ঢাকা ০১:৫৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়

  • আপডেট সময় : ০৮:০৪:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

অনিরুদ্ধ অনিকেত

রাজনীতি একটি শুদ্ধ ও মহান পেশা- যার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, নীতি নির্ধারণ হয় এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়। দেশের ক্রান্তিকালে, স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্বের সংকটে রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এবং দেশের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক মত ও আদর্শের অবস্থান থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং এ বৈচিত্র্যই গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত রাখে। মানুষকে পরমত সহিষ্ণু করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমান সময়ে রাজনীতিতে একটি নেতিবাচক প্রবণতা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। তা হলো, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অত্যন্ত নিম্নমানের অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত আক্রমণ। এই ধারা কেবল রাজনীতির শালীনতা নষ্ট করছে না, বরং গণতন্ত্রের ভিত্তিকেও নিদারুণভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক ভিন্নমত- গণতন্ত্রের সৌন্দর্য: গণতান্ত্রিক সমাজে মতপার্থক্য থাকবে, থাকবে ভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন ও নীতির ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা হবে যুক্তির, প্রমাণের, যুগোপযোগী, ভদ্রজনোচিত, দেশপ্রেমের এবং উন্নয়নমূলক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির। একে অপরের নীতির গঠনমূলক সমালোচনা ও ক্ষেত্রবিশেষে শিষ্ঠাচারের সাথে চ্যালেঞ্জ করাই রাজনীতির সৌন্দর্য। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে যখন ব্যক্তি আক্রমণে পরিণত করা হয়, তখন তা পরিণত হয় বিতন্ডা ও বিদ্বেষে, যা সমাজে হিংস্রতা, বিভক্তি ও হিংসার জন্ম দেয়।

ব্যক্তিগত আক্রমণের কদর্যরূপ: ব্যক্তিগত আক্রমণ বলতে বোঝানো হয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চরিত্রহনন, পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত ব্যর্থতা কিংবা গোপনীয়তা নিয়ে আক্রমণ করা। অনেক সময় এসব আক্রমণ হয় উদ্দেশ্যমূলক গুজবের মাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসা রটিয়ে, কিংবা জনসভায় অপমানজনক বক্তব্য দিয়ে ও কুমন্তব্য করে। এসব কাজ কেবল রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গই নয়, বরং একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনও বটে। ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে নিয়ে শিষ্টাচার বহির্ভূত কটূক্তি করা হচ্ছে। অপরদিকে বিএনপিও ফ্যাসিবাদী বয়ানকে সামনে নিয়ে আসছে। দুটি কাজই নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ। এসব করে দেশের কল্যাণ হবে না। জুলাই শহীদগণ এসব দেখে ও শুনে আমাদের অভিশাপ দিচ্ছে।

ব্যক্তিগত আক্রমণ দেশের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর: রাজনীতির গুণগত মান কমে যায়। যখন রাজনৈতিক বিতর্কের জায়গা দখল করে কুৎসা, অপবাদ এবং গালিগালাজ, তখন নীতিনির্ধারণের মান নেমে আসে। জনগণের সামনে সঠিক তথ্য ও বিশ্লেষণের পরিবর্তে কাদা ছোড়াছুড়ি চলে, যার ফলে জনসাধারণ বিভ্রান্ত হয়। ফলে নতুন প্রজন্ম রাজনীতি বিমুখ হয়। যারা রাজনীতিতে যোগ দিতে আগ্রহী, তারা যখন দেখে রাজনীতিতে ব্যক্তিগত চরিত্র হননের প্রবণতা, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে যোগ্য ও মেধাবী তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। এভাবে সমাজে বিভক্তি তৈরি হয়। ব্যক্তিগত আক্রমণ শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিভক্তি তৈরি করে। দলীয় অনুসারীরা ব্যক্তিপর্যায়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, যার পরিণতিতে সমাজে হিংসা ও অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া নৈতিকতা ও মানবিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজনীতিকে একটি অনৈতিক খেলায় পরিণত করে। রাজনীতি আর জনসেবার মাধ্যম থাকে না, বরং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। তাই এসব থেকে মুক্তির জন্য সৃজনশীল ও ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা প্রয়োজন।

রাজনীতি হওয়া উচিত মত ও যুক্তির লড়াই। প্রতিপক্ষের পরিকল্পনার দুর্বলতা তুলে ধরা যেতে পারে, বিকল্প নীতি উপস্থাপন করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত আক্রমণের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হলো জনমত গঠনের জন্য বাস্তব প্রমাণ, গবেষণা এবং নীতিনির্ভর আলোচনা। উন্নত বিশ্বে এমন রাজনীতির উদাহরণ ভুরি ভুরি। উন্নত মানের গণতন্ত্রিক দেশে নির্বাচনী বিতর্ক হয় নীতিনির্ভর। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রার্থীরা প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত জীবন নয়, বরং তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, নীতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আমাদের দেশেও এই ধারা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়: সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে রাজনৈতিক শালীনতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গণতন্ত্র ও রাজনীতির মৌলিক শিক্ষা দিতে হবে; যাতে নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারে রাজনীতি মানে কুৎসা নয়, বরং সেবার মানসিকতা। রাজনীতি অভিজ্ঞতা ও মেধার অসাধারণ মেলবন্ধনে বৈচিত্র্যময় মতাদর্শের সুসমন্বিত রূপ।

মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দায়িত্ব: মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন জরুরি। কোনো অপপ্রচার বা ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক খবর প্রচার না করে বরং যুক্তিসম্মত, তথ্যভিত্তিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্লেষণ প্রচার করতে হবে। টকশোতে বিবাদ বিহীন চমৎকার বিতর্ক সৃষ্টি করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয়: রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নিজ নিজ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া—কীভাবে একজন ভদ্র ও যুক্তিনির্ভর রাজনৈতিক কর্মী হওয়া যায়। নির্বাচনী প্রচারণা কিংবা জনসভায় যেন কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক মন্তব্য না হয়, তা দলীয়ভাবে নিরীক্ষণ করা জরুরি। দলনেতাদের উচিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। যদি নেতৃত্ব ব্যক্তি আক্রমণ থেকে বিরত থাকেন, তাহলে অনুসারীরাও সেভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে শিখবে।

ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মীয় মূল্যবোধ: ইসলামসহ সব ধর্মেই মানুষের সম্মান রক্ষার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কাউকে অপমান করা, গিবত বা অপপ্রচার চালানো ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামের মহান নবী (সা.) তার জীবনে কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করেননি। এই মূল্যবোধ আমাদের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়। এই নীতিতে আমাদের রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ রাজনীতি কেবল ক্ষমতার খেলা নয়, এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব, একটি সেবার মাধ্যম। আমরা যদি রাজনীতিকে ব্যক্তিগত বিদ্বেষের হাতিয়ার বানাই, তবে গণতন্ত্র দুর্বল হবে, সমাজ বিভক্ত হবে এবং রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে। দেশ পড়বে মহাসংকটে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে সম্মান জানানো এবং শালীন ও যুক্তিভিত্তিক আলোচনায় বিশ্বাস রাখা। রাজনীতি হোক সম্মান, যুক্তি ও নীতির ভিত্তিতে। তবেই গড়ে উঠবে একটি উন্নত, সহনশীল, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ।

লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনবহুল এলাকায় যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়

আপডেট সময় : ০৮:০৪:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫

অনিরুদ্ধ অনিকেত

রাজনীতি একটি শুদ্ধ ও মহান পেশা- যার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, নীতি নির্ধারণ হয় এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়। দেশের ক্রান্তিকালে, স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্বের সংকটে রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এবং দেশের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক মত ও আদর্শের অবস্থান থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং এ বৈচিত্র্যই গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত রাখে। মানুষকে পরমত সহিষ্ণু করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমান সময়ে রাজনীতিতে একটি নেতিবাচক প্রবণতা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। তা হলো, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অত্যন্ত নিম্নমানের অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত আক্রমণ। এই ধারা কেবল রাজনীতির শালীনতা নষ্ট করছে না, বরং গণতন্ত্রের ভিত্তিকেও নিদারুণভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক ভিন্নমত- গণতন্ত্রের সৌন্দর্য: গণতান্ত্রিক সমাজে মতপার্থক্য থাকবে, থাকবে ভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন ও নীতির ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা হবে যুক্তির, প্রমাণের, যুগোপযোগী, ভদ্রজনোচিত, দেশপ্রেমের এবং উন্নয়নমূলক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির। একে অপরের নীতির গঠনমূলক সমালোচনা ও ক্ষেত্রবিশেষে শিষ্ঠাচারের সাথে চ্যালেঞ্জ করাই রাজনীতির সৌন্দর্য। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে যখন ব্যক্তি আক্রমণে পরিণত করা হয়, তখন তা পরিণত হয় বিতন্ডা ও বিদ্বেষে, যা সমাজে হিংস্রতা, বিভক্তি ও হিংসার জন্ম দেয়।

ব্যক্তিগত আক্রমণের কদর্যরূপ: ব্যক্তিগত আক্রমণ বলতে বোঝানো হয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চরিত্রহনন, পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত ব্যর্থতা কিংবা গোপনীয়তা নিয়ে আক্রমণ করা। অনেক সময় এসব আক্রমণ হয় উদ্দেশ্যমূলক গুজবের মাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসা রটিয়ে, কিংবা জনসভায় অপমানজনক বক্তব্য দিয়ে ও কুমন্তব্য করে। এসব কাজ কেবল রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গই নয়, বরং একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনও বটে। ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে নিয়ে শিষ্টাচার বহির্ভূত কটূক্তি করা হচ্ছে। অপরদিকে বিএনপিও ফ্যাসিবাদী বয়ানকে সামনে নিয়ে আসছে। দুটি কাজই নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ। এসব করে দেশের কল্যাণ হবে না। জুলাই শহীদগণ এসব দেখে ও শুনে আমাদের অভিশাপ দিচ্ছে।

