ঢাকা ০৪:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫

রাত হলেই ভয়ংকর তিন পার্ক

  • আপডেট সময় : ১১:১৬:১৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ মে ২০২৩
  • ১৮৬ বার পড়া হয়েছে

মহানগর প্রতিবেদন : রাজধানীতে নেই পর্যাপ্ত বিনোদন পার্ক ও শরীরচর্চা কেন্দ্র। খোলা ও পরিবেশসম্মত স্থানের অভাবে মানুষ বিনোদনের খোরাক মেটাতে পারছে না। তাই সন্ধ্যা নামলেই বিভিন্ন অলিগলিতে চায়ের দোকানে চলে মানুষের আড্ডা। আর এই শহরে যে কটি উদ্যান আছে, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে সেগুলোও রয়েছে অপরাধীদের দখলে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা থানা ও শাহবাগ থানার অধীনে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও পান্থকুঞ্জের মতো ঐতিহাসিক তিনটি স্থান। এগুলোর একেবারে নিকটে কলাবাগান ও শেরাবাংলা নগর থানা। পার্কগুলো ঘিরে ২৪ ঘণ্টা থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল। দিনের বেলায় ভালো পরিবেশ থাকলেও রাতের বেলায় ভয়ংকর রূপ ধারণ করে পার্কগুলো।
এসব পার্কে সন্ধ্যা নামলেই বসে মাদকসেবীদের আড্ডা, ভাসমান যৌনকর্মীদের প্রকাশ্যেই চলে দেহ ব্যবসা। বেড়ে যায় হিজড়াদের চলাচল। রয়েছে চুরি-ছিনতাইকারীদের উৎপাত। ফলে এসব স্থান দিয়ে রাতের বেলা পথচারী ও সাধারণদের একপ্রকার ভয়ে চলাচল করতে হয়। গত ৩০ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। চারদিকে ঝুম বৃষ্টি। শাহবাগ মোড় হয়ে টিএসসি পর্যন্ত পুরো পথ অন্ধকার। বৃষ্টির মধ্যেই শাহবাগ থানা অতিক্রম করে যাওয়া হয় উদ্যানের প্রথম গেটে। গেটের ভেতরে প্রবেশ করলে ছবির হাট। সেখানে পাঁচ থেকে ছয়টি ভ্রাম্যমাণ দোকান রয়েছে। কাকভেজা হয়ে দোকানের ছাউনিতে নিচে বসে অনেকেই গল্প করছেন, সিগারেট টানছেন। সেখানেই এক কোণে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন তিন পুলিশ সদস্যও। মাঝখান দিয়ে মানুষের চলাচল। এ পথে দাঁড়িয়েই এক তরুণী খদ্দেরের খোঁজে পথচারীদের অপত্তিকর প্রস্তাব ও ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন।
এর কয়েক মিনিট পর ছবির হাট পার হয়েই দেখা মেলে দেয়ালঘেরা একটি মঞ্চ। কাছে গেলেই দেখা যায় শতেক মানুষের ভিড়। সেখানে অনেকে বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। তাদের বেশির ভাগই তরুণ। ওই মঞ্চ থেকে গাঁজার গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কাছে গিয়ে দেখা যায়, তাদের কেউ কেউ মাদক তৈরি করছে, অনেকে তৈরি করা মাদক দলবেঁধে পার্কের অন্য স্থানে গিয়ে সেবন করছে। আবার কেউ কেউ শব্দ করে বলছে, ‘আজকে তামাকটা ভালো পড়েছে।’
দুদিন পর ১ এপ্রিল রাত ৯টায় সেখানে দেখা গেছে একই চিত্র। তবে এবার স্থান বদলে করেছে। তাদের দেখা যায়নি দেয়ালঘেরা ওই মঞ্চে। গেটের পাশেই শাহবাগ থানার জব্দ করা গাড়ি রাখার স্থান। ঠিক সেখানে অন্ধকার থেকে একটু পরপর কয়েকজন আসছে-যাচ্ছে। কাছে গেলেই নাকে আসে মাদকের গন্ধ। জব্দ করা ওই গাড়ি ফাঁকা জায়গায় বসে মাদক নিচ্ছেন তরুণরা। এভাবে পার্কের বিভিন্ন জায়গায় ওপর-নিচ বসে এভাবে মাদক নিতে দেখা গেছে অনেককে।
এমন দৃশ্য প্রতিদিন সন্ধ্যার পর দেখা মিলবে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এসব এলাকায় রাতের বেলায় প্রায়ই টহলে যান শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আরিফ। তার মতে, এখানে যারা আসেন, তাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া বাইরে থেকে অনেক আসেন। উদ্যানের ভেতরে নানা সময় বিভিন্ন রকম অপরাধমূলক কাজ তার চোখে পড়েছে।
