ঢাকা ০৯:০২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০২ জুন ২০২৫

রাজনীতির অজানা আশঙ্কা

  • আপডেট সময় : ০৭:৩০:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫
  • ১৪ বার পড়া হয়েছে

গোলাম মাওলা রনি

কিছু কথা খোলামেলা বলা উচিত। কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার আমজনতার কণ্ঠের আওয়াজ জরুরি। আমাদের পছন্দ-অপছন্দকে চেপে রাখার যে অমানসিক কসরত আমরা গত কয়েক মাস ধরে যেভাবে চালিয়ে আসছি, তা যদি অব্যাহত থাকে তবে যে সর্বনাশের দিকে ধেয়ে চলেছি, তা গাণিতিক হারে বাড়তে থাকবে এবং আমাদের এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখান থেকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে কয়েক যুগ সময় লেগে যাবে।

সাবেক সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকারকে আমরা যেভাবে বরণ করে নিয়েছিলাম, এমন নজির গত ১০০ বছরে এশিয়া মহাদেশে ঘটেনি।

একটি অরাজনৈতিক গোষ্ঠী যাদের সঙ্গে জনগণের জানাশোনা ও বোঝাপড়া বলতে গেলে ছিল না। এদের অনেককে আমরা চিনতাম। তবে তা ছিল দূর থেকে চাঁদ দেখার মতো। তাদের কথা শুনে মনে হতো তাদের মতো যোগ্য লোক ধরাধামে নেই। তারা প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, চমৎকার করে কথা বলেন এবং জনসংযোগ, মার্কেটিং, আর্থিক উন্নয়ন এবং সরকারি-বেসরকারি আমলাতন্ত্রে কর্মের অভিজ্ঞতা ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকাতে তাদের জনসংযোগ নিয়ে আমাদের ধারণা ছিল রূপকথার আলাদিনের চেরাগের মতো। ফলে তারা যখন দেশের শাসনভার গ্রহণ করলেন তখন আমরা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং আস্থার এমন এক স্তরে তুলে তাদের ভালোবাসতে থাকলাম, যা স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো দিন করা হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের শেষ দিনগুলোয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা সম্মুখ সারিতে ছিলেন তাদের কয়েকজনকে নজিরবিহীনভাবে সরকারের মন্ত্রী পদমর্যাদায় বরণ করে নেওয়া হলো। বাকিদের সমন্বয়ক রূপে বরণ করা হলো। পরবর্তী সময়ে শত শত সমন্বয়ক সংঘবদ্ধ হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লেন।

আমরা অপাত্য স্নেহ ও ভালোবাসা নিয়ে সমন্বয়কদের সব কাজ মেনে পছন্দ-অপছন্দনিলাম। তারা রাস্তায় নামলেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে, সরকারি-বেসরকারি অফিসে গেলেন দুর্নীতিবাজ আওয়ামী দোসর ধরতে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, মসজিদ, মন্দির, বাসাবাড়ি, ফুটপাতের চটপটির দোকান, গরু-ছাগলের খামার থেকে শুরু করে পাড়ামহল্লায় রহিমার মায়ের পানের দোকান, টংঘর কিংবা চিতই পিঠা বিক্রির ফুটপাতের দোকানটিতে ফ্যাসিবাদের দোসর খুঁজতে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে আরম্ভ করে দিলেন।

সমন্বয়ক নামের তরুণদের দাপট-দৌরাত্ম্য যেমন বাড়ল, তেমনি তাদের সংখ্যা ও বয়সের সীমারেখা আকাশ স্পর্শ করল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে ৮০ বছরের গেদুর মা অথবা পচা মিয়ার বাবারা দলবদ্ধ হয়ে দেশের করপোরেট আইকন হিসেবে পরিচিত শিল্প প্রতিষ্ঠান, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ব্যাংক, বিমা, থানা-পুলিশ, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়লার ভাগাড়, সরকারি অফিস, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল, নাটক-সিনেমাপাড়া থেকে শুরু করে হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, মেস-বস্তি ইত্যাদি জায়গায় চিরুনি অভিযান চালিয়ে এমন ঘটনা ঘটাল; যা বাঙালি কোনোদিন দেখেনি, এমনকি কল্পনাও করেনি।তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক-কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের আদালতের পেশকার, সচিবালয়ের সেক্রেটারি থেকে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের ডিসি-টিএনও, পুলিশের আইজি থেকে চকিদার, রাস্তায় দায়িত্বরত সেনা সদস্য থেকে শুরু করে জেনারেল পদমর্যাদার সবার মধ্যে বিপ্লব-সংস্কার, মব সন্ত্রাস, জুলুম-অত্যাচার, স্বেচ্ছাচার, অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ ইত্যাদি একত্র করে মৃত্যুসঞ্জীবনী সালসা বানিয়ে বিনামূল্যে বিতরণ ও বিপণন শুরু করল এবং ক্ষণে ক্ষণে আওয়াজ তুলল- ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

