ঢাকা ০৪:১০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫

রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তন: ইতিহাস থেকে শিক্ষা নয়, ইতিহাস আঁকড়ে ধরে পুনরাবৃত্তি

  • আপডেট সময় : ০৫:০৫:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪
  • ৫৮ বার পড়া হয়েছে

ইতিহাস যে কোনো জাতির জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ- যা অস্বীকার করার উপায় নেই। একটি জাতির উত্থান, পথচলা, বিশ্বাস-ভাবাবেগ, আচার-ব্যবহার, কৃষ্টি-কালচার ইতিহাসের অংশ। কোনো জাতিসত্ত্বার সম্মুখভাগে অগ্রসরের পথ নির্ধারণে ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ অতি জরুরি। অন্যথায় সঠিক পথ নির্ধারণ দুরূহ ব্যাপার। তবে প্রশ্ন হচ্ছে সঠিক করণীয় কোনটি? ইতিহাস আঁকড়ে ধরে অন্ধকার অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি, যা ব্যর্থতা ও রক্তপাতে রচিত অথবা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে পুনরাবৃত্তি রোধে সঠিক পথ খুঁজে বের করা।
বাঙালি জাতিসত্ত্বার ইতিহাস ভারতবর্ষের বৃটিশ পরাধীনতার শিকল ভেঙে মুক্তির আন্দোলন থেকে যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সেই আন্দোলন ছিল সম্মিলিত ভারতবাসীর। সেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, পেশা কোনো মুখ্য বিষয ছিল না। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ যখন বৃটিশ পরাধীনতা থেকে মুক্ত হলো, তখন ধর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হলো। চেয়েছিল স্বাধীনতা, হলো বিভাজন। ভারতবর্ষের তৎকালীন রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক দ্বন্দ, ক্ষমতার লোভ এবং বৃটিশদের ইন্ধন মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা ও রক্তপাতের মূল কারণ ছিল; যা দেশ বিভাজনকে একমাত্র সমাধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ভারত ও পাকিস্তানের ভৌগলিক বিন্যাস আরো বিস্ময়কর। ফলাফল যা হওয়ার কথা তাই হলো এবং আজও চলমান। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় ‘এক বাঙলা’র মতো অনেক উত্তম প্রস্তাব শুধু স্বার্থের কারণে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। একই সঙ্গে জন্ম নেয়া দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু জন্ম থেকে দুই রাষ্ট্রের গতিপথ ভিন্ন ধারায় চলেছে, ইতিহাস যার স্বাক্ষী।
ভারত রাষ্ট্রের পথ চলায় চড়াই উৎরাই থাকলেও মূলতঃ রাজনীতিবিদরাই সমাধানে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজনীতিবিদদের স্বার্থবাদী চিন্তাধারা ও পারস্পরিক দ্বন্দের জেরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের নতুন অধ্যায়ের সংযোজন ঘটে। জেনারেল আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খান তার জ্বলন্ত উদাহরণ। উভয় সামরিক অফিসার রাষ্ট্র ক্ষমতায় হস্তক্ষেপের মূল কারণ হিসেবে রাজনীতিবিদদের দ্বন্দ্ব ও ব্যর্থতা কে দায়ী করেছিলেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্ত বাস্তবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। অবশ্যই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা ধরে রাখার উচ্চাভিলাষ ও স্বার্থবাদী আচরণ পূর্ব পাকিস্তানের জনমানুষের প্রতি সব ধরনের বৈষ্যমের মূল কারণ, যার পরিণতি পূর্ব পাকিস্তানের জনমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যূদয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো রক্তের বিনিময়ে। কিন্তু ইতিহাস আঁকড়ে ধরে পুনরাবৃত্তির ধারা পরিবর্তন হলো না। দেশের আপামর জনসাধারণ যুদ্ধ করলো, রক্ত দিল। অথচ স্বাধীনতার মূল দাবিদার হিসেবে আভির্ভূত হলো আওয়ামী লীগ নামক দলটি। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই এ দলের নেতৃত্ব ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার হীনস্বার্থ চরিতার্থে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর মতো একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াসহ রক্তপাত বজায় রাখে। ১৯৭২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাস যেন ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি, যেখানে বারবার কোনো একক ব্যক্তির সর্বময় ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা, রাজনীতিবিদদের মধ্যে স্বার্থগত দ্বন্দ, বিরোধী দল-মত দমনে শক্তি প্রয়োগ এবং রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সুযোগে সামরিক কমান্ডারদের ক্ষমতা দখল ঘুরে ফিরে এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তনের ইতিহাস এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। যেহেতু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কথাটি বারবার আসছে, তাই ১৯৪৭-১৯৭১ এবং ১৯৭২-২০২৪ সাল সময়কালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের ধারার ওপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো।
উপরোল্লিখিত ঘটনা পরিক্রমা থেকে বোঝা যায়, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনে জনগণের অংশগ্রহণ বা মতামতের গুরুত্ব বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে।

