ঢাকা ১১:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

রাজনীতিবিদদের ওপর আমলাদের খবরদারি রোধে আইন সংস্কারের উদ্যোগ

  • আপডেট সময় : ০৮:৫৫:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ জুলাই ২০২২
  • ৯৩ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি : রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমলাদের দূরত্ব নতুন কিছু না। এখন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রশাসনিক বিষয় তাকে আমলাদের কাছ থেকেই বুঝে নিতে হয়। আমলারাই প্রশাসনিক পলিসিসহ আলোচ্য বিষয়ের অগ্রভাগে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ওপর আমলারা খবরদারি করেন। সাম্প্রতিক সময়ে সংসদে এটি আলোচনায় আনেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে সরকারের কাছে আমলারা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলেও জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য। তারা বলেন, আমলারা জনপ্রতিনিধিদের সম্মানও করতে চান না। মন্ত্রী বলেন, আমলারা স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের গলায় রশি বেঁধে ঘোরান। যদিও তিনি নিজেও আমলা ছিলেন। অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে গিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছেন।
আমলারা কতটা দাপট রাখেন- তার একটা নজির হলো স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছিল উপসচিবের বাবা আমির হামজাকে। বিতর্কের মধ্যে পরে তা বাতিল করতে হয়। এর মধ্যে দু-একটা ঘটনা সামনে এলেও পেছনে থেকে যায় অনেক ঘটনাই। সে কারণে রাজনীতিবিদরা মনে করেন- আইন সংস্কার বা সংশোধন করে আমলাতন্তের লাগাম টেনে ধরা দরকার। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত বৃহস্পতিবার একটি সংবাদসংস্থাকে বলেন, ‘আগে আইন-কানুন ও রুলস-রেগুলেশন পরিবর্তন করতে হবে। যে আইন আছে তারা সেভাবে কাজ করবে। এতে আপনি তাদের দোষ দিবেন কেমনে। যদি আগের কোনো আইন থাকে সাংঘর্ষিক, সেটা পরিবর্তন করার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের, তাদের না।’
মন্ত্রী বলেন, ‘সরকারও পদ্ধতি মানতে বাধ্য। সরকারও সরাসারি আইন প্রয়োগ করতে পারে না। একটি আইন বিভিন্ন হাত ঘুরে এটা কার্যকরের পর্যায়ে আসে। অনেকেই আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে সুযোগ নিচ্ছে। এখনই আইন পরিবর্তন করা না গেলে বড় আকার ধারণ করতে পারে। তাই আমলাতন্ত্রকে পরিবর্তন করতে হবে।’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সরকার আমলা ও প্রশাসনের ওপর বেশি নির্ভর হয়ে পড়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমলাদের সব দাবি সরকারের পক্ষ থেকে এক বাক্যে মেনে নেয়া হচ্ছে। আগে কোনো আমলার ব্যক্তিগত কিংবা অন্য কোনো সুবিধা নিতে হলে জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশ লাগত। এখন সেটা করা লাগে না। আমলারা নিজেদের মধ্যে বিষয়টা সমাধান করে নেন।’
বর্তমান সরকার একাধারে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়ে ছোটখাটো সমস্যা হতেই পারে। সব দিক বিবেচনা করে সরকারও আমলাদের সাথে কোনো ঝমেলায় জড়াতে চান না বলে জানান এক কর্মকর্তা।
আমলারা স্থানীয় রাজনীতিবিদদের নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘুরান- এ কথা মানতে নারাজ কর্মকর্তারা। জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘মন্ত্রী যেভাবে বলছেন সেটা ঠিক না। আর মন্ত্রী সংসদে যা বলেছেন এ বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের কিছু বলার নেই। সরকার যেভাবে পরিকল্পনা ও আইন করেন, সেভাবে কাজ চলে। নির্ধারিত আইনের বাইরে যাওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণাযয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম বলেন, ‘এ বিষয় আমি জানি না, শুনি নাই। কাজেই বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’ একাধিক পৌর মেয়রের সাথে কথা হয়েছে ঢাকাটাইমসের। তারা কেউ কেউ মন্ত্রীর কথার সাথে একমত পোষণ করলেও কেউ কেউ ভিন্নমতও পোষণ করছেন। কিন্তু অধিকাংশই মনে করছেন আমলারা তাদের ওপর খবরদারি করে যাচ্ছেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেক মেয়র ভাষ্য এমন- ‘সারাজীবন দলীয় রাজনীতি করেছি। শেষ বয়সে এসে একটা সম্মানের পদ পেলাম। জনগণের ভালোবাসায় মেয়র নির্বাচিত হলাম। কিন্তু জনগণের জন্য মন খুলে কাজ করতে পারছি না। একজন আমলার সাথে দেখা করতে হলে কয়েক দিন আগে অনুমতি লাগে। আগাম টাকা জমা দিয়ে উন্নয়ন কাজ ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পৌর মেয়র বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয় যে দাবি করেছেন এটা সঠিক। আমরা নিজেরাও এই সমস্যাই ভুগছি। আমার পৌরসভায় উন্নয়নের জন্য আট কোটি টাকা বরাদ্দ আসছে, আজ কতদিন হয়ে গেল। টেন্ডারে দিয়েছি, কিন্তু সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ডিজি মহোদয় বলছেন, ৪ শতাংশ টাকা অগ্রীম জমা না দিলে কাজ ছাড়বে না। এতেই এই উন্নয়ন কাজ করতে পারছি না, আটকে আছে।’
একজন পৌর মেয়র শুধু আমলাদের দোষ দেয়ার পক্ষে না। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা জনপ্রতিনিধি, তারা আমাদের জায়গায় সঠিক, যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দেয় কি না। আমলারা প্রশাসনিকভাবে তারা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সাথে কাজ করে যোগ্যতা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু আমরা জনপ্রতিনিধিরা! আমাদেরও বিভিন্ন কর্মশালা (ট্রেনিং) করা উচিত।’ সরকার আমলানির্ভর হয়ে যাচ্ছে কেন- এমন প্রশ্ন তুলে ওই মেয়র বলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদরা হয়তো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পরছি না। অনেক সময় দেখা যায়, কি ধরনের সমস্যা তৈরী করেন স্থানীয় রাজনীতি নেতারা ‘
আমলা ও রাজনীতিবিদদের এ দ্বন্দ্বের বিষয়ে কথা হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম মহিউদ্দিন বলেন, ‘এটা দুটি কারণে ‘প্রশাসনিক দায়িত্বে যারা আছেন, তারা মনে করেন স্থানীয় প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা চান। নিয়মের তোয়াক্কা না করে কাজ করতে চান। অনেক সময় যা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। তারা এখন আর এসব প্রশ্রয় দিতে চান না।’
‘আর স্থানীয় প্রতিনিধিরা মনে করেন- আমলাদের আধিপত্য এতটাই বেড়ে গেছে যে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। তাদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু তারা আমলাদের কারণে অনেক কিছু করতে পারছেন না।’ বলেন অধ্যাপক মহিউদ্দিন।
আমলা ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্বের কারণে সরকারের নীতি বাস্তবায়নে ক্ষেত্রেও এক ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক মহিউদ্দিন। বলেন, ‘বিশেষ করে যখন মন্ত্রী মহোদয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, আমলারা জনগণকে নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছেন, তখন এটা খুব অ্যালার্মিং।
সরকার ও রাজনীতি বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, এটাকে যদি আমরা ঠিক করতে চাই। তাহলে আমলাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। বিশেষভাবে পার্লামেন্টকে (সংসদ) শক্তিশালী করতে হবে। সরকারের ওপরে পার্লামেন্ট যদি শক্তিশালী হয়, নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আমলাতন্তের প্রভাব কমে আসবে। আমলাতন্তকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে একমাত্র জাতীয় সংসদ। একই সঙ্গে রাজনীতিবীদদের দুর্বলতাও দেখছেন এই অধ্যাপক। রাজনীতিবিদরা শিক্ষা ও প্রক্ষিণের দিক থেকে আমলাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। রাজনীতিবীদরা যখন কোনো পদে যাবেন, তখন তাদের বিভিন্ন দক্ষতা ও অবস্থান (প্রোফাইল) তৈরি করতে হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা যেসব কথা বলছেন, অনেকটা হতাশা ও উদ্বেগের কণ্ঠেই কথাগুলো বলছেন। এটা যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে জবাবাদিহিমূলক সরকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের অন্তরায়।