গত ৯ মাসে রাষ্ট্র যে কীভাবে চলছে তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন না। অর্থনীতির চাকা কী ঘুরছে, বন্ধ হয়ে গেছে নাকি উল্টো ঘুরছে তা-ও জনগণ আন্দাজ করতে পারছে না। অসহায় মানুষ মব সন্ত্রাস, মগের মুল্লুক, নির্বাচন, সংস্কার, আওয়ামী লীগের বিচার এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামের হামানদিস্তার কবলে পড়ে আলুভর্তা হয়ে যাচ্ছে। অজ পাড়াগাঁয়ে নতুন বন্দোবস্তের চাঁদাবাজি, মাস্তানি, উপজেলা ও জেলা শহরে পুরোনো ও নতুন রাজনৈতিক টাউটদের সীমাহীন অত্যাচার, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনদের পৈশাচিক হুংকার, চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারীদের রাজত্ব, মব সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য, আন্দোলনকারীদের যথেচ্ছচার, থানা-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহায়ত্বের কারণে জনজীবনে সে বিষক্রিয়া তৈরি হয়েছে তা কোনোকালে সুবে বাংলায় ছিল না- এমনকি বর্গিদের জমানাতেও না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনগণের ওপর যেভাবে গলাবাজ, গালিবাজ, দুর্নীতিবাজ, কচি খোকাখুকিদের দল, বিদেশি দালাল, ফড়িয়া, ভাঁওতাবাজ, অযোগ্য, অথর্ব, মনুষ্য গুণাবলিবর্জিত লোভী-দুর্বল-বিবেকহীন-হৃদয়হীন প্রাণীদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; তা ২০২৫ সালের বাসিন্দা না হলে এবং বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের বাসিন্দা হলে অনুধাবন অসম্ভব ছিল।

উল্লিখিত অবস্থার কারণে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এক ঐতিহাসিক সংকটে পড়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে একাধিক স্তর তৈরি হয়েছে এবং একটি স্তরের সঙ্গে অন্য স্তরের আন্তঃসংযোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সম্পর্ক তো দূরের কথা, মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। বঙ্গভবন ও যমুনার মধ্যকার দূরত্ব পৃথিবী এবং চন্দ্রের দূরত্বকে ছাড়িয়ে গেছে। সংবিধান, জাতীয় সংগীত, মুক্তিযুদ্ধের মতো মীমাংসিত এবং পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বিষয়গুলো নিয়ে এমন বিতর্কের ঝড় তোলা হচ্ছে, যা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার-রিসেট বাটন-মাস্টারমাইন্ড নতুন বন্দোবস্ত, সংস্কার, মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দরকে লিজ দেওয়া, ভারত বিরোধিতা, পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব, স্টারলিংক স্যাটেলাইট কোম্পানিকে ব্যবসা করার সুযোগ প্রদান, বিদেশি নাগরিকদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পদপদবিতে বসানো, অবসরে চলে যাওয়া সাবেক আমলাদের এনে পুলিশ প্রশাসন ও সচিবালয়ের কৌশলগত বড় বড় পদে নিয়োগদানের ফলে পুরো দেশের সার্বিক সিস্টেমে যে জট তৈরি হয়েছে এবং মানুষের মন ও মস্তিষ্কে প্রতিমুহূর্তে যে বিষ উৎপন্ন হয়েছে, তা যদি পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় বিসর্জনের সুযোগ থাকত তবে সারা দেশ তীব্র বিষে সয়লাব হয়ে যেত।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় অতিবৃদ্ধ ও অতিবালকের অপূর্ব সম্মিলনের পাশাপাশি যেভাবে কোটা পদ্ধতির দাপট শুরু হয়েছে, তাতে করে দেশের পুরো প্রাকৃতিক ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। আত্মীয় কোটা, নারী কোটা, সুন্দরী কোটা, আঞ্চলিক কোটা, প্রিয়তম ও প্রিয়তমা কোটা, এনজিও কোটা, আমেরিকা কোটা, ইউটিউব কোটা, ফেসবুক কোটা, ওয়াজ কোটা, মোশাদ কোটা, র কোটা, পাকিস্তানি কোটা, ভাইয়া কোটা, ম্যাডাম কোটা, আন্ডারওয়ার্ল্ড কোটা, ছাত্র কোটা, জনতা কোটা, বিএনপি কোটা, জামায়াত কোটা, বিকাশ কোটা, নগদ কোটা, গ্রামীণ কোটা, শহুরে কোটা, বস্তি কোটার মতো হাজার হাজার কোটাধারী ইউনিয়ন পরিষদের চকিদার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে যেভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে; এতে দুনিয়ার বালামুসিবতের সঙ্গে সঙ্গে পাইকারি হারে আসমানি বালামুসিবত উল্কার বেগে ধেয়ে আসছে।

