ইয়াহিয়া নয়ন : ৯ ডিসেম্বর সারাদিন সারারাত দেশবাসী চরম উৎকণ্ঠায় সময় পার করেছে। কি হবে কাল, কি হতে যাচ্ছে আজ। জনমনে নানা প্রশ্ন ছিল। ১০ ডিসেম্বর যেন রাজধানীর বুকে দেশের এক পরীক্ষার দিন ছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ ধরনের অনিশ্চিত উত্তপ্ত অবস্থা বহুদিন দেখেনি দেশবাসী। অবশেষে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ১০ ডিসেম্বর সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির সভা নিয়ে এই দ্বৈরথে কোন পক্ষ লাভবান হচ্ছে তা বলা শক্ত। কার লাভ, কার লস, সেই হিসেবে যাবোনা।
এটা ঠিক যে, দেশের মানুষ দুই বড় দলের মধ্যে বিভক্ত, তবে সাম্প্রতিক আলামতে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বনের পরিবর্তে নিরপেক্ষ অবস্থানের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তার একটি কারণ নতুন প্রজন্মের মধ্যে পুরনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বহনে অনিচ্ছা। তারা নতুন যুগের নতুন বিশ্বব্যবস্থার নবীন নাগরিক। আশির দশক আর নব্বইয়ের দশকে মানুষের হাতে হাতে ইন্টারনেট-ক্যামেরা এসব ছিলনা। সিনেমাহল আর বাড়িতে টেলিভিশন ছিল বিনোদন আর তথ্য প্রাপ্তির মাধ্যম। তাই ওইসব সময়ের রাজনীতির ধারার সাথে বর্তমান প্রজন্ম একাতœ হতে পারেনা।
বর্তমান প্রজন্ম বিশ্ব রাজনীতি-অর্থনীতির খবর রাখে। দেশে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শিক্ষিত ছেলে-মেয়ের সংখ্যা বেড়েছে। কমেছে বেকারের সংখ্যা। ফলে বদলেছে তাদের মন মানসিকতা, তবে নতুন প্রজন্ম এবং সাধারণ নাগরিকরা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, কিছুটা হতাশাগ্রস্ত। আমরা লক্ষ করছি, বিদেশি কূটনীতিকরাও আর রাজনৈতিক ইস্যুতে চুপচাপ না থেকে মতামত দিচ্ছেন। তারা মূলত গণতান্ত্রিক নিয়ম মেনে বিরোধী পক্ষের অধিকার রক্ষার বিষয়ে কথা বলছেন। এতে তাদের অবস্থানকে বিরোধীদের প্রতি পক্ষপাত মনে হতে পারে। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ধারা অনুযায়ী একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্তর্গত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তার চেতনা গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তি ও দলের সপক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান। এ বিষয়টি স্পষ্ট না করায় বিএনপির রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বিদেশিরা এ দেশের ইতিহাসের বিষয় মাথায় না রেখে যখন কথা বলেন তখন তা ভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপের মতোই হয়ে থাকে। তাই সরকারের দিক থেকে এ নিয়ে আপত্তি উঠলে তাকে অন্যায্য বলা যাবে না।
যেমন, দেখা গেল ১০ ডিসেম্বরের বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল করার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। একইসঙ্গে দলটি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। শুক্রবার ৯ ডিসেম্বর বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানান দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম।
জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি বলেন, ‘সরকার বিরোধীদলকে দমন-পীড়নের অংশ হিসেবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা ও দলীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় গভীর রাতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে তাদের নিজ নিজ বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার সংবিধানস্বীকৃত জনগণের অধিকার বাস্তবায়নের পরিবর্তে হুমকি-ধমকি ও উসকানিমূলক যেসব ভাষায় বক্তব্য রাখছেন, তা নিন্দনীয়। এগুলো কোনো রাজনৈতিক ভাষা হতে পারে না। হাত ভেঙে দেওয়ার বক্তব্য দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।’ বিবৃতিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার একদফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান জামায়াত সেক্রেটারি।
প্রধান বিরোধীদলের সঙ্গে যখন যুদ্ধাপরাধীগোষ্ঠির এমন একতা, তখন নতুন প্রজন্ম বিব্রত হয়। প্রধান বিরোধী দলও তাদের (জামায়াত) একাতœ হতে আহ্বান করেছিল। সব দেখে বুঝে সাধারণ নাগরিক মাত্রই বিরক্ত হয়েছে। নেতারা গ্রেফতার হোলো, সারা দেশের কোথাও তেমন বিক্ষোভ দেখা যায়নি। প্রজন্মের চিন্তা-ধারণা বদলেছে। পুরোনো ধারায় তারা একাতœ হচ্ছেনা।
দেশে ২০২৪ সালে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এটা সবাই চাইছেন। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে নির্বাচন নিয়ে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে এটা তাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। আর এ উপলক্ষ হতে হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ভালো করার জন্য ভোটারদের মন জয়ের পথ সন্ধানই তাদের কাজ হওয়া উচিত, বিরোধী দল বা পক্ষকে দমন নয়। এতে শেষ রক্ষা হয় না। দেশের সাধারণ মানুষ অনেক চাপের মধ্যে আছে। তারা আর কোনো চাপ নিতে পারছেনা।
একই সঙ্গে নিরপেক্ষ মানুষ মনে করে রাজপথে সভা-সমাবেশ বন্ধ করা দরকার, সভা নির্ধারিত মাঠেই হতে হবে। ফলে শেষ পর্যন্ত বিএনপিও রাজপথ ছেড়ে মাঠে সভা আয়োজনে রাজি হয়ে সঠিক কাজই করেছে। জনগণ একে দলের সহনশীল দূরদর্শিতা ভাববে নাকি সরকারের চাপ ও আক্রমণাত্মক ভূমিকায় পিছু হটা বা দুর্বলতা ভাববে সেটা হয়তো বিবেচনায় নিতে হবে। একইভাবে ১০ ডিসেম্বর নিয়ে পুরো ঘটনার জন্য বিএনপির ওপর সরকার কি অসহিষ্ণুতা ও দমনমূলক আচরণের জন্য দায়ী হবে নাকি যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি দুর্বলতার জন্য চাপ বজায় রাখা ও শেষ পর্যন্ত ঔদার্য প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রশংসিত হবে সেটা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে। এ নিয়ে উভয় পক্ষ নিজ নিজ রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন করবে জনগণের কাছে- জনগণ সুষ্ঠু নির্বাচনে তার জবাব দেবে।
লেখক : সাংবাদিক।