জিয়াউদ্দিন চৌধুরী : ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ার সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত দেশ ইউক্রেনে সব দিক থেকে চেপে ধরা অব্যাহত রেখেছে, তখন ৫ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এই আগ্রাসনের কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ১৪১টি এই নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। মাত্র পাঁচটি দেশে বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়াও রয়েছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, চীন ভোটদানে বিরত ছিল।
ভোটদানে বিরত থাকা ৩৫টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত এবং অপর দেশ, যারা এই প্রকাশ্য আগ্রাসনের ঘটনায় রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করতে চায় না। মজার বিষয় হলো, বেশিরভাগ মুসলিম দেশ, উল্লেখযোগ্যভাবে মধ্যপ্রাচ্য (সিরিয়া বাদে) এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশ নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশীয় তিনটি দেশ ভুটান, নেপাল ও মালদ্বীপ সোচ্চার ছিল রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিবাদে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে আজ বিশ্ব যে সংকটের মুখোমুখি তা সমানতালে একটি পারমাণবিক যুদ্ধে ঝুঁকিতে পরিপূর্ণ, এতে ইউক্রেনের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পুতিনের হুমকি অনুভব করা উচিত। কার্যত পুতিন ইউরোপীয় দেশগুলো হুমকি দিয়েছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিলে তাদের অকল্পনীয় পরিণতি ভোগ করতে হবে।
এই মুহূর্তে নীরব ও রাশিয়ার আক্রমণের কারণ খোঁজা কিংবা ইউক্রেন বা দেশটির প্রতিবেশীদের দ্বারা রাশিয়া প্ররোচিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে অনুমান করার সময় নয়। এখন সময় হলো দোষারোপের খেলা বাদ দিয়ে আরেকটি বিপর্যয় ঠেকানো। এখন সময় হলো বিশ্বকে সেই দিনগুলোতে ফিরতে না দেওয়া যখন পরাশক্তিগুলো একে অপরকে পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে হুমকি দিত এবং তাল মিলিয়ে না হাঁটা দেশগুলোতে আক্রমণ করত কোনও একটি পরাশক্তি।
আমাদের অনেকের জন্য মনে করার মতো খুব বেশি আগের ঘটনায় নয়, যখন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যা আজকের রাশিয়া যে হাঙ্গেরি (১৯৫৬) এবং পরে চেকোস্লোভাকিয়া (১৯৫৮) আক্রমণ করেছিল। নিজেদের পুতুল কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ দমনের নামে তারা এই আক্রমণ করেছিল। দুই দশক করে একই দেশ আফগানিস্তানে আক্রমণ করেছিল নিজেদের পক্ষে সরকার বসানোর জন্য।
বর্তমান পুতিন ইউক্রেনের শাসক পরিবর্তন করতে চান, কারণ দেশটির প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার অবস্থানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে রাজি না। দেশটি মহাদেশের ২৭টি ভালো অর্থনীতির দেশের ব্লকের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। কিন্তু পুতিন রুশ জোয়াল থেকে ইউক্রেনকে স্বাধীনতা বেছে নিতে দেবেন না এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মহিমা ও শক্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে চান। যে সাম্রাজ্যে কঠোরভাবে দমনকৃত ১৫টির বেশি দেশ ছিল।
আগের দশকগুলোতে বর্তমান রাশিয়ার সাবেক রূপ সোভিয়েতের আক্রমণগুলোর সক্রিয় বিরোধিতা করেনি অন্যান্য দেশগুলো, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও। পারমাণবিক যুদ্ধের বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়াসহ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই এই বিরোধিতা করা হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি বিশ্ব শক্তি, যার পারমাণবিক ভারসাম্য রয়েছে পশ্চিমাদের সঙ্গে এবং নেতারা এমন একটি বিশ্বে আত্মঘাতী সংঘাতের বিষয়ে সতর্ক ছিলেন, যে বিশ্ব সম্প্রতি আট বছর দীর্ঘ যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং লাখো মানুষ মৃত্যু ও অভাবনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন।
সোভিয়েতের পতন এবং এর কব্জার নিয়ন্ত্রণ থেকে অনেক ইউরোপীয় দেশ স্বৈরাচারকে প্রত্যাখ্যান ও গণতন্ত্রকে আলিঙ্গণ করার মধ্য দিয়ে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধে ভয় হ্রাস পায়।
তবে আরেক ধরনের ভয় দেখা দেয়–যখন অন্যান্য বস্তুগত বিষয়ে জ্বালানির উৎসে নিয়ন্ত্রণ ও স্বৈরশাসকের পুনরুত্থান বিশ্ব পর্যায়ে দেখা দেয় তখন শুরু হয় এক দেশের ওপর অন্য দেশের আধিপত্য।