উল্লিখিত কারণে মানুষের কাজের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। কাজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং কাজের স্থান সংকুচিত হয়ে ভয়াবহ বেকার সমস্যা দেখা দিয়েছে। ঘরে ঘরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশান্তি হানা দিয়েছে। অফিস-আদালত খাঁ খাঁ করছে। কলকারখানার চাকা ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে, ব্যাংকগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে এবং মানুষের সঞ্চয় মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম গগনচুম্বী। টাকার প্রবাহ কমে গিয়েছে এবং ধনী-দরিদ্রের বিভেদ বেড়েই চলেছে।

সমাজে বিদ্যুতের গতিতে অর্থনৈতিক বিবর্তন হচ্ছে এবং বড় বড় ধনী রাতারাতি পথের ফকির হয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখায় গিয়ে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দারিদ্র্যের অভিশাপকে জাদুঘরে পাঠিয়ে গিনেস বুকে নতুন রেকর্ড স্থাপনের পাঁয়তারা শুরু করেছে।

মানুষের হাসি বন্ধ হয়ে গেছে। কান্না-দীর্ঘশ্বাস-খিস্তিখেউড় এখন জাতীয় ভাষায় পরিণত হয়ে গেছে। ফলে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে যারা যত অশ্লীল, অশ্রাব্য, অকথ্য ও নগ্ন ভাষায় গালাগাল দিতে পারে, তাদের হতাশার সাগরে নিমজ্জিত অথর্বরা নিজেদের মানসপিতা বানিয়ে মাতালের মতো উল্লাসনৃত্য শুরু করেছে। তাদের তাণ্ডবে কবি কবিতা লিখতে ভুলে গেছে, গায়ক নির্বাক হয়ে ভাবছে কী গাইবেন আর বুদ্ধিজীবীরা তাদের বুদ্ধি বন্ধক রাখার জন্য সিন্ধুকের খোঁজে সিন্ধু নদীর অববাহিকায় হিজরতের চিন্তা করছেন।

রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। আইনের বই থেকে আইন উধাও হয়ে মব সন্ত্রাসের সম্রাটদের পায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নীতিনৈতিকতা, ধর্মকর্ম থমকে গেছে। মানুষের জবানের ওপর বজ্রপাত হয়েছে। চিন্তার দরজা বন্ধ। বিবেক অন্ধ এবং চরিত্র প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওঠানামা করছে। ফলে সবকিছুতেই লডর-ভডর লেগে গেছে এবং এক অজানা আশঙ্কা অনিশ্চিত পথযাত্রা এবং অদৃশ্যশক্তির নড়াচড়ায় জীবনের গতি, ছন্দ, গীত, সংগীত বন্ধ হতে চলেছে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

