অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ : কোভিড ১৯ মহামারি বাংলাদেশের তরুণদের সামনে নতুন ও কঠিন চ্যালেঞ্জর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কোভিড ১৯ মহামাররির সময় দেখা দেয় জনজীবনে এক চরম অনিচয়তা। মানুষ তখন নতুন করে ধর্মমুখী হয়ে যায়। বিশেষ করে তরুণদের স্বপ্নভরা দুনয়নে নেমে আসে অন্ধকার। তরুণরা উন্নত প্রযুক্তির যুগের মানুষ। করোনার আগে তাদের ভাবনা সনাতনী ভাবনা থেকে ভিন্নতর ছিল।কিন্তু মহামারির প্রকোপে তাদের চিন্তা চেতনায় রেখাপাত ঘটে।তারা অনেকেই মানবতার খাতিরে হয়েছিল মানবপ্রেমিক নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করে।করোনাকালে তাদের লেখাপড়া শিক্ষা কার্যক্রম হয়েছে চরমভাবে বিঘিœত।এক অজানা ভয় ও অনিশ্চয়তা থেকে তারা মুক্তির পথ খুঁজেছে। অনেকেই তখন ধর্মকে বেছে নিয়েছে বাঁচার অবলম্বন হিসেবে।এসময় আমাদের তরুণদের অনেকেই ধর্মকে আলিঙ্গন করে জীবন যাপনের পথ নির্বাচন করেছেন। এরকম একটি পরিবর্তন আমাদের সমাজকে এমন ভাবে প্রভাবিত করেছে যে ধর্মব্যবসায়ীরা অতিমাত্রায় সক্রিয় ও সঙ্গবদ্ধ হয়েছেন।
সম্প্রতি ওই ধর্মীয় আনুগত্যর একটি নির্মম বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখেছি।এক তরুণী তার ড্রেসের জন্য হেস্তনেস্ত হয়েছেন নরসিংদীতে। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বুড়োদের সঙ্গে আদালত নারীদের ড্রেস নিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী বলেছেন- আমাদের উচিত কৃত্রিম মেধা অথবা রোবোটিক্স নিয়ে ভাবা।তিনি আরও বলেছেন, ড্রেস, টিপ মীমাংসিত বিষয় যদিও সম্প্রতিকালে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব নিয়েও কথা হয়েছে। সেগুলো নিয়ে বিতর্ক করা অনুচিত। পাল্টা বিবৃতিও দিয়েছেন মৌলানারাদের কেউ কেউ।
মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর কথা থেকে আমি একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। তার কথা থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে তিনি আমাদের তরুণদের নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। একথা সত্য কোরোনা উত্তরকালে আমাদের তরুণরা অত্যন্ত মানসিক চাপে আছে। সেগুলো থেকে বাঁচার জন্য আমরা অভিভাবকরা অনেকেই নামাজ পড়তে বলি। আল্লাহর কাছে মুক্তির পথ বাতলে দিতে হাত তুলতে বলি। আর এসবের সুযোগ নিচ্ছে চিরায়ত ধর্মব্যবসায়ীরা। তাদেরই প্ররোচতায় তরুণদের কেউ কেউ নারীদের পোশাক নিয়ে বিতর্কে জড়াচ্ছে। রোবোটিক্স ও কৃত্রিম মেধা নিয়ে মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর বক্তব্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য দিকনির্দেশনা মূলক।তরুণদের হতাশার মাঝে আশা সঞ্চারক।
সারা পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক ধস নেমেছে করোনা ও ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে তা দিন দিন গভীরতর হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করছেন। তাদের বক্তব্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও প্রকাশ পাচ্ছে। ইতিমধ্যে তিনি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আর্থসামাজিক পরিবেশে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে বলে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এরকম একটি সময়ে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছে বলে আমার বিশ্বাস। ।
পৃথিবীর এমন একটি সংকটকালে আমাদের শিক্ষকদের দায়িত্ব সবচে বেশি। আমাদের তরুণসমাজ যাতে সঠিক পথ খুঁজে পায় সেদিকেই আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত।শিক্ষকের এই দায়টি সর্বজনবিদিত। আমাদের মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী রোবোটিক্স বা কৃত্রিম মেধা নিয়ে আলোচনার কথা বলেছেন তা খুবই যৌক্তিক।এবং আমাদের শিক্ষকদের উচিত তরুণদেরকে অনুপ্রাণিত করা যাতে তারা এসব নিয়ে ভাবতে আনন্দ পায়।
তবে সেজন্য সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারকে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে যাতে বিজ্ঞান মেলা আয়োজন করে তরুণদেরকে উদ্ভাবনী কাজে আকৃষ্ট করা যায়।এবং যখন তারা বিজ্ঞানের চর্চায় উৎসাহ পাবে তখন ড্রেস কিংবা টিপ্ নিয়ে আলোচনায় সময় নষ্ট করবে না।মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী যেভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সেভাবে আমাদের অন্যান্য মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদরা যাতে কথা বলেন তার নির্দেশনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও দেবেন বলে আশা করতে পারি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের তরুণদের মাঝে একটি সংকট দেখা দিয়েছিলো। তারা দলে দলে নতুন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল।এবং সেটা দেশের ও তরুণদের যে সর্বনাশ করেছিল তা বর্ণনাতীত। আমাদের আজকের সংকটকালীন অবস্থায় তরুণদেরকে পথভ্রষ্ট করবার চেষ্টা চলছে।আশা করি সরকার সেটা বুঝতে পারছে এবং সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে তরুণদের মনে আশার সঞ্চার করতে সক্ষম হবে। যেভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ তরুণদের মনে আশার সঞ্চার করেছিল, সেই একইভাবে আমাদের তরুণদেরকে স্বপ্ন দিতে হবে। অনুপ্রেরণা যোগাতে হবে কৃত্রিম মেধা বা রোবোটিক্স নিয়ে যাতে ভাবে।