একই সঙ্গে পুনরায় উদ্ভব হয় অগণতান্ত্রিক শক্তির- যারা নিজেদের আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দুর্বল শাসকের উৎখাত করে সামরিক বাহিনী দিয়ে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায়। এই অরাজকতার সুযোগে আবির্ভাব ঘটে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর, যারা মিথ্যা আদর্শ ও রাষ্ট্র দখল করে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রিত এই শাসকদের মধ্যে নতুন জোট তৈরি হয় এবং জোটের মাধ্যমে এসব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে এই নেতাদের অধিকারের বৈধতা দেওয়া। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এমন সম্পর্ক তৈরিতে এগিয়ে ছিল রাশিয়া ও চীন। যে দেশগুলোতে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন যারা এই অবস্থানে তাদের দেশকে নিয়ে গেছেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে টিকে থাকা যুক্তরাষ্ট্রও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন শক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই নতুন জোটের খোঁজ ও হারানো কর্তৃত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠার কাজ উল্লেখযোগ্যভাবে শুরু হয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ১৫টি দেশের কাছে একক প্রজাতন্ত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সময় লেগেছে, যে দেশগুলো একসময় রাশিয়ার আকার অলঙ্কৃত করেছিল। অর্থনৈতিক পতনমুখিতা ও সংকুচিত হওয়ার কারণে মুখোমুখি হওয়া প্রতিকূলতা থেকে ঘুরে দাঁড়াতেও দীর্ঘ সময় লেগেছে।
কিন্তু রাশিয়া সামরিক শক্তি ও সরঞ্জাম হারায়নি। পারমাণবিক অস্ত্রও তাদের হাতে থেকে যায়। এগুলোর বেশিরভাগই ছিল মাদার রাশিয়াতে। এই সামরিক শক্তি ও পারমাণবিক ক্ষমতার কারণে যে দেশগুলোর সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব ছিল ও পরে সহযোগিতা করে তাদের কাছে পরাশক্তি হয়ে ওঠার সক্ষমতা পায় রাশিয়া। ভ্লাদিমির পুতিন যখন ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন তখন তিনি এ ক্ষমতাকে ব্যবহার ও কাজে লাগান এবং ধীর গতিতে তার আধা-গণতান্ত্রিক দেশকে আরেকটি স্বৈরশাসনে পরিণত করেন।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভয়ঙ্কর সংস্থা কেজিবি’র একজন সাবেক কর্মকর্তা তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন দেখেছেন। তিনি দেখেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি সাধারণ রাষ্ট্রে পরিণত হতে। এই পতনে তার খেদ ছিল এবং সাবেক সাম্রাজ্য যেসব দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল সেগুলোতে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা লালন করেন। ইউক্রেন তার দেশের কাছেই অবস্থিত এবং তিনি এই দেশকে রাশিয়ার কর্তৃত্বের বাইরে যেতে দিতে চান না।
তাই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ইউক্রেনীয় প্রাকৃতিক সম্পদে অধিকার ফলানোর জন্য নয়। এটি হলো কম শক্তিশালী রাষ্ট্রটিতে রাশিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। পুতিন ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গেছেন, কারণ বেলারুশের মতো যে দেশটিকে তিনি করদ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান, সেই দেশ চায় রাশিয়ার আধিপত্যের বাইরে থাকতে। যে দেশগুলোকে পছন্দ করেন না সেই দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে ইউক্রেনের নাগরিকদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেন না পুতিন। রাশিয়ার এই আগ্রাসন এই অধিকারকে ঠেকানোর জন্য।
আমাদের সামনে থাকা প্রশ্ন এটি নয় যে, আমরা কি এমন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকিতে ফেলবো যারা আগে আমাদের মুক্তির সংগ্রামে জোরালো সমর্থন দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি এমন দেশের পাশে দাঁড়াবো না যারা ক্ষমতাধর আগ্রাসনকারীর বিরুদ্ধে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করছে। আমাদের জন্য অপ্রীতিকর প্রশ্ন এটা নয় যে, নিজেদের ক্ষমতাধর প্রতিবেশীকে অসন্তুষ্ট করা, যে প্রতিবেশীর রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং দেশটির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ প্রতিরক্ষা সামগ্রী আমদানি করে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি ক্ষমতাধর প্রতিবেশীকে খেপাবো না বলে সার্বভৌম কোনও দেশ ও জাতির পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস এবং মূল্যবোধকে বিসর্জন দেব।
আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটার গুরুত্ব আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি। আমরা এমন এক দেশ যে পাঁচ দশক আগে যারা জাতি হিসেবে অস্তিত্বশীল থাকতে আমাদের অধিকারের ওপর রক্তাক্ত হামলা প্রত্যক্ষ করেছি এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের সীমানা রক্ষা করেছি। আমাদের কেবল নিজেদের স্বাধীনতার জন্য নয় বরং অন্য স্বাধীনতা প্রিয় জাতির জন্য সংগ্রামের ঐতিহ্য রয়েছে। আমরা ক্ষমতার কাছে এই কারণে নত হতে পারি না যে, আমাদের স্বাধীন চিন্তা তাদের পছন্দ হবে না। ক্ষমতাধর ও পরাক্রমশালীর ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের ন্যায্যতা এবং স্বাধীনতা বেছে নেওয়া উচিত।
লেখক: কর্মজীবনের শুরুতে বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে উচ্চ পর্যায়ে কাজ করেছেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বব্যাংকের হয়েও কাজ করেন।