নিজস্ব প্রতিবেদক : জোটসঙ্গী দল বাসদের পর সিপিবিও জানাল, তারা নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপে যাবে না। না যাওয়ার ব্যাখ্যায় বাম দলটি বলেছে, গত দুই বার এই সংলাপে অংশ নেওয়ার পর তাদের ‘নতুন কিছু বলার নেই’ বলে এই সিদ্ধান্ত।
গতকাল শনিবার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সভাপতিম-লীর সদস্য আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সংলাপে অংশগ্রহণের বিষয়ে অপরাগতা জানিয়ে তারা রাষ্ট্রপতির কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। বাম গণতান্দ্রিক জোটভুক্ত সিপিবি ও বাসদ ছাড়াও বিএনপি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংলাপে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে জানিয়েছে। ইসি নিয়োগে মতবিনিময়ের জন্য বঙ্গভবনে আগামী সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় সিপিবির সঙ্গে সংলাপের সময়সূচি নির্ধারণ করা ছিল।
রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, “সিপিবি নির্বাচনের আমূল সংস্কারের জন্য সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বসহ ৫৩টি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের সুপারিশমালা ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে আপনার কাছে প্রদান করেছিল।
“এই অবস্থায় হুবহু একই আলোচ্য সূচিতে ও একই প্রকরণের আরেকটি সংলাপে যোগ দিয়ে সিপিবির নতুন কোনো কথা বলার নেই। সেকারণে তাতে যোগদানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছি না।”
ইসি গঠনে ‘সিলেক্ট কমিটি’ চায় সিপিবি : সংলাপে আমন্ত্রণ জানানোয় সিপিবি নেতাদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন থাকা একান্তভাবে প্রয়োজন।
“কিন্তু অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সেটাই যথেষ্ট নয়। কমিশনের মৌলিক গলদ দূর করতে না পারলে অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না।”
চিঠিতে অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য সংবিধানসম্মতভাবে একটি নির্বাচন কমিশন মনোনীত করা জরুরি জানিয়ে দ্রুত আইন প্রণয়নের তাগিদ দেওয়া হয়। “আপনার কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ আপনি জাতীয় সংসদকে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে আগামী মাসের ভেতরে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন করে তা স্বাক্ষরের জন্য আপনার কাছে পাঠাতে বলুন। “তাহলে নির্বাচন কমিশন মনোনয়নের আগে সে বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আপনার বৈঠকের প্রয়োজন পড়বে না।”
সাংবিধানিক সংস্থা ইসির সদস্য নিয়োগে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও কোনো আইন না হওয়ায় প্রতিবারই রাজনৈতিক অঙ্গনে মতভেদ তৈরি হয়। জটিলতা এড়াতে গত দুবার সার্চ কমিটির ব্যবস্থা হলেও বিতর্ক থামেনি। মো. জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে ইসি নিয়োগ দেওয়ার পর আবদুল হামিদও সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আসছেন। কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসির মেয়াদ আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে। তার মধ্যেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে তা গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত ২০ ডিসেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন।
সংলাপে না যেতে কামালকে অনুরোধ মন্টুদের : নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপে কামাল হোসেনকে অংশ না নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে গণফোরামের একাংশ।
গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে যে সংবাদ সম্মেলনে এই অনুরোধ জানানো হয়, তাতে গণফোরামের একাংশের সভাপতি মোস্তফা মহসিন মন্টুর সঙ্গে ছিলেন আবু সাইয়িদ, সুব্রত চৌধুরী, মহসিন রশিদ। নতুন ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছেন। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি দল তা বর্জন করছে। ইসিতে নিবন্ধিত দল হিসেবে গণফোরামও সেই সংলাপের আমন্ত্রণ পেয়েছে। রোববার তাদের বঙ্গভবনে যেতে চিঠি দেওয়া হয়েছে কামালকে। দলটিতে ভাঙনের ফলে মন্টুর নেতৃত্বাধীন অংশের নিবন্ধন নেই। মন্টু বলেন, “ড. কামাল হোসেনের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। আমরা তাকে এই সংলাপে না যেতে অনুরোধ করেছি।
“আমরা তার বরাবর একটি চিঠিও দিয়েছি। সেই চিঠিতে গণফোরামের ঐতিহ্য এবং সুনাম অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে ড. কামাল হোসেনকে এবং গণফোরামের পক্ষে এই সংলাপে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার জন্য সবিনয়ে অনুরোধ জানিয়েছি।”
চিঠিতে কামাল হোসেনকে গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সম্বোধন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে চিঠিটি পড়ে শোনান গণফোরামের এই অংশের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী। চিঠিতে বলা হয়, “এদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রপতির এই সংলাপ কার্য্ত একটি নাটকীয় আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। চলমান সংলাপ দেশবাসীর কাছে পূর্বের মতোই চাতুর্য্পূর্ণ সংলাপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কাজেই উক্ত সংলাপে গণফোরামের নামে অংশগ্রহন করা অপ্রত্যাশিত এবং বর্তমান সরকারের অপশাসন ও জনগনের ভোটাধিকার হরণের রাজচালাকীর সহযোগী হিসাবে গণ্য করা হবে।”
