা তৈরি করে আন্তঃবাহিনীর শক্তিশালী ঐক্যের দৃঢ়তাকে দুর্বল করেছে। শুধু কি তাই? দেশপ্রেমিক ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা এবং পরবর্তী সময়ে বেশসংখ্যক সেনা কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত, জঙ্গি ট্যাগে অপসারণ করা হয়।

বিপরীতে সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে তাবেদার, নতজানু, অর্থলিপ্সু ও ভারতের ক্রীড়নকদের পদায়ন-পুনর্বাসন করা হয়। এসব কিছুর মূলে ছিল মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানদের মতো দেশপ্রেমিক চৌকস শক্তিশালী সেনা কমান্ড যেন তৈরি না হয়। বাংলাদেশের সামরিক শক্তি যেন শক্তভিত্তি না পায়। বাংলাদেশের সীমান্ত যেন অরক্ষিত হয়ে পড়ে। আমরা সাড়ে ১৫ বছর এর নজিরও দেখেছি। সীমান্তে ভারতের যথেচ্ছার উপদ্রব বেড়েছিলো। সীমান্তের কাঁটাতারে ফেলানীর ঝুলন্ত রক্তাক্ত মরদেহ অন্যতম উদাহরণ।
পিলখানা ম্যাসাকার নিয়ে গঠিত কমিটির কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। কেন এসব অন্ধকারে রাখা হয়েছে তা অন্তবর্তী সরকারকে বের করতে হবে। ওই সময়ের তদন্ত সংশ্লিষ্টদের তলব করুন। তারা পিলখানার ম্যাসাকারের জ্বলন্ত উইনেস বা সাক্ষী। বিডিআর ম্যাসাকারে গঠিত কমিশনকে গতিশীল করুন।

চব্বিশের গণহত্যার অনুসন্ধানের ন্যায় পিলখানার ঘটনা তদন্তে, দোষীদের শনাক্তে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের সহযোগিতা নিন। দুষ্টচক্রের মুখোশ উন্মোচন করুন। সত্য প্রকাশ করুন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করুন। পিলখানায় হত্যার শিকার ও ন্যায়বিচার বঞ্চিতদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করুন। অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতদের চাকরি ফিরিয়ে দিন। নিরাপরাধ বন্দিদের মুক্তি দিন। ২৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শোক দিবস বা সেনা গণহত্যা দিবস ঘোষণা করুন।

লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

রৌমারী থেকে পিলখানা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব

আপডেট সময় : ০৫:৩৮:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

জাকির মজুমদার : আমি তখন ৩০ বছরের যুবক। ক্রাইসিস বা ঘটনা মূল্যায়নের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ভূ-রাজনীতির বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা তেমন ছিল না। সাংবাদিকতার পাঠও ততটা শক্তপোক্ত হয়নি। মফস্বল সাংবাদিকতার ইতি ঘটিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করেছি সবেমাত্র দুই বছর। একটি দৈনিক পত্রিকার ফিচার ডেস্কে চাকরি করছি। ২০০৯ সালে ফেব্রুয়ারির ২৫ ও ২৬ তারিখে বিডিআর হেডকোয়ার্টার পিলখানায় ম্যাসাকার হলো। প্রথম সপ্তাহে পুরো ঘটনার পর্যবেক্ষণ শেষে বলেছিলাম, এটি কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়ির রৌমারী সীমান্তে বিডিআর-বিএসএফ সংঘটিত ঘটনার প্রতিশোধ। আজও আমার অবস্থান একই। তবে এর সঙ্গে আরও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র যে ছিল, সাড়ে ১৭ বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সেই অনুমানকে স্পষ্ট করেছে।

তখন নিজ জেলার বহুল প্রচারিত একটি পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে পিলখানা ম্যাসাকারে ভারতের যোগসন্ধির বিষয়টি অগ্রাহ্য করার ফুরসত নেই বলে উল্লেখ করেছিলাম। এর প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে তখন বেশ বেগ পেতে হয়েছে। পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিলের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল। অবশ্য অঙ্গীকারনামা-মুচলেকায় প্রকাশনা টিকে যায়।

