ঢাকা ০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

রোহিঙ্গাদের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে নীরব ষড়যন্ত্র

  • আপডেট সময় : ০৬:২০:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ২০ বার পড়া হয়েছে

মীর আব্দুল আলীম : ঘুস খেয়ে ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ভোটার বানানের বিয়ষটি জাতীয় পত্রিকায় উঠে আসে। বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ভোটার করার বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা, যারা জাতিসংঘের শরণার্থী তালিকায় নিবন্ধিত, তারা কিভাবে বাংলাদেশের জাতীয় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো, সেটি জাতির জন্য একটি গুরুতর প্রশ্ন।

এর পেছনে কারা জড়িত এবং কীভাবে এমন একটি রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ সংঘটিত হলো, তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। এ ঘটনাটি রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের জাতীয় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘটনা আমাদের রাজনীতি, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতার একটি ভয়াবহ উদাহরণ।

প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিকত্বের ন্যূনতম যোগ্যতা ছাড়াই কীভাবে ভোটার হলো, তা নিয়ে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। বিষয়টি শুধু আইন লঙ্ঘনের ঘটনা নয়, এটি রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ড। এমন একটি ঘটনার মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা গভীর হুমকির মুখে পড়েছে।
কারা এর সাথে সম্পৃক্ত: ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ভোটার করার ঘটনা কোনো একক ব্যক্তির কাজ নয়।

এর সঙ্গে দেশের ভেতরের একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত, যারা ঘুষের বিনিময়ে এই অপরাধ সংঘটিত করেছে।
এনআইডি কার্যালয়ের দায়িত্বশীল কতিপয় কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মচারী এবং একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের সহযোগিতা ছাড়া এত বড় অনৈতিক কাজ সম্ভব নয়। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তারা মূলত রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশীদার। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অন্য কোনো দেশের শরণার্থীদের দিতে যাওয়া রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গারা এ দেশের নাগরিক হওয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা মানে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থকে বিপন্ন করা। এটি কেবল ভোটার তালিকা দূষিত করার বিষয় নয়, বরং দেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।

এ পরিস্থিতিতে কী করণীয়: ১. রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকা থেকে দ্রুত বাদ দেওয়ার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা। ২. যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। ৩. এনআইডি প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করা। ৪. ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশ রোধে কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিশেষ নজরদারি বাড়ানো। ৫. স্থানীয় জনগণের অধিকার রক্ষা এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে কোনো অপরাধমূলক কার্যক্রম কঠোর হাতে দমন করা। রোহিঙ্গাদের ভোটার করার ঘটনা শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য একটি চরম হুমকি। এ ঘটনাটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের সবার দায়বদ্ধতা রয়েছে। দেশের সুরক্ষা, জনগণের অধিকার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য এই দায়বদ্ধতা ভুলে গেলে চলবে না।

রোহিঙ্গাদের ভোটার এনআইডির ভবিষ্যৎ: ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার ভোটার হওয়া প্রমাণ করে, আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবস্থায় গভীর ফাঁকফোকর রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, তাদের ভোটার আইডিগুলো কীভাবে বাতিল করা হবে? যারা ভোটার হয়েছে, তারা হয়তো ইতোমধ্যেই নাগরিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ শুরু করেছে। দ্রুত এই পরিচয়পত্র বাতিল না করলে ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
রাজনৈতিক ফায়দা: অনেকের মতে, রোহিঙ্গাদের ভোটার করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ভোট বাড়ানো। বিশেষ করে, নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করার জন্য তাদের ভোটার বানানোর অভিযোগ উঠেছে। যদি এ অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে এটি শুধু রাজনৈতিক নয়; রাষ্ট্রীয় অপরাধ হিসেবেও গণ্য হবে।