রাজনীতির অজানা আশঙ্কা

আপডেট সময় : ০৭:৩০:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

গোলাম মাওলা রনি

কিছু কথা খোলামেলা বলা উচিত। কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার আমজনতার কণ্ঠের আওয়াজ জরুরি। আমাদের পছন্দ-অপছন্দকে চেপে রাখার যে অমানসিক কসরত আমরা গত কয়েক মাস ধরে যেভাবে চালিয়ে আসছি, তা যদি অব্যাহত থাকে তবে যে সর্বনাশের দিকে ধেয়ে চলেছি, তা গাণিতিক হারে বাড়তে থাকবে এবং আমাদের এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখান থেকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে কয়েক যুগ সময় লেগে যাবে।

সাবেক সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকারকে আমরা যেভাবে বরণ করে নিয়েছিলাম, এমন নজির গত ১০০ বছরে এশিয়া মহাদেশে ঘটেনি।

একটি অরাজনৈতিক গোষ্ঠী যাদের সঙ্গে জনগণের জানাশোনা ও বোঝাপড়া বলতে গেলে ছিল না। এদের অনেককে আমরা চিনতাম। তবে তা ছিল দূর থেকে চাঁদ দেখার মতো। তাদের কথা শুনে মনে হতো তাদের মতো যোগ্য লোক ধরাধামে নেই। তারা প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, চমৎকার করে কথা বলেন এবং জনসংযোগ, মার্কেটিং, আর্থিক উন্নয়ন এবং সরকারি-বেসরকারি আমলাতন্ত্রে কর্মের অভিজ্ঞতা ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকাতে তাদের জনসংযোগ নিয়ে আমাদের ধারণা ছিল রূপকথার আলাদিনের চেরাগের মতো। ফলে তারা যখন দেশের শাসনভার গ্রহণ করলেন তখন আমরা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং আস্থার এমন এক স্তরে তুলে তাদের ভালোবাসতে থাকলাম, যা স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো দিন করা হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের শেষ দিনগুলোয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা সম্মুখ সারিতে ছিলেন তাদের কয়েকজনকে নজিরবিহীনভাবে সরকারের মন্ত্রী পদমর্যাদায় বরণ করে নেওয়া হলো। বাকিদের সমন্বয়ক রূপে বরণ করা হলো। পরবর্তী সময়ে শত শত সমন্বয়ক সংঘবদ্ধ হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লেন।

আমরা অপাত্য স্নেহ ও ভালোবাসা নিয়ে সমন্বয়কদের সব কাজ মেনে পছন্দ-অপছন্দনিলাম। তারা রাস্তায় নামলেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে, সরকারি-বেসরকারি অফিসে গেলেন দুর্নীতিবাজ আওয়ামী দোসর ধরতে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, মসজিদ, মন্দির, বাসাবাড়ি, ফুটপাতের চটপটির দোকান, গরু-ছাগলের খামার থেকে শুরু করে পাড়ামহল্লায় রহিমার মায়ের পানের দোকান, টংঘর কিংবা চিতই পিঠা বিক্রির ফুটপাতের দোকানটিতে ফ্যাসিবাদের দোসর খুঁজতে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে আরম্ভ করে দিলেন।

সমন্বয়ক নামের তরুণদের দাপট-দৌরাত্ম্য যেমন বাড়ল, তেমনি তাদের সংখ্যা ও বয়সের সীমারেখা আকাশ স্পর্শ করল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে ৮০ বছরের গেদুর মা অথবা পচা মিয়ার বাবারা দলবদ্ধ হয়ে দেশের করপোরেট আইকন হিসেবে পরিচিত শিল্প প্রতিষ্ঠান, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ব্যাংক, বিমা, থানা-পুলিশ, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়লার ভাগাড়, সরকারি অফিস, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল, নাটক-সিনেমাপাড়া থেকে শুরু করে হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, মেস-বস্তি ইত্যাদি জায়গায় চিরুনি অভিযান চালিয়ে এমন ঘটনা ঘটাল; যা বাঙালি কোনোদিন দেখেনি, এমনকি কল্পনাও করেনি।তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক-কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের আদালতের পেশকার, সচিবালয়ের সেক্রেটারি থেকে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের ডিসি-টিএনও, পুলিশের আইজি থেকে চকিদার, রাস্তায় দায়িত্বরত সেনা সদস্য থেকে শুরু করে জেনারেল পদমর্যাদার সবার মধ্যে বিপ্লব-সংস্কার, মব সন্ত্রাস, জুলুম-অত্যাচার, স্বেচ্ছাচার, অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ ইত্যাদি একত্র করে মৃত্যুসঞ্জীবনী সালসা বানিয়ে বিনামূল্যে বিতরণ ও বিপণন শুরু করল এবং ক্ষণে ক্ষণে আওয়াজ তুলল- ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