এসআই বলেন, গভীর রাতেও এখানে মানুষের আড্ডা চলে। যেহেতু পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আমরা ধরে নিই শিক্ষার্থী তারা। উদ্যানে এসে যারা মাদক সেবন করে কিংবা অপরাধে জড়ায়, আমরা আসছি এমনটা টের পেলে তারা জায়গা ত্যাগ করে চলে যায়। গণপূর্ত অধিদফতরের অধীনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তায় নিয়োজিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার সদস্য বলেন, আমাদের নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব আছে, সেগুলোই পালন করি। গেটগুলোয় আমরা পাহারা দিই। রাতে গেট বন্ধ থাকলে, আমরা খুলতে রাজি নাহলে অনেকে দলবেঁধে এসে গেটে লাথি মারা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে আমরা অসহায়। আমরা চাইলে তাদের কিছু বলতে পারি না।
ছবির হাটের পাশে ১৮ বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা করছেন সাব্বির আহম্মেদ। তার মতে, গত কয়েক বছরের তুলনায় করোনা-পরবর্তী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন করে বেড়েছে মাদকসেবীদের আড্ডা, চুরি, ছিতাকারী, প্রতারকদের চলাচল। তার ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে বাইরে থেকে এসেও এসব অপরাধকাজে জড়াচ্ছে অনেকে।
এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, চুরি, চিনতাইকারী ও প্রতারকরা এ স্থানটিকে নিরাপদ মনে করে। প্রায়ই দেখা যায়, তরুণ যাত্রীরা রিকশা কিংবা সিএনজি অটো এনে চালককে ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকার নোটের কথা বলে চালকের কাছ থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ভাংতি নিয়ে যায়। তারা মূলত সিগারেট এনে দিচ্ছে বলে এভাবে উদ্যানের ভেতরে গিয়ে আর ফিরে আসে না। এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। পরে টাকা না নিয়েই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে চালকরা অসহায় হয়ে ফিরে যেতে হয়। সাধারণত ১১টার পর গেট আর খোলা থাকে না। গেট বন্ধ থাকলে অনেকে গেট টপকে উদ্যানের ভেতরে ঢুকতে দেখেছি।
এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হলো একটি ঐতিহাসিক স্থান। সাধারণ মানুষ আসবে বসবে, ঘুরেফিরে দেখবে, ইতিহাস জানবে। জায়গাটি খোলামেলা থাকার কথা যেন দূর থেকে একজন আরেকজনকে দেখতে পায়। সাধারণ মানুষ ঢুকবে কীভাবে উদ্যানজুড়ে বড় বড় গাছ আর অন্ধকার। এ অবস্থায় অনেকে ভয়ে প্রবেশ করবে না। এর মধ্যে যদি নানা অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয়, তাহলে তো আরও সমস্যা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে আগে নাট্যদলগুলো ছোট ছোট নাটক করতো। সেটাও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিপরীত পাশে রমনা পার্ক। রাত গভীর হলেই পার্কের দেয়াল ঘেঁষে জড়ো হয় একদল ভাসমান যৌনকর্মী। ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, টঙ্গি রাজধানীর এমন বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা এখানে এসে হাজির হয়। রাত ১১টার পর রাস্তার পাশে কাপড় টানিয়ে প্রকাশ্যে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয় এসব যৌনকর্মী। এসব কর্ম চলে ভোর রাত পর্যন্ত। এ ছাড়া সন্ধ্যার পর তাদের অনেকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে রাস্তার ওপরে ওভার ব্রিজে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। তাদের ঘিরেও সেখানে চলে অপরাধ কর্মকা-।
আট মাস ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন আনসার সদস্য বেলাল হোসেন। প্রায়ই রাতের বেলায় গার্ডের দায়িত্ব পালন করেন উদ্যানের ভিআইপি গেটে। তিনি বলেন, রাত ১১টার পর থেকে যৌনকর্মীরা আসতে থাকে এবং ভোর ৫টা পর্যন্ত এখানে থাকে তারা। রিকশা, সিএনজি অটোচালকই মূলত ওদের কাছে আসে। মাঝেমধ্যে ঝামেলা হয়। পুলিশ টহলে এলে যৌনকর্মীদের তেমন কিছু বলে না। তবে যেবস পুরুষ আসে, তাদের ধরতে দেখেছি। কিছুদিন আগে উদ্যানের ভেতর থেকে একজনের মোবাইল ব্যাগ নিয়ে গেছিল কয়েকজন। কয়েক দিন ধরে এমন খবর আর পাইনি।