সমস্যা: ১. দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও এনআইডি কার্যালয় রোহিঙ্গাদের ভোটার করা সম্ভব হয়েছে প্রশাসন ও এনআইডি কার্যালয়ের কিছু অসৎ কর্মকর্তার মাধ্যমে। যারা ঘুষের বিনিময়ে এই কাজ করেছে, তারা কেবল আইন ভাঙেনি, বরং রাষ্ট্রীয় সিস্টেমকে দুর্বল করেছে। এমন দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভোটার তালিকাকে ভুয়া ও বিতর্কিত করে তুলছে। ২. রাজনৈতিক ফায়দার অপকৌশল: রোহিঙ্গাদের ভোটার করার পেছনে একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহলের উদ্দেশ্য ছিল। অভিযোগ রয়েছে, নৌকা প্রতীকে ভোট বাড়ানোর জন্য তাদের এই কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। এটি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল করে। ৩. রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি: রোহিঙ্গাদের মধ্যে ইতোমধ্যে মাদক পাচার, মানব পাচার এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ রয়েছে। ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্তি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগের প্রবেশাধিকার দেবে, যা এই অপরাধগুলো আরও বাড়িয়ে তুলবে। ৪. স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা হুমকির মুখে: কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা এবং সম্পত্তির ওপর প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার বানানোর ফলে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ৫. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে: যে কোনো দেশের নাগরিকত্ব তার সার্বভৌমত্বের পরিচায়ক। রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে ভবিষ্যতে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতায়ও প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। ৬. ভোটার তালিকার বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষতি: একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য পরিচ্ছন্ন ও নির্ভুল ভোটার তালিকা অপরিহার্য। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হলে সাধারণ মানুষ ভোটার তালিকা ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারাবে। ৭. আন্তর্জাতিক চাপে পড়ার আশঙ্কা: রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধারণা করতে পারে, বাংলাদেশ ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার কৌশল দুর্বল হয়ে পড়বে। ৮. আদালতের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি: রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার ঘটনা বিচারব্যবস্থারও চ্যালেঞ্জ। যদি রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে এই ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণের মধ্যে বিচারব্যবস্থার ওপর অনাস্থা সৃষ্টি হবে। ৯. মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সামাজিক বৈষম্য: রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিলে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বৈষম্য তৈরি হবে। স্থানীয় মানুষ তাদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে হুমকির মুখে পড়বে। ১০. অবৈধ নাগরিকত্বের ঝুঁকি: রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ায় তারা ভবিষ্যতে পাসপোর্টসহ অন্যান্য সরকারি সেবার সুযোগ পাবে। এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

সমাধান কী: ১. তদন্ত কমিটি গঠন ও শাস্তি নিশ্চিত করা: এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং দালালদের চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা জরুরি। ২. ভোটার তালিকা পর্যালোচনা করা: রোহিঙ্গাদের ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য ভোটার তালিকায় বিশেষ নজরদারি বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। ৩. এনআইডি ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি নির্ভরতা: এনআইডি প্রক্রিয়ায় বায়োমেট্রিক ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে কোনো বিদেশি নাগরিক বা শরণার্থী সহজে এনআইডি পেতে সক্ষম হবে না। ৪. রোহিঙ্গাদের জন্য পৃথক শনাক্তকরণ ব্যবস্থা: রোহিঙ্গাদের জন্য একটি পৃথক শনাক্তকরণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যা ভোটার তালিকা বা নাগরিক পরিচয়ে ব্যবহৃত হবে না। ৫. স্থানীয় প্রশাসনের কার্যক্রম জোরদার করা: কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কমানোর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ৬. আইন ও শাস্তি আরও কঠোর করা: রোহিঙ্গাদের ভোটার করা বা এ ধরনের কাজে সহযোগিতা করলে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা জরুরি। ৭. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা: রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক মহলকে আরও সক্রিয় করতে হবে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে। ৮. জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা: সাধারণ জনগণকে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। ৯. সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করা: রোহিঙ্গাদের পুনরায় প্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ১০. নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা: নির্বাচন কমিশনের কাজের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা বাড়াতে স্বাধীন মনিটরিং কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
উপসংহার: রোহিঙ্গাদের ভোটার করা কেবল একটি প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক অপরাধ নয়, এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করার শামিল। এই ঘটনার মাধ্যমে আমাদের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং রাজনীতির অপব্যবস্থার চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। এখন সময় এসেছে এসব সমস্যার কার্যকর সমাধান নেওয়ার।
যদি আমরা এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেই, তবে ভবিষ্যতে এ ঘটনা আরও বড় সংকট সৃষ্টি করতে পারে। রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, দায়ীদের শাস্তি প্রদান, এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি। দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের উচিত এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা।

লেখক: সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক এবং মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
িি.িসরৎধনফঁষধষরস.পড়স