গত ৯ মাসে রাষ্ট্র যে কীভাবে চলছে তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন না। অর্থনীতির চাকা কী ঘুরছে, বন্ধ হয়ে গেছে নাকি উল্টো ঘুরছে তা-ও জনগণ আন্দাজ করতে পারছে না। অসহায় মানুষ মব সন্ত্রাস, মগের মুল্লুক, নির্বাচন, সংস্কার, আওয়ামী লীগের বিচার এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামের হামানদিস্তার কবলে পড়ে আলুভর্তা হয়ে যাচ্ছে। অজ পাড়াগাঁয়ে নতুন বন্দোবস্তের চাঁদাবাজি, মাস্তানি, উপজেলা ও জেলা শহরে পুরোনো ও নতুন রাজনৈতিক টাউটদের সীমাহীন অত্যাচার, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনদের পৈশাচিক হুংকার, চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারীদের রাজত্ব, মব সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য, আন্দোলনকারীদের যথেচ্ছচার, থানা-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহায়ত্বের কারণে জনজীবনে সে বিষক্রিয়া তৈরি হয়েছে তা কোনোকালে সুবে বাংলায় ছিল না- এমনকি বর্গিদের জমানাতেও না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জনগণের ওপর যেভাবে গলাবাজ, গালিবাজ, দুর্নীতিবাজ, কচি খোকাখুকিদের দল, বিদেশি দালাল, ফড়িয়া, ভাঁওতাবাজ, অযোগ্য, অথর্ব, মনুষ্য গুণাবলিবর্জিত লোভী-দুর্বল-বিবেকহীন-হৃদয়হীন প্রাণীদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; তা ২০২৫ সালের বাসিন্দা না হলে এবং বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের বাসিন্দা হলে অনুধাবন অসম্ভব ছিল।

উল্লিখিত অবস্থার কারণে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এক ঐতিহাসিক সংকটে পড়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে একাধিক স্তর তৈরি হয়েছে এবং একটি স্তরের সঙ্গে অন্য স্তরের আন্তঃসংযোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সম্পর্ক তো দূরের কথা, মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। বঙ্গভবন ও যমুনার মধ্যকার দূরত্ব পৃথিবী এবং চন্দ্রের দূরত্বকে ছাড়িয়ে গেছে। সংবিধান, জাতীয় সংগীত, মুক্তিযুদ্ধের মতো মীমাংসিত এবং পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বিষয়গুলো নিয়ে এমন বিতর্কের ঝড় তোলা হচ্ছে, যা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার-রিসেট বাটন-মাস্টারমাইন্ড নতুন বন্দোবস্ত, সংস্কার, মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দরকে লিজ দেওয়া, ভারত বিরোধিতা, পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব, স্টারলিংক স্যাটেলাইট কোম্পানিকে ব্যবসা করার সুযোগ প্রদান, বিদেশি নাগরিকদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পদপদবিতে বসানো, অবসরে চলে যাওয়া সাবেক আমলাদের এনে পুলিশ প্রশাসন ও সচিবালয়ের কৌশলগত বড় বড় পদে নিয়োগদানের ফলে পুরো দেশের সার্বিক সিস্টেমে যে জট তৈরি হয়েছে এবং মানুষের মন ও মস্তিষ্কে প্রতিমুহূর্তে যে বিষ উৎপন্ন হয়েছে, তা যদি পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় বিসর্জনের সুযোগ থাকত তবে সারা দেশ তীব্র বিষে সয়লাব হয়ে যেত।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় অতিবৃদ্ধ ও অতিবালকের অপূর্ব সম্মিলনের পাশাপাশি যেভাবে কোটা পদ্ধতির দাপট শুরু হয়েছে, তাতে করে দেশের পুরো প্রাকৃতিক ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। আত্মীয় কোটা, নারী কোটা, সুন্দরী কোটা, আঞ্চলিক কোটা, প্রিয়তম ও প্রিয়তমা কোটা, এনজিও কোটা, আমেরিকা কোটা, ইউটিউব কোটা, ফেসবুক কোটা, ওয়াজ কোটা, মোশাদ কোটা, র কোটা, পাকিস্তানি কোটা, ভাইয়া কোটা, ম্যাডাম কোটা, আন্ডারওয়ার্ল্ড কোটা, ছাত্র কোটা, জনতা কোটা, বিএনপি কোটা, জামায়াত কোটা, বিকাশ কোটা, নগদ কোটা, গ্রামীণ কোটা, শহুরে কোটা, বস্তি কোটার মতো হাজার হাজার কোটাধারী ইউনিয়ন পরিষদের চকিদার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে যেভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে; এতে দুনিয়ার বালামুসিবতের সঙ্গে সঙ্গে পাইকারি হারে আসমানি বালামুসিবত উল্কার বেগে ধেয়ে আসছে।

উল্লিখিত কারণে মানুষের কাজের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। কাজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং কাজের স্থান সংকুচিত হয়ে ভয়াবহ বেকার সমস্যা দেখা দিয়েছে। ঘরে ঘরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশান্তি হানা দিয়েছে। অফিস-আদালত খাঁ খাঁ করছে। কলকারখানার চাকা ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে, ব্যাংকগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে এবং মানুষের সঞ্চয় মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম গগনচুম্বী। টাকার প্রবাহ কমে গিয়েছে এবং ধনী-দরিদ্রের বিভেদ বেড়েই চলেছে।

সমাজে বিদ্যুতের গতিতে অর্থনৈতিক বিবর্তন হচ্ছে এবং বড় বড় ধনী রাতারাতি পথের ফকির হয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখায় গিয়ে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দারিদ্র্যের অভিশাপকে জাদুঘরে পাঠিয়ে গিনেস বুকে নতুন রেকর্ড স্থাপনের পাঁয়তারা শুরু করেছে।

মানুষের হাসি বন্ধ হয়ে গেছে। কান্না-দীর্ঘশ্বাস-খিস্তিখেউড় এখন জাতীয় ভাষায় পরিণত হয়ে গেছে। ফলে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে যারা যত অশ্লীল, অশ্রাব্য, অকথ্য ও নগ্ন ভাষায় গালাগাল দিতে পারে, তাদের হতাশার সাগরে নিমজ্জিত অথর্বরা নিজেদের মানসপিতা বানিয়ে মাতালের মতো উল্লাসনৃত্য শুরু করেছে। তাদের তাণ্ডবে কবি কবিতা লিখতে ভুলে গেছে, গায়ক নির্বাক হয়ে ভাবছে কী গাইবেন আর বুদ্ধিজীবীরা তাদের বুদ্ধি বন্ধক রাখার জন্য সিন্ধুকের খোঁজে সিন্ধু নদীর অববাহিকায় হিজরতের চিন্তা করছেন।

রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। আইনের বই থেকে আইন উধাও হয়ে মব সন্ত্রাসের সম্রাটদের পায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নীতিনৈতিকতা, ধর্মকর্ম থমকে গেছে। মানুষের জবানের ওপর বজ্রপাত হয়েছে। চিন্তার দরজা বন্ধ। বিবেক অন্ধ এবং চরিত্র প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওঠানামা করছে। ফলে সবকিছুতেই লডর-ভডর লেগে গেছে এবং এক অজানা আশঙ্কা অনিশ্চিত পথযাত্রা এবং অদৃশ্যশক্তির নড়াচড়ায় জীবনের গতি, ছন্দ, গীত, সংগীত বন্ধ হতে চলেছে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