আমরা ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ স্বপ্নের কথা জেনেছি। কিন্তু সেটা তরুণদের কাছে এখনো পরিষ্কার না। সেটাকে যদি বিশদভাবে সরকারিভাবে আলোচনা করা হয় তবে তরুণদের মাঝে আশার আলো দেখা যাবে। আমার বিশ্বাস রোবোটিক্স ও কৃত্রিম মেধা নিয়ে ভাবনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ ভাবনার অংশবিশেষ।
এবার বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেস হাইওয়ে এবং পদ্মা সেতু দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়ি। গ্রামের তরুণরা এখন স্বপ্ন দেখছে সম্ভাবনাময় এক বাংলাদেশের। মেট্রো রেল ও টানেল তাদের স্বপ্নকে আরও প্রসারিত করবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকলে চলবে না। নেতাদেরকে বলতে হবে কেমন বাংলাদেশ আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে চাই। মানুষ স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে বাঁচে- তরুণদের স্বপ্ন কি তা সরকারকে জানতে হবে এবং সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্থান দিতে হবে।
আমাদের তরুণদেরকে সঠিক পথে যাতে চলতে পারে সেজন্য সরকারের উচিত বিশেষ তহবিল গঠন করা। সেখান থেকে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা। তরুণদের জন্য খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে, তাদের বিভিন্ন সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা।তরুণদের জন্য বিশেষ স্কিল অর্জনের জন্য বিশেষ বিশেষ টেকনিক্যাল কোর্স স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু করা জরুরি। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে যাতে আকৃষ্ট হয় সেদিকে নজর দেয়া।
বিগত বছরগুলোতে মেগা প্রকল্প নিয়ে সরকারকে নিমগ্ন থাকতে দেখেছি। এখন প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে এমন কিছু করতে হবে যাতে দেশের সকল অঞ্চলে উন্নয়নের কর্মকান্ড তরুণরা দেখতে পায়।সরকার যদি তরুণদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ না করে তবে সেই শুন্যতার সুযোগে অশুভ শক্তির উত্থান হতে পারে।
আমরা লক্ষ্য করেছি সুলভে নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারে সেজন্য সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। এসময়ে বাজার মূল্য এতটা বেশি যে সকলকেই কষ্ট দিচ্ছে। সরকার এসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডাইনিংএ ভর্তুকি দিয়ে মানসম্মত খাবার সরবরাহ করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের বৃত্তির পরিধি ও পরিমান বাড়াতে পারে।
দেশের তরুণসমাজ আগামীদিনের নাগরিক- তাদের যতেœ সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে।তাদেরকে মাদক, অপসংস্কৃতি ও ধর্মিয়মাদকতায় আসক্ত করে ফায়দা লুটার চেষ্টা যাদের মাঝে তাদেরকে নিষ্ক্রিয় রাখা প্রয়োজন। আমাদের মিডিয়া এখন অনেক বেশি উন্মুক্ত । ইউ টিউব ফেসবুক ব্যবহার কঠোর নজরদারীতে রাখতে হবে যাতে ওই অশুভ শক্তি আমাদের তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত না করতে পারে।
আমাদের ব্যবসায়ী মহলে আছে লোভী লোকজন। তাঁরাও তরুণদেরকে ব্যবহার করে থাকে সরকারকে চাপে রাখার জন্য। সেগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।আমরা প্রায় দেখি বাস ভাড়া নিয়ে আমাদের তরুণ সমাজ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। উন্নত দেশগুলোতে তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য যানবাহনে বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়। এ বিষয়ে সরকার যেন যথাযথ পদক্ষেপ নেয়। উন্নত দেশে তরুণদের জন্য আছে বিভিন্ন ধরণের সরকারি ভাতা। আমরা দাবি করছি আমাদের উন্নয়ন হয়েছে। তাহলে তরুণদের জন্য বেকার ভাতা চালু করা যায়।
তরুণরা উদ্যোক্তা হতে চায়। সেখানে সরকার মনযোগ দিতে পারে। তাতে করে অনাস্থার কালোমেঘ কেটে যাবে। বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করতে তরুণদের ভাবনাকে গুরুত্ব দেয়া অপরিহার্য। রোবোটিক্স কৃত্রিম মেধা ও স্মার্ট বাংলাদেশ নিয়ে তরুণরা কি ভাবছে সে বিষয়ে অনুসন্ধান সময়ের দাবি।
লেখক : অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রোবোটিক্স কৃত্রিম মেধা ও স্মার্ট বাংলাদেশ নিয়ে তরুণরা কি ভাবছে?
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