মুহম্মদ রাসেল হাসান : বাংলা সাহিত্যের যে রবি কখনো অস্ত যায় না, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সুদীর্ঘ দেহ, দীপ্ত ভঙ্গির অধিকারী এ মহামানব চিন্তা, চেতনা এবং ধ্যানেও উচ্চমার্গীয় ছিলেন। মানুষের হৃদয়কে তিনি এমনভাবে পাঠ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁর যে লেখাই পড়ি; মনে হয় এ তো আমারই মনের কথা। প্রেম, ভালোবাসা, দ্রোহ, বিরহ, সমস্যা, সম্ভাবনা, দুঃখ ও কষ্ট এত বিচিত্র, মধুর, সমৃদ্ধ ও আধুনিক করে রচনা করেছেন, তাঁর সমকাল পেরিয়ে শত বছর পরেও তা প্রাসঙ্গিক।
বাংলা সাহিত্যের আকাশের এই মহাতারকা নিশ্চয়ই এর পূর্বাভাস জানতেন। এজন্যই তিনি তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসে আমার কবিতাখানি?/ কৌতূহলভরে/ …আজি হতে শতবর্ষ পরে/ এখন করিছে গান সে কোন্ নূতন কবি/ তোমাদের ঘরে?’
পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজটিই রবীন্দ্রনাথের জীবনে বড় দর্শন ছিল। সেটা হচ্ছে নিজেকে চেনা। আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিসও বলে গেছেন, ‘শহড়ি ঃযুংবষভ’। তাতেও একই আহ্বান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে চিনতে পেরেছিলেন। এজন্যই তো ‘শেষ লেখা’য় তিনি লেখেন, ‘রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনার রূপ,/চিনিলাম আপনারে আঘাতে আঘাতে/ বেদনায় বেদনায়; সত্য যে কঠিন,/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,/ সে কখনো করে না বঞ্চনা।’
তাঁর ‘বোঝাপড়া’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মনরে আজ কহ যে,/ ভালোমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।’ এত সত্য, এত কঠিন দর্শন খুব কম মানুষই বরণ করে নিতে পারেন। কাজী নজরুলও মনে হয় সেটি পেরেছিলেন। তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ/ আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’
বিশ্বকবির জীবনের দর্শনটির ব্যাপক প্রভাব আছে তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) লেখায়, তাঁর গানে। তাই তাঁকে যত বেশি চর্চা করবো আমরা; তত বেশি সমৃদ্ধ হবো। তাঁর কালজয়ী কিছু লেখা এখনো আমাদের কাছে রহস্যঘেরা। এখানে ‘সোনার তরী’ কাব্যটি উল্লেখ্য। যেটির স্বাভাবিক অর্থ একটি মনে হলেও মর্মার্থে এখানে বলা হয়েছে মহাজীবনের কথা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহিমা প্রকাশ করতে গিয়ে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর থিওরি অব রিলেটিভি গ্রন্থের ১২৯৯ পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন, ‘কবিগুরুর প্রত্যেকটি লেখা এতই তাৎপর্যময় যে, আমি তাঁর প্রতিটি পঙক্তিতে আমার ব=সপ√ এর মতো শত শত ফর্মুলা লুকিয়ে আছে বলে মনে করি।’
কবিগুরু ছোট থেকেই যখন একে একে মা, কাদম্বরী দেবীসহ প্রিয়জনদের হারাতে শুরু করেন; তখনই বেদনাকে প্রবলভাবে যাপন করতে থাকেন। এতে তিনি জমিদার হলেও ভেতরে পুড়তে থাকেন তুমুল অগ্নিশিখায়। পুড়তে পুড়তে হয়ে ওঠেন বিশুদ্ধ এক মহামানব। তাই তো সবাইকেই তিনি শুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/ এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে।’
আমাদের পাশে যখন কেউ থাকে না; তখন থাকেন একজন রবীন্দ্রনাথ। তিনি কানের কাছে বলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে।’ ভাবতে অবাক লাগে যে, কীভাবে সম্ভব! কত বছর পরেও আমাদের সুখে, দুঃখে, সর্বসময়ে তিনি আমাদের ভরসা। এর সঙ্গত কারণ বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্রমাগত অনুশীলন ও গভীর নিরীক্ষায় তিনি ছিলেন সর্বদাই তৎপর। তিনি কখনো তরল হাস্যে, কখনো গাম্ভীর্যপূর্ণভাবে, কখনো মিলনে, মিলনের মলিনতায়, কখনো দর্শনের গুরুর ভঙ্গিতে রচনা করেছেন। লেখার নেপথ্যে রয়েছে প্রাণের কথা, আত্মশুদ্ধির কথা এবং জীবনবোধের কথা।
গুরুদেব আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর অফুরন্ত মাধুর্যম-িত লেখনী আর সুরের বৈভব। তাঁর সাহিত্য আমাদের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ বিশেষ। এই সম্পদ সবারই আহরণ করা সমীচীন। তাঁর শুধু কবিতায় নয়, ৫২টি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও কিন্তু প্রায় আড়াই হাজার গান আছে, আছে ৩৮টি নাটক, ৩৬টি প্রবন্ধ আর ৯৫টি ছোটগল্প। তাঁর এই বিশাল সৃষ্টিজগতে সবার বিচরণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন তাঁকে বহুল পঠন ও শ্রবণ করার।
বহুল রবীন্দ্রচর্চা করলেই কাটবে আমাদের মনের দৈন্য, আসবে আমাদের সুবোধ। বুঝবো আমরা রবীন্দ্রনাথ আসলে কেমন। শুধু ‘বিশ্বকবি’ কথাটি মুখস্থ নয়, মনের চোখ দিয়ে দেখবো বিশ্বসাহিত্যেও তাঁর আসন কত ঊর্ধ্বে।
লেখক: তরুণ কবি ও প্রতিষ্ঠাতা, বইবন্ধু পাঠাগার।