নারী ও শিশু প্রতিবেদন : কণ্ঠ শুনে পিছিয়ে আসতে চেয়েও হয়ত থমকে যাবেন ক্ষণিকের মতো। তার অনুরোধে দ্বিধা নিয়েই চড়ে বসবেন রিকশায়। সংগ্রামী এ নারী শুধু যে নিজের জীবনের হাল ধরেছেন তা নয়, সংসারের দায়দায়িত্ব নিয়েছেন নিজের কাঁধে তুলে। চালিয়ে যাচ্ছেন দুই মেয়ের জীবন পাল্টে দেওয়ার লড়াই। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর টানাপড়েনের সংসারে হঠাৎ বিপদে পড়ে যাওয়া আর বেশভূষা বদলে টিকে থাকার লড়াইয়ের সেই গল্প সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন নূপুর বেগম।
১৪ বছর আগে খালার হাত ধরে কাজের সন্ধানে যখন ঢাকায় আসেন শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার মেয়ে নূপুর, তখন তার বয়স ২২। রাজধানীতে এসে কাজ নেন তৈরি পোশাক কারখানায়। সেখানে মো. সোহেল নামে এক সহকর্মীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সেই পরিচয় থেকে প্রেম ও পরে পরিণয়ে গড়ায় সম্পর্ক। কিন্তু অল্প দিনেই সে সম্পর্ক পরিণত হয় তিক্ততায়।
শুরু থেকেই সংসারে ঝামেলা হওয়ার কথা জানিয়ে নূপুর বলেন, “বিয়ের পর থেকেই সে (স্বামী) নির্যাতন চালানো শুরু করে। এটা-সেটা (মাদক) খেত। আবার প্রথম দিকে আমার মা-বাবা এ বিয়ে মেনে নিতে চায়নি।”
সংসারে অশান্তির মধ্যেই দুই মেয়ের জন্ম হয়। ছোট মেয়ের জন্মের তিন মাসের মাথায় আরেক নারীর সঙ্গে স্বামীর প্রেমের কথা জানতে পারেন নূপুর। “হঠাৎ করে একদিন সে বাসায় আসা বন্ধ করে দিল। এরপর ওই মেয়েটিকেও আর দেখিনি। শুনেছি তারা একসাথে পালিয়ে গেছে।”
প্রথম পাঁচ বছর বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে সোহেলের সন্ধান পাননি নূপুর। এরপর হঠাৎ একদিন সে বাসায় এসে হাজির। আবারও সংসার করার আগ্রহ দেখালেন। তবে তাকে আর গ্রহণ করেননি নূপুর। তিনি বলেন, “আমি বলেছি যে, তুমি তিন মাসের সন্তানকে রেখে চলে যেতে পারলা, তোমার সাথে আর সংসার করার মত ইচ্ছা নেই। মেয়েরাও তার বাবাকে চেনে না।”
জীবনের এ বিপর্যয়ের মধ্যেও ভেঙে পরেননি, থেমে যাননি নূপুর। একা থাকার সেই দিনগুলাতে ছোট্ট দুই শিশুকে নিয়ে অনেকের অনেক রকম ‘চাহনিকে’ উপেক্ষা করেই তাকে টিকে থাকতে হয়েছে। প্রথম কয়েক বছর পোশাক কারখানায় চাকরি করলেও পরে বাসাবাড়িতে কাজ শুরু করেন নূপুর। কিন্তু ওই কাজের আয় দিয়ে সংসারের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন।
কয়েক বাসায় কাজ করে মাসে ৬-৭ হাজার টাকা পেতেন নূপুর বেগম; কিন্তু ঘর ভাড়াতেই চলে যেত চার হাজার টাকা। মেয়েদের লেখাপড়ার পেছনেও মাসে ব্যয় বাড়তে থাকে। এরপর খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসার পেছনে খরচ তো আছেই।
টানাটানির মধ্যে আয় বাড়ানোর চিন্তা ঘুরতে থাকে সংগ্রামী এ নারীর মাথায়। পেশা পরিবর্তনের চেষ্টা চালাতে শুরু করেন। শেষমেশ রিকশা চালানোর কথা মাথায় আসে বছর ছয় আগে। কিন্তু সমাজ তো একে ‘পুরুষের পেশা’ হিসেবে জানে। নারী হয়ে সেই কাজ কীভাবে করবেন? শুরুতে বেশ দুশ্চিন্তাই ছিল নূপুরের। তবে পেটের টান আর দুই মেয়েকে ’মানুষের মতো মানুষ করার’ স্বপ্নে দ্বিধা ঝেড়ে লড়াইয়ে নেমে পড়েন দৃঢ়চেতা এ নারী। নিরাপত্তার শঙ্কা আর ভাড়া পেতে জটিলতার কথা ভেবে পোশাকে আনেন পরিবর্তন, বেশ নেন পুরুষের। দীর্ঘ আলাপে মাঝবয়সী এ নারী বলেন, “আমি একজন মেয়ে মানুষ, অনেক পরিশ্রম করে রিকশা চালাই। রাস্তায় যদি একজন নারী রিকশা চালায় তখন কেউ ফলো করতে পারে, হয়তো ক্ষতি করতে পারে, সেই ভয় কাজ করে। এজন্য নিজেকে বাঁচাতে এভাবে পাঞ্জাবি-প্যান্ট পরে রিকশা চালাই।
”মহিলা রিকশাওয়ালা হলে মানুষ কাছেই আসবে না, সেটাও আরেকটা কারণ। পুরুষ ভেবে আসলে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদেরকে ওঠাই।”
শুধু নিরাপত্তার কারণেই সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত রিকশা চালানোর কথা জানান নূপুর। মোটরচালিত রিকশা চালিয়ে দৈনিক চারশ টাকার মত আয় হয় তার। সে হিসাবে মাসিক ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা রোজগার।
হার না মানা নূপুর বলে চলেন, ”বাসা-বাড়িতে কাজ করলে মাসে ছয়-সাত হাজারের বেশি পাওয়া সম্ভব ছিল না। এখনতো সংসারটা আগের চেয়ে ভালো চলে।”
এ নারী রিকশাচালক থাকেন ঢাকার মুগদার মা-া এলাকায়। স্থানীয় একটি স্কুলের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে তার দুই মেয়ে। তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা নূপুর বলেন, “আমার মেয়েরা অনেক মেধাবী। কিন্তু টাকার অভাবে ঠিকমত গাইডলাইন দিতে পারছি না। আমি কষ্ট-পরিশ্রম করে হলেও ওদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চাই।”
রিকশার প্যাডেলে ঘুরছে নূপুরের জীবনের চাকা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