কারওয়ানবাজার মোড় ও মাংলামটরের মাঝখানে অবস্থিত আরেকটি পার্ক পান্থকুঞ্জ। বর্তমানে পার্কটি পরিত্যক্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষের চলাচল নেই বলে চলে। এ সুযোগে রাতেই বেলায় সেখানে আড্ডা জমায় যৌনকর্মী, হিজড়া, টোকাই ও মাদকসেবীরা। পুরো পার্কে কোনও আলোর ব্যবস্থা না থাকায় সহজে যাতায়াত করে নানা অপরাধ কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
পথচারীদের টার্গেট করে তারা এই পার্কে চালায় বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকা-। তরুণদের ডেকে নিয়ে জোর করে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয়। এ ছাড়া পার্কের কোনায় কানায় বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। গভীর রাত পর্যন্ত এই এলাকায় রিকশা চালান মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, রাত যত গভীর হয়, যৌনকর্মীদের উৎপাত তত বাড়ে। দুদিন আগেও তখন রাত ২টা। আমি রিকশা নিয়ে বাংলামটর থেকে কাওরানবাজারে পথে পান্থকুঞ্জ পার্কটির মাঝবরাবর এলে দেখতে পাই কয়েকজন মিলে একজনকে টেনেহিঁচড়ে পার্কের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে সবকিছু রেখে ছেড়ে দেয়। অন্ধকারে কে যাবে ওখানে। সুযোগ বুঝে তারা মানুষ ধরে। আর হিজড়ারা পার্কের ভেতরে প্রকাশ্যে ওত পেতে থাকে। পান্থকুঞ্জ পার্কের বিষয়ে এসআই আরিফ বলেন, অনেকে তরুণ এখানে ইচ্ছে করে আসে। আবার হিজড়ারা অনেক পথচারীকে জোর করে ভেতরে নিয়ে যায়। ভেতরে নিয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়। আমরা কিছু বলতে গেলে হিজড়ারা যা মুখে আসে তা-ই বলে। তবে এমন কিছু দেখলে আমরা তৎক্ষণাৎ আইনি পদেক্ষেপ নিই।
গত ১ এপ্রিল রাতে এসব এলাকায় ফোর্স নিয়ে টহল দিয়েছিলেন শাহবাগ থানার এসআই আব্দুল্লাহ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব পাশে যৌনকর্মীদের উৎপাতের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাস্তার আইল্যান্ড পর্যন্ত আমাদের এলাকা। রাতে যৌনকর্মীদের মাঝেমধ্যে দেখা যায়। আমাদের চোখে পড়লে আমরা সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালাই। তারপরও কেন এসব অপরাধ কমছে না, এমন প্রশ্নের উত্তরে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ বলেন, এসব এলাকায় মাদক সেবন করছে, এমন অভিযোগে আমরা প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে গ্রেফতার করছি। অপরাধী তো অপরাধীই। এরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হোক আর যে-ই হোক, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। পান্থকুঞ্জের দিকে শুধু হিজড়া না যৌনকর্মীদের চলাচল আছে। আমাদের ফোর্স সব সময়ই থাকে এসব এলাকায়। এসব বিষয়ে আমাদের অভিযান চলছে এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান ওসি নূর মোহাম্মদ।
এ প্রসঙ্গে রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছবি হাটের গেটের দিকে যারা বসেন, তাদের বেশির ভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী। সুতরাং ঢালাওভাবে বলা যাচ্ছে না সবাই গাঁজা খায় কিংবা মাদক সেবন করে। ওখানে গিয়ে মাদক সেবন করছে এমন অভিযোগে আমরা এর আগে গ্রেফতার করেছি। কোনও অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হলে আর খবর পেলে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি আমরা। তবে এসব অপরাধমূলক কাজ আগের চেয়ে অনেক কমেছে বলে তিনি দাবি করেন।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