ভারত-বাংলাদেশ রৌমারী সীমান্ত। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল। ভোর ৫টা। বিএসএফ সদস্যরা আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখা পেরিয়ে বাংলাদেশের বড়াইবাড়ি গ্রামে প্রবেশ করে। ভারী অস্ত্রসজ্জিত বেশ বড় একটি বাহিনীকে তাৎক্ষণিক বিডিআর সদস্যরা প্রতিরোধ করে। শুরু হয় সীমান্ত যুদ্ধ। ১৮ এপ্রিল ভোর ৫টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বিএসএফ ও বিডিআরের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এরপর থেমে থেমে পরদিন ১৯ এপ্রিল গভীর রাত পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। দুদিন পর দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর বৈঠকে সীমান্ত যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ব্যাপক হতাহতের শিকার হয়। বাংলাদেশের ভেতর থেকেই বিএসএফের ১৬ সদস্যের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যা পরে বিএসএফকে হস্তান্তর করা হয়। মিথ আছে, এই সীমান্ত যুদ্ধে ভারতের অভ্যন্তরে বেশসংখ্যক বিএসএফ সদস্যের মরদেহ উদ্ধার হয়। বিপরীতে বাংলাদেশের দুইজন বিডিআর সদস্য নিহত হয়েছিলেন।

বিবিসি বাংলাকে রৌমারী সীমান্ত যুদ্ধের প্রেক্ষিত বর্ণনা করেন তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান (বিবিসি বাংলা, ১৮ এপ্রিল ২০২১)। সাক্ষাৎকারের সারমর্ম হলো- সিলেটের পদুয়া সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিএসএফ একটি ক্যাম্প তৈরি করে রেখেছিল। এরপর ২০০১ সালের প্রথম দিকে ভারতের বিএসএফ পদুয়া সীমান্তে তাদের পাশের আরেকটি ক্যাম্পের সাথে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ শুরু করে। বিডিআর বাধা দেয়। কিন্ত বিএসএফ কর্ণপাত করেনি। এই অবস্থায় বিডিআর ওই এলাকায় একটি অস্থায়ী অপারেশনাল ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। তা বাস্তবায়ন করতে গেলে বিএসএফ বিডিআরকে উদ্দেশ্য করে ফায়ার করে। বিডিআরের পাল্টা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সীমান্তে থাকা বিএসএফের প্রায় ৭০ সদস্য একপর্যায়ে আত্মসমর্পণ করে। ফলে ১৯৭২ সালের পর থেকে বিএসএফের দখলে থাকা সিলেটের পদুয়া ক্যাম্প ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল বিডিআর দখলে নেয়। পদুয়ার ঘটনার জেরে দুই দিনের ব্যবধানে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তের বড়ইবাড়ি বিডিআর ক্যাম্প দখলের জন্য বিএসএফ বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে। ফলে তাদের সঙ্গে বিডিআরের রৌমারী সীমান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

২০০১ সালে সিলেটের পদুয়া এবং রৌমারী সীমান্তে বিএসএফ-বিডিআরের সংঘটিত ঘটনার সময়টি আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ী বছর ছিল। রৌমারী সীমান্ত প্রতিরোধ যুদ্ধের দুই মাস ২৩ দিন পর ক্ষমতা ছাড়ার আগ মুহূর্তে ১১ জুলাই বিডিআর প্রধানের পদ থেকে আ ল ম মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানকে সরিয়ে দেন শেখ হাসিনা।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ও অষ্টম জাতীয় সংসদের শেষ দিন। এদিনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার তাণ্ডব ও জীবন্ত মানুষের ওপর পৈষাচিকতা মানবতার জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এদিন থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে পরিকল্পিতভাবে সংঘাত ও সংকটের দিকে ধাবিত করা হয়। যার হাত ধরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি ও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী। যা সেনা সমর্থিত ফরুদ্দিন আহমেদ ও সেনাপ্রধান মঈনুদ্দিন আহমেদের সরকার আখ্যা পায়। এই সরকারকে স্বাগত ও সমর্থন জানায় আওয়ামী লীগ। ইসলাম তথা ডানপন্থাকে কোণঠাসায় কথিত সন্ত্রাবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (ওয়ার অ্যান্ড টেরর) নীতি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনসহ পশ্চিমা শক্তির দক্ষিণ এশিয়ার মিত্র ভারত বাংলাদেশের রাজনীতির নয়া মেরুকরণ ও ক্ষমতা পরিবর্তনে প্রকাশ্যে কিং মেকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ওইসকল বিশ্বশক্তির সমর্থিত ফখরুদ্দিন ও মঈনুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৬৩ আসনে নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে।