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

মব বন্ধ না করলে ডেভিল হিসেবে ট্রিট করবো: উপদেষ্টা মাহফুজ

রোহিঙ্গাদের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে নীরব ষড়যন্ত্র

আপডেট সময় : ০৬:২০:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

মীর আব্দুল আলীম : ঘুস খেয়ে ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ভোটার বানানের বিয়ষটি জাতীয় পত্রিকায় উঠে আসে। বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ভোটার করার বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা, যারা জাতিসংঘের শরণার্থী তালিকায় নিবন্ধিত, তারা কিভাবে বাংলাদেশের জাতীয় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো, সেটি জাতির জন্য একটি গুরুতর প্রশ্ন।

এর পেছনে কারা জড়িত এবং কীভাবে এমন একটি রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ সংঘটিত হলো, তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। এ ঘটনাটি রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের জাতীয় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘটনা আমাদের রাজনীতি, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতার একটি ভয়াবহ উদাহরণ।

প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিকত্বের ন্যূনতম যোগ্যতা ছাড়াই কীভাবে ভোটার হলো, তা নিয়ে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। বিষয়টি শুধু আইন লঙ্ঘনের ঘটনা নয়, এটি রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ড। এমন একটি ঘটনার মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা গভীর হুমকির মুখে পড়েছে।
কারা এর সাথে সম্পৃক্ত: ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ভোটার করার ঘটনা কোনো একক ব্যক্তির কাজ নয়।

এর সঙ্গে দেশের ভেতরের একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত, যারা ঘুষের বিনিময়ে এই অপরাধ সংঘটিত করেছে।
এনআইডি কার্যালয়ের দায়িত্বশীল কতিপয় কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মচারী এবং একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের সহযোগিতা ছাড়া এত বড় অনৈতিক কাজ সম্ভব নয়। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তারা মূলত রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশীদার। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অন্য কোনো দেশের শরণার্থীদের দিতে যাওয়া রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গারা এ দেশের নাগরিক হওয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা মানে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থকে বিপন্ন করা। এটি কেবল ভোটার তালিকা দূষিত করার বিষয় নয়, বরং দেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।

এ পরিস্থিতিতে কী করণীয়: ১. রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকা থেকে দ্রুত বাদ দেওয়ার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা। ২. যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। ৩. এনআইডি প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করা। ৪. ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশ রোধে কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিশেষ নজরদারি বাড়ানো। ৫. স্থানীয় জনগণের অধিকার রক্ষা এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে কোনো অপরাধমূলক কার্যক্রম কঠোর হাতে দমন করা। রোহিঙ্গাদের ভোটার করার ঘটনা শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য একটি চরম হুমকি। এ ঘটনাটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কখনো এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের সবার দায়বদ্ধতা রয়েছে। দেশের সুরক্ষা, জনগণের অধিকার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য এই দায়বদ্ধতা ভুলে গেলে চলবে না।

রোহিঙ্গাদের ভোটার এনআইডির ভবিষ্যৎ: ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার ভোটার হওয়া প্রমাণ করে, আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবস্থায় গভীর ফাঁকফোকর রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, তাদের ভোটার আইডিগুলো কীভাবে বাতিল করা হবে? যারা ভোটার হয়েছে, তারা হয়তো ইতোমধ্যেই নাগরিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ শুরু করেছে। দ্রুত এই পরিচয়পত্র বাতিল না করলে ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
রাজনৈতিক ফায়দা: অনেকের মতে, রোহিঙ্গাদের ভোটার করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ভোট বাড়ানো। বিশেষ করে, নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করার জন্য তাদের ভোটার বানানোর অভিযোগ উঠেছে। যদি এ অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে এটি শুধু রাজনৈতিক নয়; রাষ্ট্রীয় অপরাধ হিসেবেও গণ্য হবে।

সমস্যা: ১. দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও এনআইডি কার্যালয় রোহিঙ্গাদের ভোটার করা সম্ভব হয়েছে প্রশাসন ও এনআইডি কার্যালয়ের কিছু অসৎ কর্মকর্তার মাধ্যমে। যারা ঘুষের বিনিময়ে এই কাজ করেছে, তারা কেবল আইন ভাঙেনি, বরং রাষ্ট্রীয় সিস্টেমকে দুর্বল করেছে। এমন দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভোটার তালিকাকে ভুয়া ও বিতর্কিত করে তুলছে। ২. রাজনৈতিক ফায়দার অপকৌশল: রোহিঙ্গাদের ভোটার করার পেছনে একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহলের উদ্দেশ্য ছিল। অভিযোগ রয়েছে, নৌকা প্রতীকে ভোট বাড়ানোর জন্য তাদের এই কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। এটি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল করে। ৩. রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি: রোহিঙ্গাদের মধ্যে ইতোমধ্যে মাদক পাচার, মানব পাচার এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ রয়েছে। ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্তি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগের প্রবেশাধিকার দেবে, যা এই অপরাধগুলো আরও বাড়িয়ে তুলবে। ৪. স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা হুমকির মুখে: কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা এবং সম্পত্তির ওপর প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার বানানোর ফলে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ৫. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে: যে কোনো দেশের নাগরিকত্ব তার সার্বভৌমত্বের পরিচায়ক। রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে ভবিষ্যতে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতায়ও প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। ৬. ভোটার তালিকার বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষতি: একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য পরিচ্ছন্ন ও নির্ভুল ভোটার তালিকা অপরিহার্য। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হলে সাধারণ মানুষ ভোটার তালিকা ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারাবে। ৭. আন্তর্জাতিক চাপে পড়ার আশঙ্কা: রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধারণা করতে পারে, বাংলাদেশ ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার কৌশল দুর্বল হয়ে পড়বে। ৮. আদালতের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি: রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার ঘটনা বিচারব্যবস্থারও চ্যালেঞ্জ। যদি রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে এই ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণের মধ্যে বিচারব্যবস্থার ওপর অনাস্থা সৃষ্টি হবে। ৯. মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সামাজিক বৈষম্য: রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিলে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বৈষম্য তৈরি হবে। স্থানীয় মানুষ তাদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে হুমকির মুখে পড়বে। ১০. অবৈধ নাগরিকত্বের ঝুঁকি: রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ায় তারা ভবিষ্যতে পাসপোর্টসহ অন্যান্য সরকারি সেবার সুযোগ পাবে। এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

সমাধান কী: ১. তদন্ত কমিটি গঠন ও শাস্তি নিশ্চিত করা: এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং দালালদের চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা জরুরি। ২. ভোটার তালিকা পর্যালোচনা করা: রোহিঙ্গাদের ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য ভোটার তালিকায় বিশেষ নজরদারি বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। ৩. এনআইডি ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি নির্ভরতা: এনআইডি প্রক্রিয়ায় বায়োমেট্রিক ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে কোনো বিদেশি নাগরিক বা শরণার্থী সহজে এনআইডি পেতে সক্ষম হবে না। ৪. রোহিঙ্গাদের জন্য পৃথক শনাক্তকরণ ব্যবস্থা: রোহিঙ্গাদের জন্য একটি পৃথক শনাক্তকরণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যা ভোটার তালিকা বা নাগরিক পরিচয়ে ব্যবহৃত হবে না। ৫. স্থানীয় প্রশাসনের কার্যক্রম জোরদার করা: কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কমানোর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ৬. আইন ও শাস্তি আরও কঠোর করা: রোহিঙ্গাদের ভোটার করা বা এ ধরনের কাজে সহযোগিতা করলে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা জরুরি। ৭. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা: রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক মহলকে আরও সক্রিয় করতে হবে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে। ৮. জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা: সাধারণ জনগণকে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। ৯. সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করা: রোহিঙ্গাদের পুনরায় প্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ১০. নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা: নির্বাচন কমিশনের কাজের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা বাড়াতে স্বাধীন মনিটরিং কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
উপসংহার: রোহিঙ্গাদের ভোটার করা কেবল একটি প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক অপরাধ নয়, এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করার শামিল। এই ঘটনার মাধ্যমে আমাদের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং রাজনীতির অপব্যবস্থার চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। এখন সময় এসেছে এসব সমস্যার কার্যকর সমাধান নেওয়ার।
যদি আমরা এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেই, তবে ভবিষ্যতে এ ঘটনা আরও বড় সংকট সৃষ্টি করতে পারে। রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, দায়ীদের শাস্তি প্রদান, এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি। দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের উচিত এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা।

লেখক: সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক এবং মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
িি.িসরৎধনফঁষধষরস.পড়স