নিজস্ব প্রতিবেদক : রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বে খাদ্য, জ্বালানি এবং সারের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য ও জ্বালানি সংকট প্রকট হয়েছে। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বহু দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও এখন ঊর্ধ্বমুখী। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা-একশনএইড পরিচালিত এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকগুলো প্যারামিটারে বেড়েছে, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে সারের দাম ১০৫ শতাংশ, চিনির দাম ৬০ শতাংশ, পেট্রোলের দাম ৪৭ শতাংশ এবং স্যানিটারি প্যাডের দাম ২৩ শতাংশ বেড়েছে। ফলে দেশের জনগণ একাধিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষত নারী, মেয়ে ও শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের শিক্ষা, পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে আপস করতে হচ্ছে। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ১৪টি দেশের এক হাজারের বেশি মানুষের ওপর এ সমীক্ষা কার্যক্রম চালানো হয়।
এতে দেখা গেছে, নিরীক্ষণের সময় সারের দাম ১১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে, পেট্রোল এবং স্যানিটারি প্যাডের দাম ৮০ শতাংশ বা তার বেশি বেড়েছে। একই সঙ্গে বাল্যবিবাহের হার বৃদ্ধি, নারী স্বাস্থ্যের অবনতি এবং মানসিক স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটেছে। একশনএইড-এর গ্লোবাল পলিসি অ্যানালিস্ট আলবার্টা গুয়েরা বলেন, এ সমীক্ষায় দেখা যায়, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্বজুড়ে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের আকাশছোঁয়া দামের কারণে প্রান্তিক মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষত নারী ও কন্যাশিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা এসময়ে নানা সংকটে প্রভাবিত হয়েছে, যা তাদের খাদ্যগ্রহণ, শিক্ষা, বাল্যবিবাহ থেকে মুক্ত থাকার অধিকার এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতাকেও প্রভাবিত করেছে। সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশে মেয়ে ও ছেলে উভয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার বেড়েছে। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপও বাল্যবিবাহের হার বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার এক বাসিন্দা বলেন, বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের নিরাপত্তার চেয়ে শিক্ষা অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেদের বাংলাদেশে পাথর কোয়ারিতে বা জাদুকাটা নদীতে প্রতিদিন ৩০০ টাকায় বালু উত্তোলনের কাজ করতে হয়। এ কারণে তারা স্কুলে যেতে পারে না। সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ জলবায়ু বিপর্যয়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, কোভিড-১৯, ঋণের চাপ এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন থেকে শুরু করে একাধিক সংকটে রয়েছে। এ কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জলবায়ু বিপর্যয়, কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, জ্বালানির দামের অস্থিরতা সব ক্ষেত্রেই সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে খাদ্যের ওপর। যা নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বেশি মাত্রায় প্রভাবিত করে। আমাদের জাতীয় প্রতিবেদন (বাংলাদেশ ব্যাংক) নির্দেশ করে যে, আমাদের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। যদি আমরা বাস্তব দৃষ্টিতে দেখি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এখন চাল ও ডিমের মতো প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর জন্য আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দাম দিতে হচ্ছে। ফলে মানুষের খাদ্যগ্রহণ মারাত্মকভাবে হ্রাস ঘটেছে। যা পুষ্টির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করেছে। আমাদের এনার্জি খাতও অত্যন্ত জ্বালানিনির্ভর। তাই জ্বালানির অতিরিক্ত দাম আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ এবং জাতীয় ব্যয়ের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, একশনএইড একটি সমন্বিত ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত তহবিলের পক্ষে জোর দাবি জানাচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন, ঋণের চাপ এবং ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের গভীর প্রতিক্রিয়াসহ মূল্য সংকটকে বাড়িয়ে তোলা সব আন্তঃসংযুক্ত সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম।
ফারাহ্ কবির আরও বলেন, পরিবর্তিত বাস্তবতা এবং মানুষের বর্তমান চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থায় ভারসাম্য দরকার। শিশুসহ পরিবারগুলোকে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে হবে। চাষাবাদে অধিক বিনিয়োগের মাধ্যমে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এগ্রো ইকোলোজিক্যাল চাষ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা এখন অনেক বেশি প্রয়োজন। ১৪টি দেশের মোট ১০১০ জন মানুষের মধ্যে গত ১ মার্চ থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত এ সমীক্ষা পরিচালিত হয়। এতে অংশ নেওয়া উত্তরদাতাদের ৬৩ শতাংশ ছিলেন নারী। জরিপে অংশ নেওয়া ১৪টি দেশ হলো- বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (ডিআরসি), ইথিওপিয়া, হাইতি, কেনিয়া, মালাউই, মিয়ানমার, নেপাল, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, সোমালিল্যান্ড, জাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়ে ।