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, এটা খুব সহজে অনুমেয়, যাদের কথা বলা হচ্ছে-তারা তো এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আর এইসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ হয়েছে। এসব সরকারি প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার কারণেই যতটা না প্রতিষ্ঠানিক ক্ষমতা, তার চেয়ে বেশি দলীয় ক্ষমতার চর্চা রয়েছে। এই পরিস্থিতির তৈরি পেছনে রাজনীতিবিদদেরই দায় আছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘তারা (রাজনীতিক) আজকে নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে প্রশ্নগুলো করতে পারেন। বিভিন্ন সময় রাজনীতিবিদরা আমলাদের ব্যবহার করেছেন। এছাড়া রাজনীতিবিদদের সাথে আমলাদের অসাধু যোগসাজশ রয়েছে। সেটাকে এমন পর্যায়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে যে আমলারা আজ এই অবস্থার সৃষ্টি করতে পারছেন।’
সংসদে দাঁড়িয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী যেটা বলেছেন সেটা সবার ক্ষেত্রে সঠিক নয় বলে মনে করেন সচিব (অব.) ড. খন্দকার সাখাওয়াত। তিনি বলেন, ‘এটা বিছিন্নভাবে কোথাও কোথাও হতে পারে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এটা ঠিক না। কারণ একজন অফিসারের প্রশিক্ষণ আছে, ব্যালেন্স বোধ ও ক্ষমতা আছে, তার তো এমন করার কথা না। তবে অনেক সময় জনপ্রতিনিধিরাও তাদের (আমলাদের) বোঝে, তা কিন্তু না। সব সময় কম-বেশি আমলা ও লোকাল জনপ্রতিনিধিরা এক সাথে কাজ করে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

রাজনীতিবিদদের ওপর আমলাদের খবরদারি রোধে আইন সংস্কারের উদ্যোগ

আপডেট সময় : ০৮:৫৫:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ জুলাই ২০২২

বিশেষ প্রতিনিধি : রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমলাদের দূরত্ব নতুন কিছু না। এখন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রশাসনিক বিষয় তাকে আমলাদের কাছ থেকেই বুঝে নিতে হয়। আমলারাই প্রশাসনিক পলিসিসহ আলোচ্য বিষয়ের অগ্রভাগে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ওপর আমলারা খবরদারি করেন। সাম্প্রতিক সময়ে সংসদে এটি আলোচনায় আনেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে সরকারের কাছে আমলারা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলেও জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য। তারা বলেন, আমলারা জনপ্রতিনিধিদের সম্মানও করতে চান না। মন্ত্রী বলেন, আমলারা স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের গলায় রশি বেঁধে ঘোরান। যদিও তিনি নিজেও আমলা ছিলেন। অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে গিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছেন।
আমলারা কতটা দাপট রাখেন- তার একটা নজির হলো স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছিল উপসচিবের বাবা আমির হামজাকে। বিতর্কের মধ্যে পরে তা বাতিল করতে হয়। এর মধ্যে দু-একটা ঘটনা সামনে এলেও পেছনে থেকে যায় অনেক ঘটনাই। সে কারণে রাজনীতিবিদরা মনে করেন- আইন সংস্কার বা সংশোধন করে আমলাতন্তের লাগাম টেনে ধরা দরকার। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গত বৃহস্পতিবার একটি সংবাদসংস্থাকে বলেন, ‘আগে আইন-কানুন ও রুলস-রেগুলেশন পরিবর্তন করতে হবে। যে আইন আছে তারা সেভাবে কাজ করবে। এতে আপনি তাদের দোষ দিবেন কেমনে। যদি আগের কোনো আইন থাকে সাংঘর্ষিক, সেটা পরিবর্তন করার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের, তাদের না।’