গণফোরামের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দল বিএনপি এই সংলাপকে ‘অর্থহীন’ উল্লেখ করে তাতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। গণফোরামের একাংশের নির্বাহী পরিষদের সভায় সংলাপে না যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে বিষয়টিও চিঠিতে কামাল হোসেনকে জানানো হয়।
গত ৩ ডিসেম্বর জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে মন্টুকে সভাপতি ও সুব্রত চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে গণফোরামের এই অংশ নতুন কমিটি গঠন করে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয় মূল দলের সভাপতি কামাল হোসেনকে।
সংবাদ সম্মেলনে সুব্রত চৌধুরী বলেন, “২০১৪ ও ২০১৮ সংলাপে তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে গণফোরাম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, বর্তমান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে চলমান সংলাপ একটি তামাশা মাত্র। যার মাধ্যমে কোনো কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব নয়।
“গণফোরাম মনে করে, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের জন্য শুধু শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করলেই চলবে না, এর জন্য অপরিহায্র্ হলো জাতীয় ঐ্ক্যমতের সরকার। সেই সরকারের অধিনেই সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাধিকারসহ জনগণের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।”
গত ৩ ডিসেম্বর জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে মন্টুকে সভাপতি ও সুব্রত চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে গণফোরামের এই অংশ নতুন কমিটি গঠন করে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয় মূল দলের সভাপতি কামাল হোসেনকে।
ইসলামী আন্দোলনও সংলাপে অংশ নেবে না : এদিকে বিএনপি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) ও মোস্তফা মহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরামের একাংশের পর এবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সংলাপে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাইর পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। এ সময় তিনি নির্বাচনের সময় অন্তর্বতী জাতীয় সরকার গঠনের দাবিও জানান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসি গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ শুরু হয়েছে গত ২০ ডিসেম্বর।
সংলাপে না যাওয়ার বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমির মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ২০১২ ও ২০১৭ সালের সংলাপে অংশ নিয়ে আমরা চরমভাবে হতাশ হয়েছি। ২০১২ সালের সংলাপে গঠিত ইসি ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করেছে, যেখানে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হয়েছেন। আর ২০১৭ সালের সংলাপের পর গঠিত কমিশন ১০১৮ সালে একটি চরম বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেছে, যাকে অনেকেই মধ্যরাতের নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করে।
এসব কলঙ্কময় নির্বাচনের জন্য কমিশনকে রাষ্ট্রপতির জবাবদিহিতার আওতায় না আনায় তারা হতাশ উল্লেখ করে মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, রাষ্ট্রপতি কোনো রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করেননি। তা ছাড়া অতীতের দুটি সংলাপে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে রাষ্ট্রপতির কাছে আমাদের গঠনমূলক প্রস্তাবগুলোর কোনোটাই মূল্যায়ন করা হয়নি। যে দল তাঁকে রাষ্টপতি হিসেবে নির্বাচন করেছে, তিনি সেই দলীয় স্বার্থের বাইরে যেতে পারেননি। অতীতের দুটি সংলাপ যেমন জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, চলমান সংলাপেও এর ব্যতিক্রম কিছু হবে না। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, জন–আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গিয়ে এমন একটি আবেদনহীন ও তাৎপর্যহীন সংলাপে অংশ নেওয়াটা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সঙ্গত মনে করে না।
রাষ্ট্রপতির সংলাপ বর্জন করে দলটি সাত দফা দাবি জানায়। তার মধ্যে রয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় এবং নির্বাচনের সময় অন্তর্বতী জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। ইসি গঠন আইন চলমান সংসদের মাধ্যমে নয়; রাজনৈতিক সংগঠন ও সমাজের স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল গঠন করে তাদের মাধ্যমে ইসি গঠনসংক্রান্ত আইন প্রস্তুত করে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচনে কোনো ধরনের অসততা, অদক্ষতা ও পক্ষপাত পাওয়া গেলে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের অপসারণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জনপ্রশাসন, আইন, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনকালীন ইসির হাতে ন্যস্ত করতে হবে। নির্বাচনকালীন সহিংসতার প্রতিটি অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব ইসিকেই নিতে হবে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি করতে দেখলে তাঁদের স্থায়ীভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়াসহ প্রভৃতি দাবি জানানো হয়।
রাষ্ট্রপতির সংলাপে যাচ্ছে না যেসব দল
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