রাত হলেই ভয়ংকর তিন পার্ক

আপডেট সময় : ১১:১৬:১৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ মে ২০২৩

মহানগর প্রতিবেদন : রাজধানীতে নেই পর্যাপ্ত বিনোদন পার্ক ও শরীরচর্চা কেন্দ্র। খোলা ও পরিবেশসম্মত স্থানের অভাবে মানুষ বিনোদনের খোরাক মেটাতে পারছে না। তাই সন্ধ্যা নামলেই বিভিন্ন অলিগলিতে চায়ের দোকানে চলে মানুষের আড্ডা। আর এই শহরে যে কটি উদ্যান আছে, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে সেগুলোও রয়েছে অপরাধীদের দখলে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা থানা ও শাহবাগ থানার অধীনে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও পান্থকুঞ্জের মতো ঐতিহাসিক তিনটি স্থান। এগুলোর একেবারে নিকটে কলাবাগান ও শেরাবাংলা নগর থানা। পার্কগুলো ঘিরে ২৪ ঘণ্টা থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল। দিনের বেলায় ভালো পরিবেশ থাকলেও রাতের বেলায় ভয়ংকর রূপ ধারণ করে পার্কগুলো।
এসব পার্কে সন্ধ্যা নামলেই বসে মাদকসেবীদের আড্ডা, ভাসমান যৌনকর্মীদের প্রকাশ্যেই চলে দেহ ব্যবসা। বেড়ে যায় হিজড়াদের চলাচল। রয়েছে চুরি-ছিনতাইকারীদের উৎপাত। ফলে এসব স্থান দিয়ে রাতের বেলা পথচারী ও সাধারণদের একপ্রকার ভয়ে চলাচল করতে হয়। গত ৩০ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। চারদিকে ঝুম বৃষ্টি। শাহবাগ মোড় হয়ে টিএসসি পর্যন্ত পুরো পথ অন্ধকার। বৃষ্টির মধ্যেই শাহবাগ থানা অতিক্রম করে যাওয়া হয় উদ্যানের প্রথম গেটে। গেটের ভেতরে প্রবেশ করলে ছবির হাট। সেখানে পাঁচ থেকে ছয়টি ভ্রাম্যমাণ দোকান রয়েছে। কাকভেজা হয়ে দোকানের ছাউনিতে নিচে বসে অনেকেই গল্প করছেন, সিগারেট টানছেন। সেখানেই এক কোণে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন তিন পুলিশ সদস্যও। মাঝখান দিয়ে মানুষের চলাচল। এ পথে দাঁড়িয়েই এক তরুণী খদ্দেরের খোঁজে পথচারীদের অপত্তিকর প্রস্তাব ও ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন।
এর কয়েক মিনিট পর ছবির হাট পার হয়েই দেখা মেলে দেয়ালঘেরা একটি মঞ্চ। কাছে গেলেই দেখা যায় শতেক মানুষের ভিড়। সেখানে অনেকে বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। তাদের বেশির ভাগই তরুণ। ওই মঞ্চ থেকে গাঁজার গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কাছে গিয়ে দেখা যায়, তাদের কেউ কেউ মাদক তৈরি করছে, অনেকে তৈরি করা মাদক দলবেঁধে পার্কের অন্য স্থানে গিয়ে সেবন করছে। আবার কেউ কেউ শব্দ করে বলছে, ‘আজকে তামাকটা ভালো পড়েছে।’
দুদিন পর ১ এপ্রিল রাত ৯টায় সেখানে দেখা গেছে একই চিত্র। তবে এবার স্থান বদলে করেছে। তাদের দেখা যায়নি দেয়ালঘেরা ওই মঞ্চে। গেটের পাশেই শাহবাগ থানার জব্দ করা গাড়ি রাখার স্থান। ঠিক সেখানে অন্ধকার থেকে একটু পরপর কয়েকজন আসছে-যাচ্ছে। কাছে গেলেই নাকে আসে মাদকের গন্ধ। জব্দ করা ওই গাড়ি ফাঁকা জায়গায় বসে মাদক নিচ্ছেন তরুণরা। এভাবে পার্কের বিভিন্ন জায়গায় ওপর-নিচ বসে এভাবে মাদক নিতে দেখা গেছে অনেককে।
এমন দৃশ্য প্রতিদিন সন্ধ্যার পর দেখা মিলবে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এসব এলাকায় রাতের বেলায় প্রায়ই টহলে যান শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আরিফ। তার মতে, এখানে যারা আসেন, তাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া বাইরে থেকে অনেক আসেন। উদ্যানের ভেতরে নানা সময় বিভিন্ন রকম অপরাধমূলক কাজ তার চোখে পড়েছে।
