ঢাকা ০১:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫

রোজিনার সঙ্গে আমাদের বিবেকও আজ বন্দিদশায়

  • আপডেট সময় : ১০:৪০:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১
  • ১১০ বার পড়া হয়েছে

সুলতানা কামাল : করোনা অতিমারির কারণে ঘরবন্দী অবস্থায় টেলিভিশনের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে অনেকখানি। সন্ধ্যার খবর না দেখতে পেলে সেদিনকার বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গেই প্রায় অসম্পর্কিত থাকতে হয়। ভালো-মন্দ খবরের তালে মনের অবস্থারও ওঠা-পড়া চলে। ১৭ মে একটি চ্যানেলের সংবাদে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা ও নির্যাতন করার ঘটনার কথা শুনে প্রথমে নিজের চোখ–কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। অন্যান্য চ্যানেলে দেখলাম সেই একই অবিশ্বাস্য সংবাদ। কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবার শক্তিও যেন কেউ কেড়ে নিয়েছিল। একটি সভ্য সমাজে এমন ঘটনাও ঘটে!
একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, যিনি পেশাগত জীবনে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করে সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিদের সচেতন ও সক্রিয় রাখতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার বহু নিদর্শন রেখেছেন এবং সে জন্য দেশে-বিদেশে সম্মানও অর্জন করেছেন, তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে সরকারি কার্যালয়ে সরকারি চাকরিরত ব্যক্তিদের হাতে কদর্যভাবে শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই ঘটনার যে ছবি বা ফুটেজ এসেছে, তাতে করে ওই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে সাধারণ নাগরিকের করের পয়সায় জনসেবার দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত হয়ে সচিবালয়ে অধিষ্ঠান করেন, সেটা প্রতিফলিত না হয়ে বরং তাঁদের আচরণ পাড়ার অপরাধপ্রবণ দুষ্কৃতকারীদের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের বেপরোয়া প্রতিক্রিয়া বরং এ সন্দেহকেই জোরদার করল যে যা কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলো সত্যই হবে। রোজিনার সঙ্গে যা করা হলো, তাতে সব শিষ্টতা, ভদ্রতা ও মানুষের ন্যূনতম মর্যাদার যে বোধ নিয়ে আমরা বেড়ে উঠি, তার সব কটিরই চরম লঙ্ঘন ঘটেছে। মানবাধিকারের মতো সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে না–ই ভাবলাম। ক্ষুব্ধ হয়েছি, তীব্র ঘৃণা বোধ করেছি, যারপরনাই লজ্জিত হয়েছি—কিছু বলেই এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় মনের অবস্থা বোঝানো যাবে না।
রোজিনাকে দীর্ঘক্ষণ বেআইনি এবং অনৈতিকভাবে আটকে রেখে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধারায় মামলা করা হয়েছে। রোজিনা কারাবন্দী আছেন। রোজিনাকে তস্করবৃত্তি, হত্যা, কাউকে অপহরণ বা অপবাহন অথবা অন্য কোনো অপরাধের জন্য বন্দী করা হয়নি। আমরা সবাই পরিষ্কারভাবে জানি, তিনি ইদানীং একটি মন্ত্রণালয়ের ভেতরের দুর্নীতি, অসংগতি, অদক্ষতা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখে যাচ্ছিলেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তাঁর প্রতিটি লেখা জনস্বার্থে নিবেদিত—নিঃসন্দেহে সাধারণ জনগণের কাছে একজন সাংবাদিকের অঙ্গীকারের নৈতিক তাগিদপ্রসূত। করোনা অতিমারির সময়ে এই মন্ত্রণালয়ের নীতিনিষ্ঠ, দক্ষ এবং চৌকস কর্মকা- অতীব গুরুত্ব বহন করে। এর ব্যত্যয় অসংখ্য মানুষকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ, যাঁরা টিকা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন, রোগীদের কাছাকাছি থাকা চিকিৎসক, সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন এই ভয়ংকর ভাইরাসের হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করতে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে এই বিরাট কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত মন্ত্রণালয়ের যেকোনো দুর্নীতি, অদক্ষতা, অজ্ঞতা, অবহেলা, উদাসীনতা এমন মাত্রার অন্যায়, যা ক্ষমার অযোগ্য। রোজিনা এবং তাঁর মতো অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা তাঁদের নৈতিক, সাংবিধানিক ও পেশাগত দায়বদ্ধতার কারণে সেই অন্যায় জনস্বার্থে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন, যাতে করে তারা সংশোধন হতে পারে।
এখানে, দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, রোজিনাদের কোনো ব্যক্তিস্বার্থ নেই। রোজিনারা জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করেন ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে। তাঁর সঙ্গে অসভ্য আচরণ, হেনস্তা ও আহত করা প্রকৃতপক্ষে জাতির বিবেককে আক্রমণ করা। নাগরিকের মৌলিক সাংবিধানিক ও মানবাধিকারের ওপর আক্রমণ করা। আমাদের সংবিধানের ৩৯–এর (১) অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্স্বাধীনতা একই মর্যাদায় উল্লেখ করা হয়েছে। ৩৯–এর (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হল।’ তাই যখন কোনো পেশাজীবী সাধারণ নাগরিকের হয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রনীতি, জনপ্রশাসন–সংক্রান্ত কর্মকা-ের ভালো-মন্দ জনসমক্ষে তুলে ধরেন, তাঁরা নাগরিকের সেই অধিকারের চর্চাকেই বজায় রাখার চেষ্টা করেন। যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার দায় বহন করেন। কেননা আমাদের সংবিধান ঘোষণা করেছে যে এই দেশের সকল ক্ষমতার মালিক এ দেশের জনগণ এবং সরকারি কর্মকর্তারা সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকার পান শুধু জনগণের পক্ষে, নিজ স্বার্থে নয়। সেটাই বিবেকের কথা। সে কথা আমাদের যাঁরা স্মরণ করিয়ে দেন, তাঁদের বন্দী থাকা মানে আমাদের বিবেক আজ বন্দিদশায়।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

