রাজশাহী সংবাদদাতা: রাজশাহীর কৃষকরা আগাম শীতকালীন সবজি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। মৌসুম শুরুর আগেই বাজারে সবজি তুলতে পারায় তারা ভালো দাম পাচ্ছেন। ফলে জেলার সচেতন কৃষকদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে আগাম জাতের সবজির চারা রোপণ করলে শীতের শুরুতেই বাজারজাত করা যায়। সাধারণত নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যে শীতকালীন সবজি বাজারে আসে। সে সময় বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত দাম পান না। কিন্তু বর্ষার শেষভাগে যখন মাঠে নতুন সবজি ওঠে, তখন বাজারে সরবরাহ কম ও চাহিদা বেশি থাকে। ফলে এই সময় আগাম সবজি বিক্রি করে কৃষকরা আশানুরূপ লাভ পান। একই সঙ্গে এ সময় পোকামাকড়ের আক্রমণ ও রোগবালাই তুলনামূলক কম থাকে বলে কীটনাশকমুক্ত ও গুণগত মানসম্পন্ন সবজি উৎপাদন সম্ভব হয়।
সরেজমিন পবা উপজেলার পারিলা, বড়গাছী, হরিপুর, নওহাটা, দামকুড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফসলের মাঠজুড়ে এখন সবুজের সমারোহ। আগাম জাতের শিম, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, করলা, লাউ, লালশাক, পুঁইশাক, টমেটো ও পালংশাকের চারা রোপণ ও পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকরা। কোথাও কৃষকরা চারা রোপণ করছেন, কোথাও আবার আগাম সবজি তোলা শুরু হয়েছে। মাঠে কাজ করছেন পুরুষদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও। অনেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়েই কাজ করছেন।
রাজশাহীর নওহাটা কাঁচা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগাম জাতের লাউ, মুলা, লালশাক ও ফুলকপি বাজারে উঠতে শুরু করেছে। এখনও সরবরাহ কম থাকায় দামও অনেক বেশি। এই বাজারে প্রতিটি লাউ পাইকারি ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি করছেন কৃষকরা। খুচরা বাজারে দাম ৫০-৫৫ টাকা।
রাজশাহী নগরীর অন্যতম বৃহৎ কাঁচাবাজার মাস্টারপাড়া। খুব ভোর থেকেই এখানে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সবজি আসে। ভোরে পাইকারি ও পরে খুচরা বিক্রি শুরু হয়। রবিবার (৫ অক্টোবর) রাজশাহী নগরীর মাস্টারপাড়ায় কাঁচা সবজির বিক্রেতারা জানান, রবিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে পাইকারি পুঁইশাক ৫ কেজি ১০০ টাকা, বেগুন ৫ কেজি ৫৫০ টাকা, লালশাক এক আঁটি ১০ থেকে ২০ টাকা করে বিক্রি করেছি।
মাস্টারপাড়া বাজারের একজন ক্রেতা বললেন, ‘খুব ভোরে আসলে পাইকারি দরে সবজি কেনা যায়। আমি এক কেজি বেগুন ও এক কেজি মুলা কিনেছি ১৫০ টাকায়। কিন্তু শীতের সবজি আগাম পাওয়া গেলেও তেমন স্বাদ হয় না।’
কথা হয় হরিপুর ইউনিয়নের সোনাইকান্দি গ্রামের কৃষক মশিউর রহমান সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি এক বিঘা জমিতে আগাম জাতের লাউ চাষ করেছি। খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। পাইকারি বাজারে ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি করে মোট এক বিঘা জমিতে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় লাউ বিক্রি করেছি। এতে লাভ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১০ টাকা। গত বছর ৭০ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল, এবার বাজারে দাম বেশি হওয়ায় ৪০ হাজার টাকা বেশি লাভ পেয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘যেকোনও সবজি মৌসুমের আগে বাজারে তুলতে পারলে দাম ভালো পাওয়া যায়। এখন আগাম জাতের লাউ, মুলা, লালশাক, পুঁইশাক, করলা, পালংশাক ও টমেটো বাজারে উঠছে, এবং আমরা ভালো দাম পাচ্ছি।’
একই গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এবার এক বিঘা জমিতে আগাম জাতের ফুলকপি চাষ করেছি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বাজারজাত করতে মোট খরচ হবে ৪৫ হাজার টাকার মতো। আশা করছি, ১০-১৫ দিনের মধ্যেই বাজারে কপি তুলতে পারবো।’
তিনি আরো বলেন, ‘গত বছর এই জমিতেই ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ফুলকপি বিক্রি করেছিলাম। এবারও সেই আশাই কাজ করছি। মৌসুমের শুরুতে দাম বেশি থাকে, তাই ঝুঁকি নিয়েও আগাম চাষ করছি।’
নওহাটা পৌর এলাকার পাইকপাড়া গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘৩০ শতক জমিতে আগাম কপি চাষ করেছি। আরও ২০ দিনের মধ্যেই বাজারে তুলতে পারবো। মৌসুমের শুরুতে সবজির দাম সব সময়ই বেশি থাকে, তাই ভালো লাভের আশা করছি।’
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় ১৫ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৭৯ হেক্টর জমিতে আগাম সবজি চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ৩০ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, যা থেকে ৪ লাখ ২২ হাজার ৮০০ টন সবজি উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, ‘আগাম সবজি চাষ এখন অত্যন্ত লাভজনক একটি পদ্ধতি। এতে একদিকে যেমন কৃষকের আর্থিক উন্নতি ঘটছে, অন্যদিকে স্থানীয় বাজারেও সবজির সরবরাহ বাড়ছে। তাই অনেক চাষি এখন আগাম জাতের চাষে ঝুঁকে নিজেদের জীবনে পরিবর্তন আনছেন। আমরা কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, কীটনাশকমুক্ত উৎপাদন ও রোগবালাই দমনে নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আগাম চাষে ঝুঁকি তুলনামূলক কম, কারণ এই সময় পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের প্রকোপ কম থাকে। পাশাপাশি কৃষকেরা কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন করতে পারছেন, যা ভোক্তাদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।’
পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ এম এ মান্নান বলেন, ‘আগাম শীতকালীন সবজি চাষ এখন কৃষকদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে উঠেছে। মৌসুমের আগে বাজারে সবজি তুলতে পারলে কৃষকেরা ভালো দাম পান। এ কারণে গত কয়েক বছরে কৃষকদের আগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর নিয়মিত মাঠপর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছে। আগাম সবজি চাষে চারা নির্বাচন, জমি প্রস্তুতি, সার প্রয়োগ ও সেচ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আগাম জাতের ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, করলা, শিম ও টমেটো চাষে কৃষকরা এবার ভালো ফলন ও দাম দুই-ই পাচ্ছেন।’
এসি/আপ্র/১১/১০/২০২৫