দ্বিতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র এক মাস ২০ দিনের মাথায় ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের আধা সামরিক বাহিনীর হেডকোয়ার্টার রাজধানীর পিলখানায় নির্মম-নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো। বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা ও ১৭ জন বেসামরিক লোক নিহত হন। শেখ হাসিনার ক্ষমতাগ্রহণের হানিমুন পিরিয়ডে বিডিআর ধ্বংস এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার নীল-নকশা বাস্তবায়ন হলো বলা যায়। যা রৌমারী সীমান্ত যুদ্ধের প্রতিশোধ হিসেবে আমরা তখনই আঁচ করতে পেরেছি। অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের প্রতিবাদ, শতভাগ রেশনিং দাবি এবং উচ্চ পদে বিডিআর সদস্যদের পদন্নোতিসহ ২২ দফা দাবিতে কথিত বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা নিধন ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। শুরুতেই কথিত বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়নি। বরং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে ৪৮ ঘণ্টা পর সেনা হত্যার মিশন বাস্তবায়নকারীদের পলায়নও নিশ্চিত করা হয়। আজও মাস্টার মাইন্ডদের শনাক্ত করা হয়নি।

পিলখানার ম্যাসাকার ছিল মূলত অভ্যন্তরীণ ও ভূরাজনীতির স্বার্থ হাসিলের মিশন। এর ধারাবাহিকতায় নির্বাচন ও ভোটব্যবস্থা ধ্বংস, বিরোধী দলগুলোকে নেতৃত্বশূন্য, দমন-পীড়ন-নির্যাতনে বিরোধীদের শক্তিহীন করা, গণতন্ত্র হরণসহ শেখ হাসিনার স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা এবং বাংলাদেশে ভারতের বাধাহীন নিরঙ্কুশ স্বার্থ উদ্ধারের পথকে সুগম করা গেছে। বিগত দেড় দশকের বেশি সময়কাল হাসিনার স্বৈরশাসন এবং বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব ও বাধাহীন আধিপত্য চোখে আঙুল দিয়ে পিলখানার নৃশংসতায় ভারতের যোগসন্ধির অনুমানকে সত্য প্রমাণ করেছে।
পিলখানা ম্যাসাকারের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি এই দুষ্টচক্র বাংলাদেশের শক্তিধর ও দেশপ্রেমিক সীমান্তরক্ষা বাহিনীকে দুর্বল করেছে। সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে মুখোমুখি করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। দুই বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস-অনাস্থা তৈরি করে আন্তঃবাহিনীর শক্তিশালী ঐক্যের দৃঢ়তাকে দুর্বল করেছে। শুধু কি তাই? দেশপ্রেমিক ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা এবং পরবর্তী সময়ে বেশসংখ্যক সেনা কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত, জঙ্গি ট্যাগে অপসারণ করা হয়।

বিপরীতে সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে তাবেদার, নতজানু, অর্থলিপ্সু ও ভারতের ক্রীড়নকদের পদায়ন-পুনর্বাসন করা হয়। এসব কিছুর মূলে ছিল মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানদের মতো দেশপ্রেমিক চৌকস শক্তিশালী সেনা কমান্ড যেন তৈরি না হয়। বাংলাদেশের সামরিক শক্তি যেন শক্তভিত্তি না পায়। বাংলাদেশের সীমান্ত যেন অরক্ষিত হয়ে পড়ে। আমরা সাড়ে ১৫ বছর এর নজিরও দেখেছি। সীমান্তে ভারতের যথেচ্ছার উপদ্রব বেড়েছিলো। সীমান্তের কাঁটাতারে ফেলানীর ঝুলন্ত রক্তাক্ত মরদেহ অন্যতম উদাহরণ।
পিলখানা ম্যাসাকার নিয়ে গঠিত কমিটির কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। কেন এসব অন্ধকারে রাখা হয়েছে তা অন্তবর্তী সরকারকে বের করতে হবে। ওই সময়ের তদন্ত সংশ্লিষ্টদের তলব করুন। তারা পিলখানার ম্যাসাকারের জ্বলন্ত উইনেস বা সাক্ষী। বিডিআর ম্যাসাকারে গঠিত কমিশনকে গতিশীল করুন।

চব্বিশের গণহত্যার অনুসন্ধানের ন্যায় পিলখানার ঘটনা তদন্তে, দোষীদের শনাক্তে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের সহযোগিতা নিন। দুষ্টচক্রের মুখোশ উন্মোচন করুন। সত্য প্রকাশ করুন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করুন। পিলখানায় হত্যার শিকার ও ন্যায়বিচার বঞ্চিতদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করুন। অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতদের চাকরি ফিরিয়ে দিন। নিরাপরাধ বন্দিদের মুক্তি দিন। ২৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শোক দিবস বা সেনা গণহত্যা দিবস ঘোষণা করুন।

লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক