ঢাকা ১০:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫
বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফ করলেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর

রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফিরতে হবে

  • আপডেট সময় : ০৯:২০:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫
  • ১৯ বার পড়া হয়েছে

প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান -ছবি সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের নাগরিকদের নিয়ে যে সংকট চলছে, তার ‘স্থায়ী সমাধান’ হিসেবে প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করার কথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান।

রোববার (১৭ আগস্ট) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কূটনৈতিকদের ব্রিফ করার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে যে- আমরা এই সমস্যাটির একটি আশু এবং স্থায়ী সমাধান চাই, তো সেটাই। আপনি আন্তর্জাতিক সাহায্য দিয়ে কতদিন রাখবেন, তাদের তো বাড়ি ফিরতে হবে। সেটাই তো আসল কথা। তবে বাস্তবতার নিরিখে এদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা যে গুরুত্বপূর্ণ তা মানছেন খলিলুর।
তার কথায়, সাহায্য ইম্পর্টেন্ট। কারণ সেটা যদি কমে যায়, নানা ধরনের মানবিক সমস্যা দেখা দেয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর তার প্রতিক্রিয়া পড়ে। তো সাহায্য যাতে অব্যাহত থাকে, সে প্রচেষ্টা তো আমরা সবাই মিলে করছি এবং কিছু কিছু দাতা দেশ থেকে কিছু উদ্যোগের নিশানা পাচ্ছি।
প্রধান উপদেষ্টার উপদেষ্টা পদমর্যাদার কর্মকর্তা খলিলুর বলেন, আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটি কথা সবসময় বলি যে, গত আট বছরে আমরা পাঁচ বিলিয়নের ওপর খরচ করেছি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ওপরে। এরা আসবার আগে কয় টাকা খরচ হয়েছে? এক পয়সাও না। রোহিঙ্গারা যখন ফিরে যাবেন, তাদের ভূমি অত্যন্ত উর্বর; তাদের পানিতে যথেষ্ট পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়। আমরাই তো তাদের কাছ থেকে শস্য কিনতাম একসময়। পৃথিবীর কোনো প্রয়োজন তাদের কাছে নাই। তো তাদের ফিরিয়ে দিলে সবার জন্য মঙ্গল।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরো চার লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। এরপর আসে কোভিড মহামারী; রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগেও ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সংকটের মধ্যেই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। তাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসে নতুন ধাক্কা। এর মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে কয়েকবার রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে প্রত্যাবাসনের আলোচনা কমে আসে। উল্টো রাখাইনে যুদ্ধের কারণে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এর মধ্যে গত ১৪ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের কষ্ট নিজের চোখে দেখেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।
এরপর এপ্রিলে থাইল্যান্ডে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সঙ্কট ও সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানকে মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউ প্রত্যাবাসন বিষয়ে অগ্রগতি জানান।

তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে আংশিক যাচাই বাছাইয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ‘যোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার। আরো ৭০ হাজার রোহিঙ্গার চূড়ান্ত যাচাই বাছাইয়ের অংশ হিসেবে ছবি ও নাম মিলিয়ে দেখার কাজ চলছে। ওই তালিকার বাকি সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই বাছাই কাজও দ্রুত সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মিয়ানমার। কিন্তু মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া সব এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি দখলে চলে যাওয়ার মধ্যে বিষয়টিও চাপা পড়ে যায়। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়া সফরে বিষয়টি উত্থাপন করলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।

২৫ আগস্ট কক্সবাজারে স্টেকহোল্ডার কনফারেন্স আয়োজনের কথা তুলে ধরে খলিলুর রহমান রোববার বলেন, জাতিসংঘে আগামী সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখে রোহিঙ্গা বিষয়ক যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে, তারই প্রস্তুতির একটা অংশ হিসেবে আমরা করেছি। রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক আলোচনা থেকে ‘খসে পড়ার’ প্রেক্ষাপটে এ সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান খলিলুর। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করার জন্য জাতিসংঘের সকল সদস্যকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এবং সেটাতে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সাড়া পেয়েছি। সর্বসম্মতিক্রমে এই কনফারেন্সটা আহ্বান করার সিদ্ধান্ত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গ্রহণ করে এবং বিশ্বের ১০৬টা দেশ এটাকে স্পন্সর করে। সুতরাং এখন আন্তর্জাতিক সমর্থন যথেষ্ট পরিমাণ আছে।

প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেন, এই সম্মেলন হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য- এই সমস্যার একটা স্থায়ী এবং আশু সমাধানের পথনির্দেশিকা দেওয়ার একটা বড় সুযোগ। আমরা সেই কারণে রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর, তাদের কথা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের স্বপ্ন- এগুলো আমরা সেই কনফারেন্সে নিয়ে যেতে চাই।

খলিলুর রহমান বলেন, আপনারা জানেন, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্ররাই সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণ করে; রোহিঙ্গারা তো আর সদস্য নয়। কিন্তু কাউকে তো তাদের ভয়েসটা নিয়ে যেতে হবে। তো আমরা এ ধরনের প্রক্রিয়াতে সেই কাজটি করছি। আমরা আন্তর্জাতিক কমিউনিটি থেকে যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছি এবং সেটা আপনারা সম্মেলনে যারা অংশগ্রহণ করবেন সেখান থেকে, আপনারা দেখতে পাবেন। এবং আমরা যে বার্তাটা নিয়ে যাব, রোহিঙ্গারা এই সম্মেলনের মাধ্যমে যে বার্তাটা পাঠাবেন, সেটা ওই আগামী সেপ্টেম্বরে ইউএন কনফারেন্সে একটা বড় উপাদান হবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চার সম্মেলন: রোহিঙ্গা ইস্যুতে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চারটি সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ, কাতার ও বাংলাদেশের উদ্যোগে অনুষ্ঠেয় এসব সম্মেলন সম্পর্কে জানাতে বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের ব্রিফ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ব্রিফিংয়ে ঢাকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কাতার, সৌদি আরবসহ মোট ৫০টিরও বেশি মিশনের কূটনীতিকরা অংশ নেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আগামী ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে ‘অংশীজন সংলাপ: রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে আলোচনার জন্য প্রাপ্ত বার্তা’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ফাঁকে অনুষ্ঠিত হবে রোহিঙ্গাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন। আর কাতারের দোহায় ৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর পূর্তির দিন ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে অনুষ্ঠেয় ওই সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিতে পারেন। সম্মেলনে কয়েকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রোহিঙ্গাবিষয়ক কয়েকজন আন্তর্জাতিক দূত, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।

 

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফ করলেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর

রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফিরতে হবে

আপডেট সময় : ০৯:২০:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের নাগরিকদের নিয়ে যে সংকট চলছে, তার ‘স্থায়ী সমাধান’ হিসেবে প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করার কথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান।

রোববার (১৭ আগস্ট) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কূটনৈতিকদের ব্রিফ করার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে যে- আমরা এই সমস্যাটির একটি আশু এবং স্থায়ী সমাধান চাই, তো সেটাই। আপনি আন্তর্জাতিক সাহায্য দিয়ে কতদিন রাখবেন, তাদের তো বাড়ি ফিরতে হবে। সেটাই তো আসল কথা। তবে বাস্তবতার নিরিখে এদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা যে গুরুত্বপূর্ণ তা মানছেন খলিলুর।
তার কথায়, সাহায্য ইম্পর্টেন্ট। কারণ সেটা যদি কমে যায়, নানা ধরনের মানবিক সমস্যা দেখা দেয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর তার প্রতিক্রিয়া পড়ে। তো সাহায্য যাতে অব্যাহত থাকে, সে প্রচেষ্টা তো আমরা সবাই মিলে করছি এবং কিছু কিছু দাতা দেশ থেকে কিছু উদ্যোগের নিশানা পাচ্ছি।
প্রধান উপদেষ্টার উপদেষ্টা পদমর্যাদার কর্মকর্তা খলিলুর বলেন, আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটি কথা সবসময় বলি যে, গত আট বছরে আমরা পাঁচ বিলিয়নের ওপর খরচ করেছি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ওপরে। এরা আসবার আগে কয় টাকা খরচ হয়েছে? এক পয়সাও না। রোহিঙ্গারা যখন ফিরে যাবেন, তাদের ভূমি অত্যন্ত উর্বর; তাদের পানিতে যথেষ্ট পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়। আমরাই তো তাদের কাছ থেকে শস্য কিনতাম একসময়। পৃথিবীর কোনো প্রয়োজন তাদের কাছে নাই। তো তাদের ফিরিয়ে দিলে সবার জন্য মঙ্গল।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরো চার লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। এরপর আসে কোভিড মহামারী; রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগেও ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সংকটের মধ্যেই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। তাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসে নতুন ধাক্কা। এর মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে কয়েকবার রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে প্রত্যাবাসনের আলোচনা কমে আসে। উল্টো রাখাইনে যুদ্ধের কারণে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এর মধ্যে গত ১৪ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের কষ্ট নিজের চোখে দেখেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।
এরপর এপ্রিলে থাইল্যান্ডে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সঙ্কট ও সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানকে মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউ প্রত্যাবাসন বিষয়ে অগ্রগতি জানান।

তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে আংশিক যাচাই বাছাইয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ‘যোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার। আরো ৭০ হাজার রোহিঙ্গার চূড়ান্ত যাচাই বাছাইয়ের অংশ হিসেবে ছবি ও নাম মিলিয়ে দেখার কাজ চলছে। ওই তালিকার বাকি সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই বাছাই কাজও দ্রুত সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মিয়ানমার। কিন্তু মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া সব এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি দখলে চলে যাওয়ার মধ্যে বিষয়টিও চাপা পড়ে যায়। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়া সফরে বিষয়টি উত্থাপন করলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।

২৫ আগস্ট কক্সবাজারে স্টেকহোল্ডার কনফারেন্স আয়োজনের কথা তুলে ধরে খলিলুর রহমান রোববার বলেন, জাতিসংঘে আগামী সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখে রোহিঙ্গা বিষয়ক যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে, তারই প্রস্তুতির একটা অংশ হিসেবে আমরা করেছি। রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক আলোচনা থেকে ‘খসে পড়ার’ প্রেক্ষাপটে এ সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান খলিলুর। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করার জন্য জাতিসংঘের সকল সদস্যকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এবং সেটাতে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সাড়া পেয়েছি। সর্বসম্মতিক্রমে এই কনফারেন্সটা আহ্বান করার সিদ্ধান্ত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গ্রহণ করে এবং বিশ্বের ১০৬টা দেশ এটাকে স্পন্সর করে। সুতরাং এখন আন্তর্জাতিক সমর্থন যথেষ্ট পরিমাণ আছে।

প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেন, এই সম্মেলন হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য- এই সমস্যার একটা স্থায়ী এবং আশু সমাধানের পথনির্দেশিকা দেওয়ার একটা বড় সুযোগ। আমরা সেই কারণে রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর, তাদের কথা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের স্বপ্ন- এগুলো আমরা সেই কনফারেন্সে নিয়ে যেতে চাই।

খলিলুর রহমান বলেন, আপনারা জানেন, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্ররাই সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণ করে; রোহিঙ্গারা তো আর সদস্য নয়। কিন্তু কাউকে তো তাদের ভয়েসটা নিয়ে যেতে হবে। তো আমরা এ ধরনের প্রক্রিয়াতে সেই কাজটি করছি। আমরা আন্তর্জাতিক কমিউনিটি থেকে যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছি এবং সেটা আপনারা সম্মেলনে যারা অংশগ্রহণ করবেন সেখান থেকে, আপনারা দেখতে পাবেন। এবং আমরা যে বার্তাটা নিয়ে যাব, রোহিঙ্গারা এই সম্মেলনের মাধ্যমে যে বার্তাটা পাঠাবেন, সেটা ওই আগামী সেপ্টেম্বরে ইউএন কনফারেন্সে একটা বড় উপাদান হবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চার সম্মেলন: রোহিঙ্গা ইস্যুতে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চারটি সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ, কাতার ও বাংলাদেশের উদ্যোগে অনুষ্ঠেয় এসব সম্মেলন সম্পর্কে জানাতে বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের ব্রিফ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ব্রিফিংয়ে ঢাকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কাতার, সৌদি আরবসহ মোট ৫০টিরও বেশি মিশনের কূটনীতিকরা অংশ নেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আগামী ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে ‘অংশীজন সংলাপ: রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে আলোচনার জন্য প্রাপ্ত বার্তা’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ফাঁকে অনুষ্ঠিত হবে রোহিঙ্গাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন। আর কাতারের দোহায় ৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর পূর্তির দিন ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে অনুষ্ঠেয় ওই সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিতে পারেন। সম্মেলনে কয়েকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রোহিঙ্গাবিষয়ক কয়েকজন আন্তর্জাতিক দূত, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।