এসআই বলেন, গভীর রাতেও এখানে মানুষের আড্ডা চলে। যেহেতু পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আমরা ধরে নিই শিক্ষার্থী তারা। উদ্যানে এসে যারা মাদক সেবন করে কিংবা অপরাধে জড়ায়, আমরা আসছি এমনটা টের পেলে তারা জায়গা ত্যাগ করে চলে যায়। গণপূর্ত অধিদফতরের অধীনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তায় নিয়োজিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার সদস্য বলেন, আমাদের নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব আছে, সেগুলোই পালন করি। গেটগুলোয় আমরা পাহারা দিই। রাতে গেট বন্ধ থাকলে, আমরা খুলতে রাজি নাহলে অনেকে দলবেঁধে এসে গেটে লাথি মারা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে আমরা অসহায়। আমরা চাইলে তাদের কিছু বলতে পারি না।
ছবির হাটের পাশে ১৮ বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা করছেন সাব্বির আহম্মেদ। তার মতে, গত কয়েক বছরের তুলনায় করোনা-পরবর্তী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন করে বেড়েছে মাদকসেবীদের আড্ডা, চুরি, ছিতাকারী, প্রতারকদের চলাচল। তার ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে বাইরে থেকে এসেও এসব অপরাধকাজে জড়াচ্ছে অনেকে।
এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, চুরি, চিনতাইকারী ও প্রতারকরা এ স্থানটিকে নিরাপদ মনে করে। প্রায়ই দেখা যায়, তরুণ যাত্রীরা রিকশা কিংবা সিএনজি অটো এনে চালককে ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকার নোটের কথা বলে চালকের কাছ থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ভাংতি নিয়ে যায়। তারা মূলত সিগারেট এনে দিচ্ছে বলে এভাবে উদ্যানের ভেতরে গিয়ে আর ফিরে আসে না। এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। পরে টাকা না নিয়েই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে চালকরা অসহায় হয়ে ফিরে যেতে হয়। সাধারণত ১১টার পর গেট আর খোলা থাকে না। গেট বন্ধ থাকলে অনেকে গেট টপকে উদ্যানের ভেতরে ঢুকতে দেখেছি।
এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হলো একটি ঐতিহাসিক স্থান। সাধারণ মানুষ আসবে বসবে, ঘুরেফিরে দেখবে, ইতিহাস জানবে। জায়গাটি খোলামেলা থাকার কথা যেন দূর থেকে একজন আরেকজনকে দেখতে পায়। সাধারণ মানুষ ঢুকবে কীভাবে উদ্যানজুড়ে বড় বড় গাছ আর অন্ধকার। এ অবস্থায় অনেকে ভয়ে প্রবেশ করবে না। এর মধ্যে যদি নানা অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয়, তাহলে তো আরও সমস্যা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে আগে নাট্যদলগুলো ছোট ছোট নাটক করতো। সেটাও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিপরীত পাশে রমনা পার্ক। রাত গভীর হলেই পার্কের দেয়াল ঘেঁষে জড়ো হয় একদল ভাসমান যৌনকর্মী। ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, টঙ্গি রাজধানীর এমন বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা এখানে এসে হাজির হয়। রাত ১১টার পর রাস্তার পাশে কাপড় টানিয়ে প্রকাশ্যে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয় এসব যৌনকর্মী। এসব কর্ম চলে ভোর রাত পর্যন্ত। এ ছাড়া সন্ধ্যার পর তাদের অনেকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে রাস্তার ওপরে ওভার ব্রিজে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। তাদের ঘিরেও সেখানে চলে অপরাধ কর্মকা-।
আট মাস ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন আনসার সদস্য বেলাল হোসেন। প্রায়ই রাতের বেলায় গার্ডের দায়িত্ব পালন করেন উদ্যানের ভিআইপি গেটে। তিনি বলেন, রাত ১১টার পর থেকে যৌনকর্মীরা আসতে থাকে এবং ভোর ৫টা পর্যন্ত এখানে থাকে তারা। রিকশা, সিএনজি অটোচালকই মূলত ওদের কাছে আসে। মাঝেমধ্যে ঝামেলা হয়। পুলিশ টহলে এলে যৌনকর্মীদের তেমন কিছু বলে না। তবে যেবস পুরুষ আসে, তাদের ধরতে দেখেছি। কিছুদিন আগে উদ্যানের ভেতর থেকে একজনের মোবাইল ব্যাগ নিয়ে গেছিল কয়েকজন। কয়েক দিন ধরে এমন খবর আর পাইনি।
