নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে দুই বছর ধরে করোনা মাহামারিতে জীবিকা হারিয়েছেন অনেক মানুষ। আয় কমে কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে নি¤œ ও নি¤œমধ্যবিত্ত শ্রেণি। করোনার হানার সঙ্গে যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যের যাঁতা। এ যাঁতায় পিষ্ট মানুষ। ২০২১-২২ অর্থবছরে টানা ছয় মাস উল্লম্ফন ছিল দ্রব্যমূল্যের। এর পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটুখানি কমলে ফের বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। গত ফেব্রয়ারি মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা ১৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং সময়ের দিক থেকে রমজানের কাছাকাছি।
একদিকে করোনার বিপুল ক্ষতিকর প্রভাব, অন্যদিকে লাগামহীন দ্রব্যমূল্য- এ দুই নির্মম ভোগান্তির মধ্যে সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে যতটা ‘সফলতা’ দেখিয়েছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ততটাই ব্যর্থতা দেখছে সাধারণ মানুষসহ বিশেষজ্ঞরা।
এ অবস্থায় আসছে রোজা। আর ১০ দিন পরই শুরু হবে পবিত্র রমজান মাস, যে মাস কার্যত অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার মাস। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেট নিয়ে গত রবিবার এক অনুষ্ঠানে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশের নিত্যপণ্যের দাম বেশি হওয়ার পিছনে লুটেরাদের ভূমিকা বেশি।’
‘লুটেরা সমাজ পাঁচ টাকা লাভের জায়গায় ৫০ টাকা লাভ করে। রমজান এলে তারা দলবদ্ধভাবে অতিমুনাফা লাভের আশায় পণ্য মজুদ করে রাখে। তাই পণ্যের দাম বেড়ে যায়।’ বলেন কামাল মজুমদার।
এদিকে সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে, নিত্যপণ্য মূল্যে প্রতিযোগী এবং উন্নত দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ভোজ্যতেল, ডিম ও পেঁয়াজসহ কয়েকটি পণ্যের দাম ইউরোপ-আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে এসব পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বাজার ব্যবস্থায় ব্যর্থতা। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আর এখনই এসব পণ্যের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে রমজানে আরও বাড়বে।
পণ্যমূল্য সম্পর্কে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে, রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না। কোনো ব্যবসায়ী যদি অবৈধভাবে কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাজার মনিটরিং ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আন্তরিকভাবে কাজ করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজার মনিটরিং করতে ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমাতে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সারাদেশের বাজার মনিটরিং ও দ্রব্যমুল্যেও দাম কমাতে কাজ করে যাচ্ছে।’
গত সোমবার (২১ মার্চ) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে। এতে দেখা গেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে টানা ছয় মাস বাড়ার পর জানুয়ারিতে কমেছিল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে তা আবার বেড়েছে। বিবিএসের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৬ টাকা ১৭ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এই মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে বেশি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ১০ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে গ্রামে শহরের চেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। গ্রামে মূল্যম্ফীতি দেখা যাচ্ছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর শহরে সেটা ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রাম এলাকায় পণ্যমূল্য বেড়েছে বেশি। তবে সরকারি সংস্থার হিসাবের চেয়ে বাস্তবে অনেক বেশি মূল্যস্ফীতির হার- এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার বিবিএসের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। সানেম গত ৩ মার্চ একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘মূল্যস্ফীতি: সরকারি পরিসংখ্যান বনাম প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গ্রামে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ।
গত রোববার গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বর্তমানে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমরা কয়েকটি দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছি, আয়ের দিক থেকে আমরা পিছিয়ে কিন্তু পণ্যের দাম বাংলাদেশে বেশি। এর মানে হলো এখানে বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে। মার্কেট ইন্টেলিজেন্স বা বাজার তদারকির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
‘সামনে রমজান মাস। আর প্রতিবছর রমজানে মানুষের চাহিদা বাড়ে। ওই সময়ে আমদানিকারক ও বিক্রেতারা কারসাজির মাধ্যমে মূল্য বাড়িয়ে দেয়।’ বলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, দেড় বছর পর গত বছরের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ‘ঘর’ অতিক্রম করে ৬ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশে উঠে। তবে সারা দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা কমে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ০২ শতাংশ। এর পর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচেই অবস্থান করছিল। ১২ মাসের গড় হিসাবে ডিসেম্বর শেষে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, যা নির্ধারিত লক্ষ্যের বেশ খানিকটা উপরে। এদিকে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার।