বিশেষ সংবাদদাতা : করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসায় আমদানি বেড়েছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বেড়েছে আমদানি ব্যয়। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হবে মহামারিতে স্থগিত হওয়া আমদানি ব্যয়ের দেনা। এছাড়া বৈদেশিক ঋণের চলমান কিস্তির পাশাপাশি স্থগিত হওয়া কিস্তির চাপও বাড়বে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরজুরেই বেশ চাপের মধ্যে থাকবে রিজার্ভ। যা ধরে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলতি অর্থবছর রিজার্ভে চাপ থাকবে ঠিকই কিন্তু এই সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবাহও বাড়তে পারে। আর আমদানি ব্যয়ও কমে আসবে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিও কমবে। এতে চলতি অর্থবছরের শেষার্ধে রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালে রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। তখন প্রতি মাসে আমদানি ব্যয় হতো ৫৫০ কোটি ডলারের মতো। আর এ দিয়ে প্রায় ৯ মাসের আমদানি মেটানো সম্ভব ছিল। তবে গত অর্থবছরের শেষের দিকে রিজার্ভ নেমে আসে ৪২ বিলিয়ন ডলারে। আর এ সময়ে প্রতি মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৭৫০ কোটি ডলারের বেশি। যা দিয়ে সাড়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব ছিল। চলতি অর্থবছরের শুরুতে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) দেনা পরিশোধ করার পর রিজার্ভ কমে ৪ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছে। যা এখন আর ওপরে উঠছে না। প্রতিদিন আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ দিন দিন কমে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রিজার্ভ কমে ৩ হাজার ৯৬৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, চলতি মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। ফলে চলতি মাস শেষে রিজার্ভ আবার ৪ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক নিরাপদ মানদ- অনুযায়ী স্বাভাবিক সময়ে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। যদি খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয় তাহলে থাকতে হবে কমপক্ষে ৫ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান। বিশ্বব্যাপী অপরিহার্য পণ্যের বাজারে অস্থিরতা থাকলে কমপক্ষে ৭ মাসের সমান আমদানি ব্যয়ের রিজার্ভ থাকতে হয়।
বাংলাদেশ বর্তমানে ব্যাপক পরিমাণে খাদ্য আমদানি করে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ে বড় ঘাটতি বিরাজ করছে। যা প্রতি মাসেই বাড়ছে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন সাত মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান থাকা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আমদানি ব্যয় নির্ভর করে পণ্যের আমদানির পরিমাণও আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম হু-হু করে বাড়ায় ২০২০ সালে প্রতি মাসে গড়ে আমদানি ব্যয় হতো ৩৫০ কোটি ডলার। ২০২১ সালে তা বেড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি ডলার হয়েছে। আর চলতি বছর তা আরও বেড়ে ৭৫০ কোটি থেকে ৭৯০ কোটি ডলারে উঠেছে। এতে তিন মাসের বা ৭ মাসের আমদানি ব্যয়ের রিজার্ভ রাখার পরিমাণও বেড়েছে। বর্তমানে আমদানি ব্যয়ের ধারায় গড়ে ৭ মাসের জন্য ৫ হাজার কোটি ডলারের ওপরে রিজার্ভ থাকা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে প্রতিদিনই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে প্রতিদিনই ৭ থেকে ১০ কোটি ডলার করে বিক্রি করা হচ্ছে। এরপরও বাজারে অনেক ডলার সংকট রয়েছে। এতে বোঝা যায় আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়েই এখন রিজার্ভ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো নিয়মিত এলসি খুলতেও পারছে না। এ অবস্থায় রেমিট্যান্স বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।’ রপ্তানি আয় বাড়ানো এখন চ্যালেঞ্জিং। কেননা রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা এখন মন্দায় আক্রান্ত। ফলে ওইসব দেশে রপ্তানি কমে যাবে। এদিকে আমদানি বেড়েই যাচ্ছে। এটি কমানো কঠিন। বেশি কমানো হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর। সালেহ আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান সংকট মোকাবিলায় মুদ্রা পাচার ও রেমিট্যান্সে হুন্ডি বন্ধ করাটা জরুরি। এছাড়া বৈদেশিক সংস্থাগুলো থেকে কম সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া বন্ধ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি ঋণের কারণে সামনে আরও চাপ বাড়বে রিজার্ভে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ১৯ শতাংশ বেশি। সে বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির এই রেকর্ড বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বড় সহায়তা করেছে।
চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে বলে আভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে প্রধান ক্রেতা ইউরোপ ও আমেরিকা। দুটি অঞ্চলই এখন অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত। মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৪০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও কমছে। এ কারণে রপ্তানি কমতে পারে। আমদানি ব্যয় সাড়ে ১৪ শতাংশে সীমিত থাকার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু বছর শেষে তা বেড়ে প্রায় ৪৮ শতাংশ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে। করোনাকালে যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত থাকায় পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন কম হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘মানুষ শুধু শুধু ভয় পাচ্ছে। আবার অনেকে ইচ্ছা করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আমি মনে করি বর্তমানে দেশে যে রিজার্ভ আছে তা যথেষ্ট ভালো; সন্তোষজনক। এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। রিজার্ভ যতক্ষণ ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে আছে, ততক্ষণ ভয় পাবার কিছুই নেই। এর নিচে গেলে তখন ভাবা যাবে। সরকার ব্যয় সংকোচনের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদেক্ষেপে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ অনেক পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। আমার বিশ্বাস, এ সব কিছুর ইতিবাচক ফল খুব শিগিগিরই পাওয়া যাবে। আর এ সংকট খুব শিগগিরই কেটে যাবে। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।’
জানা গেছে, মূলত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বাড়ায় এ খাতে ঘাটতি বেশি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে এ ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৬৫৫ কোটি ডলার। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২৪৫ কোটি ডলার কম। এর মানে হচ্ছে, চলতি অর্থবছরেও আমদানি রপ্তানির ব্যবধান বাড়বে। অর্থাৎ রপ্তানি কমবে। বিপরীতে আমদানি বাড়বে। গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬০৭ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ২৭৫৭ কোটি ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। চলতি অর্থবছরে এ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৬০৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরেও রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয়ের মধ্যকার ব্যবধান বেশি থাকবে।
রিজার্ভ ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