১৯৭২-২০২৪ সাল
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি হন শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানে বন্দি)। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান কার্যকর হয় এবং বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সংবিধান কার্যকরী হওয়ার দুই বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতি রদ করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান আবার রাষ্ট্রপতি হন। ৪র্থ সংশোধনীর আর একটি মূল কথা ছিল বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতির প্রবর্তন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামক দলটি গঠন করে একদলীয় শাসন চালু করা হয় এবং অন্যসব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতি আঘাতের সূত্রপাত এখান থেকেই।
এখানে লক্ষণীয় যে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৯ জন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। তাদের মধ্যে দুইজনকে হত্যা করা হয় এবং ৭ জন পদচ্যুত অথবা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনে জনগণের অংশগ্রহণ বা মতামতের গুরুত্ব উপেক্ষিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অথবা হস্তান্তরের প্রচলন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই অনুপস্থিত।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনে জনগণের অংশগ্রহণ ও মতামত বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়ে যেমন রাজনীতিবিদরা পূর্বসুরীদের পথ অনুসরণ করেছেন, তেমনি তাদের পরিণতি হয়েছে অনাকাক্ষিত। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে যদি তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের স্বার্থে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতেন, তবে বাংলাদেশ আজ উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকত।

মো. শাহারিয়ার আহমেদ: উইং কমান্ডার (অব.)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

প্রধান উপদেষ্টা হতাশ-ক্ষুব্ধ, ‘পদত্যাগ’ নিয়ে আলোচনা

রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তন: ইতিহাস থেকে শিক্ষা নয়, ইতিহাস আঁকড়ে ধরে পুনরাবৃত্তি

আপডেট সময় : ০৫:০৫:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪

ইতিহাস যে কোনো জাতির জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ- যা অস্বীকার করার উপায় নেই। একটি জাতির উত্থান, পথচলা, বিশ্বাস-ভাবাবেগ, আচার-ব্যবহার, কৃষ্টি-কালচার ইতিহাসের অংশ। কোনো জাতিসত্ত্বার সম্মুখভাগে অগ্রসরের পথ নির্ধারণে ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ অতি জরুরি। অন্যথায় সঠিক পথ নির্ধারণ দুরূহ ব্যাপার। তবে প্রশ্ন হচ্ছে সঠিক করণীয় কোনটি? ইতিহাস আঁকড়ে ধরে অন্ধকার অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি, যা ব্যর্থতা ও রক্তপাতে রচিত অথবা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে পুনরাবৃত্তি রোধে সঠিক পথ খুঁজে বের করা।
বাঙালি জাতিসত্ত্বার ইতিহাস ভারতবর্ষের বৃটিশ পরাধীনতার শিকল ভেঙে মুক্তির আন্দোলন থেকে যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সেই আন্দোলন ছিল সম্মিলিত ভারতবাসীর। সেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, পেশা কোনো মুখ্য বিষয ছিল না। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ যখন বৃটিশ পরাধীনতা থেকে মুক্ত হলো, তখন ধর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হলো। চেয়েছিল স্বাধীনতা, হলো বিভাজন। ভারতবর্ষের তৎকালীন রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক দ্বন্দ, ক্ষমতার লোভ এবং বৃটিশদের ইন্ধন মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা ও রক্তপাতের মূল কারণ ছিল; যা দেশ বিভাজনকে একমাত্র সমাধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ভারত ও পাকিস্তানের ভৌগলিক বিন্যাস আরো বিস্ময়কর। ফলাফল যা হওয়ার কথা তাই হলো এবং আজও চলমান। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় ‘এক বাঙলা’র মতো অনেক উত্তম প্রস্তাব শুধু স্বার্থের কারণে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। একই সঙ্গে জন্ম নেয়া দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু জন্ম থেকে দুই রাষ্ট্রের গতিপথ ভিন্ন ধারায় চলেছে, ইতিহাস যার স্বাক্ষী।
ভারত রাষ্ট্রের পথ চলায় চড়াই উৎরাই থাকলেও মূলতঃ রাজনীতিবিদরাই সমাধানে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজনীতিবিদদের স্বার্থবাদী চিন্তাধারা ও পারস্পরিক দ্বন্দের জেরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের নতুন অধ্যায়ের সংযোজন ঘটে। জেনারেল আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খান তার জ্বলন্ত উদাহরণ। উভয় সামরিক অফিসার রাষ্ট্র ক্ষমতায় হস্তক্ষেপের মূল কারণ হিসেবে রাজনীতিবিদদের দ্বন্দ্ব ও ব্যর্থতা কে দায়ী করেছিলেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্ত বাস্তবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। অবশ্যই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা ধরে রাখার উচ্চাভিলাষ ও স্বার্থবাদী আচরণ পূর্ব পাকিস্তানের জনমানুষের প্রতি সব ধরনের বৈষ্যমের মূল কারণ, যার পরিণতি পূর্ব পাকিস্তানের জনমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যূদয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো রক্তের বিনিময়ে। কিন্তু ইতিহাস আঁকড়ে ধরে পুনরাবৃত্তির ধারা পরিবর্তন হলো না। দেশের আপামর জনসাধারণ যুদ্ধ করলো, রক্ত দিল। অথচ স্বাধীনতার মূল দাবিদার হিসেবে আভির্ভূত হলো আওয়ামী লীগ নামক দলটি। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই এ দলের নেতৃত্ব ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার হীনস্বার্থ চরিতার্থে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর মতো একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াসহ রক্তপাত বজায় রাখে। ১৯৭২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাস যেন ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি, যেখানে বারবার কোনো একক ব্যক্তির সর্বময় ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা, রাজনীতিবিদদের মধ্যে স্বার্থগত দ্বন্দ, বিরোধী দল-মত দমনে শক্তি প্রয়োগ এবং রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সুযোগে সামরিক কমান্ডারদের ক্ষমতা দখল ঘুরে ফিরে এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তনের ইতিহাস এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। যেহেতু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কথাটি বারবার আসছে, তাই ১৯৪৭-১৯৭১ এবং ১৯৭২-২০২৪ সাল সময়কালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের ধারার ওপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো।
উপরোল্লিখিত ঘটনা পরিক্রমা থেকে বোঝা যায়, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনে জনগণের অংশগ্রহণ বা মতামতের গুরুত্ব বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে।

১৯৭২-২০২৪ সাল
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি হন শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানে বন্দি)। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান কার্যকর হয় এবং বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সংবিধান কার্যকরী হওয়ার দুই বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতি রদ করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান আবার রাষ্ট্রপতি হন। ৪র্থ সংশোধনীর আর একটি মূল কথা ছিল বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতির প্রবর্তন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামক দলটি গঠন করে একদলীয় শাসন চালু করা হয় এবং অন্যসব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতি আঘাতের সূত্রপাত এখান থেকেই।
এখানে লক্ষণীয় যে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৯ জন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। তাদের মধ্যে দুইজনকে হত্যা করা হয় এবং ৭ জন পদচ্যুত অথবা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনে জনগণের অংশগ্রহণ বা মতামতের গুরুত্ব উপেক্ষিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অথবা হস্তান্তরের প্রচলন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই অনুপস্থিত।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনে জনগণের অংশগ্রহণ ও মতামত বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়ে যেমন রাজনীতিবিদরা পূর্বসুরীদের পথ অনুসরণ করেছেন, তেমনি তাদের পরিণতি হয়েছে অনাকাক্ষিত। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে যদি তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের স্বার্থে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতেন, তবে বাংলাদেশ আজ উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকত।

মো. শাহারিয়ার আহমেদ: উইং কমান্ডার (অব.)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