এ টি এম জিয়াউল হাসান : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়ার আয়োজনে ‘দেশ সংস্কার– রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সশস্ত্র বাহিনী’ কীভাবে সম্ভব-এ বিষয়ে একটি আলোচনা সভা হয়ে গেল ১২ এপ্রিল। সেখানে দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির চিন্তা ও মতামত বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তাদের একজন একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। আরেকজন আমাদের সাবেক সহকর্মী।
দুজনই প্রাঞ্জল ভাষায় তাদের নিজস্ব ঢংয়ে কথা বলেছেন- যা উপস্থিত শ্রোতাদের আকৃষ্ট করেছে। তবে আলোচনার শেষাংশে তারা কিছু সুপারিশ করেছেন- যা কাঙ্ক্ষিত সংস্কারকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ফেলে পুরো সংস্কার প্রক্রিয়াকে অহেতুক দীর্ঘায়িত করতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে কোনো পরিবর্তন অতি দ্রুত করা আবশ্যক। কারণ দেরি করলেই ওইসব অপরিহার্য পরিবর্তনগুলো আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। তাই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে নিজেদেরকে যথাযথ সংশোধন করে দ্রুত সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে পারেন।
সংস্কার ঘোষণা দিয়ে করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। সংস্কারের জন্য যা দরকার, তার তালিকা করে ফেলতে পারলেই খুবই দ্রুত তা করা সম্ভব।
সামরিক বাহিনীর ভেতরে সংস্কারের অনেক উদাহরণ আছে। কারণ এই বাহিনী জানে কীভাবে নিজের ঘর পরিষ্কার করতে হয়। সেটুকু করলেই প্রাথমিক কাজ হয়ে যায়। অতীতে আমরা দেখেছি নিজেদের অভিযানিক বা প্রশাসনিক ভুলত্রুটি কেসস্টাডি হিসেবে আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সকল কর্মকর্তাকে দেওয়া হতো।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সশস্ত্র বাহিনীর কোনো কিছুই, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ ও সাংগঠনিক দুর্বলতা লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয় বা তাদের কর্মকাণ্ডও গোপন রাখা সম্ভব নয়। কেননা সশস্ত্র বাহিনী সমাজেরই একটি অংশ। তাই এর ভেতরে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা সবাই জানে। এখানে ন্যায় হলেও মানুষ জানবে। অন্যায় হলেও জানবে। তাই যদি হয় আর সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে দেশের মানুষের যখন অনেক প্রত্যাশা, তাহলে সে প্রত্যাশা মেটাতে আমরা কেন ভয় পাচ্ছি? বরং আমরা আরো সাহসী হয়ে নিজেদের আবর্জনা দ্রুত দূর করে ফেলতে পারছি না কেন? এই আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য নেতৃত্ব পর্যায়ে শূন্যতা তৈরির কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ সশস্ত্র বাহিনীই একমাত্র সংগঠন, যারা নিয়মিতভাবে স্ট্রাটেজিক, অপারেশনাল এবং ট্যাক্টিকাল লেভেলের নেতা তৈরি করে আসছে এর জন্মলগ্ন থেকে। সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য প্রথমে নিজেকে বদলাতে হবে। আর তা করতে হলে যা দরকার:
১. ইচ্ছা বা উইল থাকতে হবে।
২. সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সংবিধানের প্রতি অনুগত। কোনো দল বা ব্যক্তির প্রতি অনুগত হবেন না। প্রয়োজনে পদোন্নতির সময় পুনরায় শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করা। এ ধরনের চর্চা অনেক দেশের সেনাবাহিনীতে আছে। এতে শপথ ভঙ্গের নীতিগত চাপ থাকবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর।
৩. নিজ সংগঠনের প্রতি আনুগত্য ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ইন্টেগ্রিটির সঙ্গে কোনো আপস চলবে না।
৫. ‘আন ল ফুল’ বা বেআইনি আদেশ পালনে ‘না’ বলতে শেখা। কিন্তু ‘না’ বলতে হলে বাহিনীর সদস্যদের সাথে নিজেদের প্রথা অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ আলোচনা করে বাহিনীর মতামত হিসেবে ‘না’ বলতে পারতে হবে। যেমন জুলাই অভ্যুত্থানে বাহিনীর প্রধানগণ সরকারকে স্পষ্টভাবে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছিলেন। এসব নিশ্চিত করা গেলে সশস্ত্র বাহিনী এমনিতেই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে যাবে।
সমস্যা হলো, আমরা রাজনৈতিক কালচার বা ওই জগতের চরিত্র ও ব্যক্তির্গকে শোধরাতে পারছি না, কারণ ওই চারণভূমি আমাদের নয়। আর তাদের শোধরানোর দায়িত্বও সশস্ত্র বাহিনীর নয়। স্মরণ করতে পারি, ২০০৬ সালের শেষদিকে তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ রাজনীতিবিদদের ‘সংশোধন করার’ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথমে সম্ভবত ছয়জন অফিসারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তিনি আলাপ করেন। তখন মঈন আহমেদকে বলা হয়েছিল, রাজনীতিবিদদের সংশোধনের দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কি না? কিন্তু তিনি বিষয়টি পাত্তা দেননি। কেননা ততক্ষণে তিনি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন যে, তিনি কী করবেন। পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি ওই অনধিকার চর্চার খেসারত শুধু ওয়ান ইলেভেনের উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদেরই নয়, বরং পুরো সেনাবাহিনীকে দিতে হয়েছে। সুতরাং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা কত দ্রুত নিজেদের বদলাতে পারেন, সেই চেষ্টাটা জরুরি।
আরো একটা বিষয় মনে রাখতে হবে। সেটি হলো, দেশে আরো দুই বা তিনবার সশস্ত্র বাহিনী এ ধরনের ‘জাতীয় বিপদজ্জনক’ (ঘধঃরড়হধষ ঈৎরংবং) পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। যেমন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবে সেনাবাহিনী দেশকে একটি গৃহযুদ্ধ থেকে উদ্ধার করেছিল। এরপর ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে অপসারণের সময়ও সেনাবাহিনী জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতিকে অস্থির পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্তি দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কিন্তু ওই সময়ে বা এরপরেও সেনাবাহিনীর সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগও শুনিনি। অর্থাৎ সশস্ত্র বাহিনীকে চব্বিশের বিপ্লব-পরবর্তী সময়ের মতো বিতর্কিত হতে হয়নি বা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু এবার কেন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিশুদ্ধকরণের দাবি জনসাধারণের মধ্য থেকে বারবার উঠে আসছে বা বাহিনীর প্রধানদের চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে- তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।
প্রশ্ন হলো, বিগত দেড় দশকে এই বাহিনীর কারা কী এমন করলেন যে, আমাদের এই বদনামের বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে? সুতরাং এই বোঝা যতই দ্রুত খালাস করা সম্ভব, ততই দ্রুত আমরা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে পারব- যা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে এবং সশস্ত্র বাহিনী দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে শ্রদ্ধা ও সমীহের পাত্র হয়ে থাকবে, যা একসময় ছিল।
লেখক: কলামিস্ট