বিশেষ সংবাদদাতা: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) আটটি বিভাগের ৫০টি থানার বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ করেই যেন বেড়ে গেছে খুনের ঘটনা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে রাজধানীতে ৮৪টি হত্যাকা- ঘটেছে। এর মধ্যে গেল জুন মাসেই খুনের ঘটনা ঘটেছে ২৪ টি। পুলিশ এর মধ্যে ২০টি খুনের রহস্য উদঘাটনের দাবি করেছে। বাকি চারটির তদন্ত চলমান রয়েছে। সবশেষ ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছিল রাজধানীতে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপি’র কর্মকর্তারা বলছেন, খুনোখুনির ঘটনা বাড়লেই সেটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়কে মিন করে না। অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া নয়। হত্যাকা-গুলো কী কারণে ঘটছে সেসব বিষয়ে উদ্ঘাটন করতে পারলে এসব বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। খুনোখুনির বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে আর্থিক, জমি সংক্রান্ত বা বিবাহিত সম্পর্কের জের ধরেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। এগুলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ইন্ডিকেট করে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্র বলছে, জুন মাসে ২৪টি খুনের মধ্যে রমনা বিভাগে চারটি, ওয়ারী বিভাগে পাঁচটি, মতিঝিলে একটি, তেজগাঁওয়ে তিনটি, মিরপুরে তিনটি, গুলশানে পাঁচটি, উত্তরা বিভাগে তিনটি ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত রমনা বিভাগে ৯টি, লালবাগ বিভাগে পাঁচটি, ওয়ারী বিভাগে ২০টি, মতিঝিল বিভাগে ছয়টি, তেজগাঁও বিভাগে ১৩ টি, মিরপুর বিভাগে ১১টি, গুলশান বিভাগে ১১টি, উত্তরা বিভাগে ৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে রাজধানীতে খুনের ঘটনা ঘটে ১৭৩টি। এর মধ্যে ওয়ারী বিভাগে ঘটে সর্বোচ্চ ৩৭টি। ২০২১ সালে ১৬৬টি, ২০২০ সালে ২১৯টি হত্যাকা- ঘটে রাজধানীতে। হত্যাকা- কেন বেশি ঘটে ওয়ারী বিভাগে এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়ারী বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার জিয়াউল আহসান তালুকদার বলেন, ওয়ারী ডিভিশন এলাকায় যত না খুনের ঘটনা আমরা পাই তার থেকে ডেড বডির উদ্ধার হয় বেশি। ওয়ারী ডিভিশনটি পাশ দিয়ে তিনটি নদী বয়ে গেছে। শীতলক্ষা, বুড়িগঙ্গা ও বালু নদী তিন পাশ দিয়ে এলাকাটিকে ঘিরে রেখেছে। কেউ কোনো ধরনের অপরাধ করে অপরাধীরা মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়ার পর বিভিন্ন সময় আমাদের ডিভিশন এলাকায় ভেসে আসে এবং উদ্ধার হয়। তিনি বলেন, শ্যামপুর, কদমতলী, ডেমরা এসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজন অনেকেই নি¤œ আয়ের। অল্পতেই তারা উত্তেজিত হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি সেটা হত্যাকা- পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। মোবাইলে ইন্টারনেট কিনে দেওয়া হয়নি, এমনকি কোনো একজন রিকশাওয়ালা বাসায় ছোট মাছ নিয়ে গেছে রাতে স্ত্রী সেটাই কাটতে অপারগতা প্রকাশ করছে এটাও হত্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ ধরনের ছোট খাটো ঘটনার কারণে বিশেষ করে ওয়ারী এলাকার বিভিন্ন জায়গায় হত্যাকা- ঘটছে।
এছাড়া জুন মাসে ওয়ারী এবং তেজগাঁও বিভাগে একটি করে এবং গুলশান বিভাগে দুটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ছিনতাই কিংবা দস্যুতার ঘটনায় ২৪টি মামলা দায়ের হয় বিভিন্ন থানায়। ছয়টি অপহরণের ঘটনা ঘটে এবং দুটি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সিঁধেল চুরির ঘটনা ঘটে তিনটি। নানাবিধ কারণে হত্যাকা-ের ঘটনা বাড়তে পারে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ডক্টর তৌহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা যে বাস্তবতা লক্ষ্য করছি সেটা হলো আমাদের এখানে দেনা-পাওনা কেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব, ভুল বোঝাবুঝির মতো পরিস্থিতি, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতাসহ নানা কারণে হত্যাকা-ের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। এছাড়া বিভিন্ন সহিংসতার কারণেও হত্যাকা-ের উদাহরণ অনেক রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ছোটখাটো অপরাধ কিংবা মনোমালিন্য, ভুল বোঝারবুঝির বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে হত্যাকা- সাম্প্রতিক সময় বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হত্যায় গড়ানোর আগে এসব বিরোধ পারিবারিকভাবে বা সামাজিকভাবে বসে মীমাংসা করা যেতো। মীমাংসার দিকে না গিয়ে অনেকেই সহিংসতা বা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময় কোনো ব্যক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হয়। কোনো ঘটনায় মামলা নেওয়া হয়, আবার কোনো কোনো ঘটনা গণমাধ্যমে আসলে চাপে পরবর্তীতে মামলা নিয়ে থাকে। মামলায় অভিযুক্তদের আসামি করে এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। অপরাধীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সংযোগ গড়ে ওঠার কারণেও অনেক সময় অপরাধ বেড়ে যায়।
রাজধানীতে হঠাৎ বেড়েছে খুন!
ট্যাগস :
রাজধানীতে হঠাৎ বেড়েছে খুন!
জনপ্রিয় সংবাদ