মন্ত্রী বলেন, ‘সরকারও পদ্ধতি মানতে বাধ্য। সরকারও সরাসারি আইন প্রয়োগ করতে পারে না। একটি আইন বিভিন্ন হাত ঘুরে এটা কার্যকরের পর্যায়ে আসে। অনেকেই আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে সুযোগ নিচ্ছে। এখনই আইন পরিবর্তন করা না গেলে বড় আকার ধারণ করতে পারে। তাই আমলাতন্ত্রকে পরিবর্তন করতে হবে।’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সরকার আমলা ও প্রশাসনের ওপর বেশি নির্ভর হয়ে পড়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমলাদের সব দাবি সরকারের পক্ষ থেকে এক বাক্যে মেনে নেয়া হচ্ছে। আগে কোনো আমলার ব্যক্তিগত কিংবা অন্য কোনো সুবিধা নিতে হলে জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশ লাগত। এখন সেটা করা লাগে না। আমলারা নিজেদের মধ্যে বিষয়টা সমাধান করে নেন।’
বর্তমান সরকার একাধারে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়ে ছোটখাটো সমস্যা হতেই পারে। সব দিক বিবেচনা করে সরকারও আমলাদের সাথে কোনো ঝমেলায় জড়াতে চান না বলে জানান এক কর্মকর্তা।
আমলারা স্থানীয় রাজনীতিবিদদের নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘুরান- এ কথা মানতে নারাজ কর্মকর্তারা। জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘মন্ত্রী যেভাবে বলছেন সেটা ঠিক না। আর মন্ত্রী সংসদে যা বলেছেন এ বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের কিছু বলার নেই। সরকার যেভাবে পরিকল্পনা ও আইন করেন, সেভাবে কাজ চলে। নির্ধারিত আইনের বাইরে যাওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণাযয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম বলেন, ‘এ বিষয় আমি জানি না, শুনি নাই। কাজেই বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’ একাধিক পৌর মেয়রের সাথে কথা হয়েছে ঢাকাটাইমসের। তারা কেউ কেউ মন্ত্রীর কথার সাথে একমত পোষণ করলেও কেউ কেউ ভিন্নমতও পোষণ করছেন। কিন্তু অধিকাংশই মনে করছেন আমলারা তাদের ওপর খবরদারি করে যাচ্ছেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেক মেয়র ভাষ্য এমন- ‘সারাজীবন দলীয় রাজনীতি করেছি। শেষ বয়সে এসে একটা সম্মানের পদ পেলাম। জনগণের ভালোবাসায় মেয়র নির্বাচিত হলাম। কিন্তু জনগণের জন্য মন খুলে কাজ করতে পারছি না। একজন আমলার সাথে দেখা করতে হলে কয়েক দিন আগে অনুমতি লাগে। আগাম টাকা জমা দিয়ে উন্নয়ন কাজ ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পৌর মেয়র বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয় যে দাবি করেছেন এটা সঠিক। আমরা নিজেরাও এই সমস্যাই ভুগছি। আমার পৌরসভায় উন্নয়নের জন্য আট কোটি টাকা বরাদ্দ আসছে, আজ কতদিন হয়ে গেল। টেন্ডারে দিয়েছি, কিন্তু সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ডিজি মহোদয় বলছেন, ৪ শতাংশ টাকা অগ্রীম জমা না দিলে কাজ ছাড়বে না। এতেই এই উন্নয়ন কাজ করতে পারছি না, আটকে আছে।’
একজন পৌর মেয়র শুধু আমলাদের দোষ দেয়ার পক্ষে না। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা জনপ্রতিনিধি, তারা আমাদের জায়গায় সঠিক, যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দেয় কি না। আমলারা প্রশাসনিকভাবে তারা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সাথে কাজ করে যোগ্যতা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু আমরা জনপ্রতিনিধিরা! আমাদেরও বিভিন্ন কর্মশালা (ট্রেনিং) করা উচিত।’ সরকার আমলানির্ভর হয়ে যাচ্ছে কেন- এমন প্রশ্ন তুলে ওই মেয়র বলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদরা হয়তো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পরছি না। অনেক সময় দেখা যায়, কি ধরনের সমস্যা তৈরী করেন স্থানীয় রাজনীতি নেতারা ‘
আমলা ও রাজনীতিবিদদের এ দ্বন্দ্বের বিষয়ে কথা হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম মহিউদ্দিন বলেন, ‘এটা দুটি কারণে ‘প্রশাসনিক দায়িত্বে যারা আছেন, তারা মনে করেন স্থানীয় প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা চান। নিয়মের তোয়াক্কা না করে কাজ করতে চান। অনেক সময় যা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। তারা এখন আর এসব প্রশ্রয় দিতে চান না।’
‘আর স্থানীয় প্রতিনিধিরা মনে করেন- আমলাদের আধিপত্য এতটাই বেড়ে গেছে যে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। তাদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু তারা আমলাদের কারণে অনেক কিছু করতে পারছেন না।’ বলেন অধ্যাপক মহিউদ্দিন।
আমলা ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্বের কারণে সরকারের নীতি বাস্তবায়নে ক্ষেত্রেও এক ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক মহিউদ্দিন। বলেন, ‘বিশেষ করে যখন মন্ত্রী মহোদয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, আমলারা জনগণকে নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছেন, তখন এটা খুব অ্যালার্মিং।
সরকার ও রাজনীতি বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, এটাকে যদি আমরা ঠিক করতে চাই। তাহলে আমলাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। বিশেষভাবে পার্লামেন্টকে (সংসদ) শক্তিশালী করতে হবে। সরকারের ওপরে পার্লামেন্ট যদি শক্তিশালী হয়, নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আমলাতন্তের প্রভাব কমে আসবে। আমলাতন্তকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে একমাত্র জাতীয় সংসদ। একই সঙ্গে রাজনীতিবীদদের দুর্বলতাও দেখছেন এই অধ্যাপক। রাজনীতিবিদরা শিক্ষা ও প্রক্ষিণের দিক থেকে আমলাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। রাজনীতিবীদরা যখন কোনো পদে যাবেন, তখন তাদের বিভিন্ন দক্ষতা ও অবস্থান (প্রোফাইল) তৈরি করতে হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা যেসব কথা বলছেন, অনেকটা হতাশা ও উদ্বেগের কণ্ঠেই কথাগুলো বলছেন। এটা যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে জবাবাদিহিমূলক সরকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের অন্তরায়।
টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, এটা খুব সহজে অনুমেয়, যাদের কথা বলা হচ্ছে-তারা তো এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আর এইসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ হয়েছে। এসব সরকারি প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার কারণেই যতটা না প্রতিষ্ঠানিক ক্ষমতা, তার চেয়ে বেশি দলীয় ক্ষমতার চর্চা রয়েছে। এই পরিস্থিতির তৈরি পেছনে রাজনীতিবিদদেরই দায় আছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘তারা (রাজনীতিক) আজকে নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে প্রশ্নগুলো করতে পারেন। বিভিন্ন সময় রাজনীতিবিদরা আমলাদের ব্যবহার করেছেন। এছাড়া রাজনীতিবিদদের সাথে আমলাদের অসাধু যোগসাজশ রয়েছে। সেটাকে এমন পর্যায়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে যে আমলারা আজ এই অবস্থার সৃষ্টি করতে পারছেন।’
সংসদে দাঁড়িয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী যেটা বলেছেন সেটা সবার ক্ষেত্রে সঠিক নয় বলে মনে করেন সচিব (অব.) ড. খন্দকার সাখাওয়াত। তিনি বলেন, ‘এটা বিছিন্নভাবে কোথাও কোথাও হতে পারে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এটা ঠিক না। কারণ একজন অফিসারের প্রশিক্ষণ আছে, ব্যালেন্স বোধ ও ক্ষমতা আছে, তার তো এমন করার কথা না। তবে অনেক সময় জনপ্রতিনিধিরাও তাদের (আমলাদের) বোঝে, তা কিন্তু না। সব সময় কম-বেশি আমলা ও লোকাল জনপ্রতিনিধিরা এক সাথে কাজ করে।