কারওয়ানবাজার মোড় ও মাংলামটরের মাঝখানে অবস্থিত আরেকটি পার্ক পান্থকুঞ্জ। বর্তমানে পার্কটি পরিত্যক্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষের চলাচল নেই বলে চলে। এ সুযোগে রাতেই বেলায় সেখানে আড্ডা জমায় যৌনকর্মী, হিজড়া, টোকাই ও মাদকসেবীরা। পুরো পার্কে কোনও আলোর ব্যবস্থা না থাকায় সহজে যাতায়াত করে নানা অপরাধ কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
পথচারীদের টার্গেট করে তারা এই পার্কে চালায় বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকা-। তরুণদের ডেকে নিয়ে জোর করে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয়। এ ছাড়া পার্কের কোনায় কানায় বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। গভীর রাত পর্যন্ত এই এলাকায় রিকশা চালান মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, রাত যত গভীর হয়, যৌনকর্মীদের উৎপাত তত বাড়ে। দুদিন আগেও তখন রাত ২টা। আমি রিকশা নিয়ে বাংলামটর থেকে কাওরানবাজারে পথে পান্থকুঞ্জ পার্কটির মাঝবরাবর এলে দেখতে পাই কয়েকজন মিলে একজনকে টেনেহিঁচড়ে পার্কের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে সবকিছু রেখে ছেড়ে দেয়। অন্ধকারে কে যাবে ওখানে। সুযোগ বুঝে তারা মানুষ ধরে। আর হিজড়ারা পার্কের ভেতরে প্রকাশ্যে ওত পেতে থাকে। পান্থকুঞ্জ পার্কের বিষয়ে এসআই আরিফ বলেন, অনেকে তরুণ এখানে ইচ্ছে করে আসে। আবার হিজড়ারা অনেক পথচারীকে জোর করে ভেতরে নিয়ে যায়। ভেতরে নিয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়। আমরা কিছু বলতে গেলে হিজড়ারা যা মুখে আসে তা-ই বলে। তবে এমন কিছু দেখলে আমরা তৎক্ষণাৎ আইনি পদেক্ষেপ নিই।
গত ১ এপ্রিল রাতে এসব এলাকায় ফোর্স নিয়ে টহল দিয়েছিলেন শাহবাগ থানার এসআই আব্দুল্লাহ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব পাশে যৌনকর্মীদের উৎপাতের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাস্তার আইল্যান্ড পর্যন্ত আমাদের এলাকা। রাতে যৌনকর্মীদের মাঝেমধ্যে দেখা যায়। আমাদের চোখে পড়লে আমরা সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালাই। তারপরও কেন এসব অপরাধ কমছে না, এমন প্রশ্নের উত্তরে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ বলেন, এসব এলাকায় মাদক সেবন করছে, এমন অভিযোগে আমরা প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে গ্রেফতার করছি। অপরাধী তো অপরাধীই। এরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হোক আর যে-ই হোক, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। পান্থকুঞ্জের দিকে শুধু হিজড়া না যৌনকর্মীদের চলাচল আছে। আমাদের ফোর্স সব সময়ই থাকে এসব এলাকায়। এসব বিষয়ে আমাদের অভিযান চলছে এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান ওসি নূর মোহাম্মদ।
এ প্রসঙ্গে রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছবি হাটের গেটের দিকে যারা বসেন, তাদের বেশির ভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী। সুতরাং ঢালাওভাবে বলা যাচ্ছে না সবাই গাঁজা খায় কিংবা মাদক সেবন করে। ওখানে গিয়ে মাদক সেবন করছে এমন অভিযোগে আমরা এর আগে গ্রেফতার করেছি। কোনও অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হলে আর খবর পেলে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি আমরা। তবে এসব অপরাধমূলক কাজ আগের চেয়ে অনেক কমেছে বলে তিনি দাবি করেন।