রোজিনার সঙ্গে আমাদের বিবেকও আজ বন্দিদশায়

আপডেট সময় : ১০:৪০:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১

সুলতানা কামাল : করোনা অতিমারির কারণে ঘরবন্দী অবস্থায় টেলিভিশনের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে অনেকখানি। সন্ধ্যার খবর না দেখতে পেলে সেদিনকার বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গেই প্রায় অসম্পর্কিত থাকতে হয়। ভালো-মন্দ খবরের তালে মনের অবস্থারও ওঠা-পড়া চলে। ১৭ মে একটি চ্যানেলের সংবাদে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা ও নির্যাতন করার ঘটনার কথা শুনে প্রথমে নিজের চোখ–কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। অন্যান্য চ্যানেলে দেখলাম সেই একই অবিশ্বাস্য সংবাদ। কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবার শক্তিও যেন কেউ কেড়ে নিয়েছিল। একটি সভ্য সমাজে এমন ঘটনাও ঘটে!
একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, যিনি পেশাগত জীবনে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করে সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিদের সচেতন ও সক্রিয় রাখতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার বহু নিদর্শন রেখেছেন এবং সে জন্য দেশে-বিদেশে সম্মানও অর্জন করেছেন, তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে সরকারি কার্যালয়ে সরকারি চাকরিরত ব্যক্তিদের হাতে কদর্যভাবে শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই ঘটনার যে ছবি বা ফুটেজ এসেছে, তাতে করে ওই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে সাধারণ নাগরিকের করের পয়সায় জনসেবার দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত হয়ে সচিবালয়ে অধিষ্ঠান করেন, সেটা প্রতিফলিত না হয়ে বরং তাঁদের আচরণ পাড়ার অপরাধপ্রবণ দুষ্কৃতকারীদের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের বেপরোয়া প্রতিক্রিয়া বরং এ সন্দেহকেই জোরদার করল যে যা কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলো সত্যই হবে। রোজিনার সঙ্গে যা করা হলো, তাতে সব শিষ্টতা, ভদ্রতা ও মানুষের ন্যূনতম মর্যাদার যে বোধ নিয়ে আমরা বেড়ে উঠি, তার সব কটিরই চরম লঙ্ঘন ঘটেছে। মানবাধিকারের মতো সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে না–ই ভাবলাম। ক্ষুব্ধ হয়েছি, তীব্র ঘৃণা বোধ করেছি, যারপরনাই লজ্জিত হয়েছি—কিছু বলেই এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় মনের অবস্থা বোঝানো যাবে না।
রোজিনাকে দীর্ঘক্ষণ বেআইনি এবং অনৈতিকভাবে আটকে রেখে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধারায় মামলা করা হয়েছে। রোজিনা কারাবন্দী আছেন। রোজিনাকে তস্করবৃত্তি, হত্যা, কাউকে অপহরণ বা অপবাহন অথবা অন্য কোনো অপরাধের জন্য বন্দী করা হয়নি। আমরা সবাই পরিষ্কারভাবে জানি, তিনি ইদানীং একটি মন্ত্রণালয়ের ভেতরের দুর্নীতি, অসংগতি, অদক্ষতা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখে যাচ্ছিলেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তাঁর প্রতিটি লেখা জনস্বার্থে নিবেদিত—নিঃসন্দেহে সাধারণ জনগণের কাছে একজন সাংবাদিকের অঙ্গীকারের নৈতিক তাগিদপ্রসূত। করোনা অতিমারির সময়ে এই মন্ত্রণালয়ের নীতিনিষ্ঠ, দক্ষ এবং চৌকস কর্মকা- অতীব গুরুত্ব বহন করে। এর ব্যত্যয় অসংখ্য মানুষকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ, যাঁরা টিকা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন, রোগীদের কাছাকাছি থাকা চিকিৎসক, সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন এই ভয়ংকর ভাইরাসের হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করতে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে এই বিরাট কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত মন্ত্রণালয়ের যেকোনো দুর্নীতি, অদক্ষতা, অজ্ঞতা, অবহেলা, উদাসীনতা এমন মাত্রার অন্যায়, যা ক্ষমার অযোগ্য। রোজিনা এবং তাঁর মতো অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা তাঁদের নৈতিক, সাংবিধানিক ও পেশাগত দায়বদ্ধতার কারণে সেই অন্যায় জনস্বার্থে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন, যাতে করে তারা সংশোধন হতে পারে।
এখানে, দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, রোজিনাদের কোনো ব্যক্তিস্বার্থ নেই। রোজিনারা জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করেন ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে। তাঁর সঙ্গে অসভ্য আচরণ, হেনস্তা ও আহত করা প্রকৃতপক্ষে জাতির বিবেককে আক্রমণ করা। নাগরিকের মৌলিক সাংবিধানিক ও মানবাধিকারের ওপর আক্রমণ করা। আমাদের সংবিধানের ৩৯–এর (১) অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্স্বাধীনতা একই মর্যাদায় উল্লেখ করা হয়েছে। ৩৯–এর (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হল।’ তাই যখন কোনো পেশাজীবী সাধারণ নাগরিকের হয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রনীতি, জনপ্রশাসন–সংক্রান্ত কর্মকা-ের ভালো-মন্দ জনসমক্ষে তুলে ধরেন, তাঁরা নাগরিকের সেই অধিকারের চর্চাকেই বজায় রাখার চেষ্টা করেন। যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার দায় বহন করেন। কেননা আমাদের সংবিধান ঘোষণা করেছে যে এই দেশের সকল ক্ষমতার মালিক এ দেশের জনগণ এবং সরকারি কর্মকর্তারা সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকার পান শুধু জনগণের পক্ষে, নিজ স্বার্থে নয়। সেটাই বিবেকের কথা। সে কথা আমাদের যাঁরা স্মরণ করিয়ে দেন, তাঁদের বন্দী থাকা মানে আমাদের বিবেক আজ বন্দিদশায়।