ব্যক্তিগত আক্রমণ দেশের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর: রাজনীতির গুণগত মান কমে যায়। যখন রাজনৈতিক বিতর্কের জায়গা দখল করে কুৎসা, অপবাদ এবং গালিগালাজ, তখন নীতিনির্ধারণের মান নেমে আসে। জনগণের সামনে সঠিক তথ্য ও বিশ্লেষণের পরিবর্তে কাদা ছোড়াছুড়ি চলে, যার ফলে জনসাধারণ বিভ্রান্ত হয়। ফলে নতুন প্রজন্ম রাজনীতি বিমুখ হয়। যারা রাজনীতিতে যোগ দিতে আগ্রহী, তারা যখন দেখে রাজনীতিতে ব্যক্তিগত চরিত্র হননের প্রবণতা, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে যোগ্য ও মেধাবী তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। এভাবে সমাজে বিভক্তি তৈরি হয়। ব্যক্তিগত আক্রমণ শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিভক্তি তৈরি করে। দলীয় অনুসারীরা ব্যক্তিপর্যায়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, যার পরিণতিতে সমাজে হিংসা ও অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া নৈতিকতা ও মানবিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজনীতিকে একটি অনৈতিক খেলায় পরিণত করে। রাজনীতি আর জনসেবার মাধ্যম থাকে না, বরং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। তাই এসব থেকে মুক্তির জন্য সৃজনশীল ও ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা প্রয়োজন।

রাজনীতি হওয়া উচিত মত ও যুক্তির লড়াই। প্রতিপক্ষের পরিকল্পনার দুর্বলতা তুলে ধরা যেতে পারে, বিকল্প নীতি উপস্থাপন করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত আক্রমণের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হলো জনমত গঠনের জন্য বাস্তব প্রমাণ, গবেষণা এবং নীতিনির্ভর আলোচনা। উন্নত বিশ্বে এমন রাজনীতির উদাহরণ ভুরি ভুরি। উন্নত মানের গণতন্ত্রিক দেশে নির্বাচনী বিতর্ক হয় নীতিনির্ভর। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রার্থীরা প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত জীবন নয়, বরং তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, নীতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আমাদের দেশেও এই ধারা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়: সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে রাজনৈতিক শালীনতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গণতন্ত্র ও রাজনীতির মৌলিক শিক্ষা দিতে হবে; যাতে নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারে রাজনীতি মানে কুৎসা নয়, বরং সেবার মানসিকতা। রাজনীতি অভিজ্ঞতা ও মেধার অসাধারণ মেলবন্ধনে বৈচিত্র্যময় মতাদর্শের সুসমন্বিত রূপ।

মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দায়িত্ব: মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন জরুরি। কোনো অপপ্রচার বা ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক খবর প্রচার না করে বরং যুক্তিসম্মত, তথ্যভিত্তিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্লেষণ প্রচার করতে হবে। টকশোতে বিবাদ বিহীন চমৎকার বিতর্ক সৃষ্টি করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয়: রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নিজ নিজ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া—কীভাবে একজন ভদ্র ও যুক্তিনির্ভর রাজনৈতিক কর্মী হওয়া যায়। নির্বাচনী প্রচারণা কিংবা জনসভায় যেন কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক মন্তব্য না হয়, তা দলীয়ভাবে নিরীক্ষণ করা জরুরি। দলনেতাদের উচিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। যদি নেতৃত্ব ব্যক্তি আক্রমণ থেকে বিরত থাকেন, তাহলে অনুসারীরাও সেভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে শিখবে।

ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মীয় মূল্যবোধ: ইসলামসহ সব ধর্মেই মানুষের সম্মান রক্ষার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কাউকে অপমান করা, গিবত বা অপপ্রচার চালানো ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামের মহান নবী (সা.) তার জীবনে কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করেননি। এই মূল্যবোধ আমাদের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়। এই নীতিতে আমাদের রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ রাজনীতি কেবল ক্ষমতার খেলা নয়, এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব, একটি সেবার মাধ্যম। আমরা যদি রাজনীতিকে ব্যক্তিগত বিদ্বেষের হাতিয়ার বানাই, তবে গণতন্ত্র দুর্বল হবে, সমাজ বিভক্ত হবে এবং রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে। দেশ পড়বে মহাসংকটে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে সম্মান জানানো এবং শালীন ও যুক্তিভিত্তিক আলোচনায় বিশ্বাস রাখা। রাজনীতি হোক সম্মান, যুক্তি ও নীতির ভিত্তিতে। তবেই গড়ে উঠবে একটি উন্নত, সহনশীল, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ।

লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