ঢাকা ০৬:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

রক্তভেজা সড়ক

  • আপডেট সময় : ০৯:৫০:৫২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ এপ্রিল ২০২২
  • ১০০ বার পড়া হয়েছে

তুষার আবদুল্লাহ : কুড়িল ফ্লাইওভারে উঠলেই পুত্র তার মাকে বলে- মা ভয় পাও, ভয় পাও। পুত্রের আবদারে মা ভয়ের অভিনয় করে যায়। মায়ের সঙ্গে পুত্রের খেলা এটি। ফ্লাইওভার থেকে নেমে যাওয়ার ঢালু পথে পুত্র মাকে অভয় দেয়-এখন আর ভয় নেই। নেমে পড়ছি। শুক্রবারও সেই পথে পুত্র আর তার মাকে নিয়ে গেলাম। কিন্তু পুত্র সেই খেলাটি খেললো না মায়ের সঙ্গে। চুপচাপ রয়ে গেলো। আমিই জানতে চাইলাম- বাপ, আজ যে মাকে ভয় দেখালে না? পুত্র বললো- আজ আমি নিজেই ভয় পেয়েছি বাবা। তুমি না বললে, এক আপু আজ এখানে স্কুটি নিয়ে যাওয়ার সময় মারা গেছে। আমি বললাম- ভয় পেও না। এটাতো দুর্ঘটনা। আমরা তিনশো ফুটের পথে নেমে যাই। পুত্র বলে- তুমিই তো বলেছিলে কাভার্ড ভ্যান চাপা দিয়ে চলে গেছে ওই আপুকে। আমি চুপ হয়ে আছি। চোখের সামনে তখন, আমার সহকর্মী অনুজদের ছবি। ওরা স্কুটি নিয়ে অফিসে আসে, বাড়ি ফিরে। দেখেছি ওরা ভালো চালায়। কিন্তু কাভার্ড ভ্যানটি যেভাবে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে চাপা দিয়ে গেলো, তাতে স্কুটি ভালো চালানোর পরও, সহকর্মী মেয়েরা যে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাবে সেই ভরসা নেই। পুরুষ সহকর্মীরাও মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন। তাদের নিয়েও উদ্বিগ্ন থাকি।
উদ্বিগ্ন থাকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কন্যার ফেরার। পুত্রকে স্কুল থেকে আনতে যে ওর মা গেলো, দুজনেই নিরাপদে ফিরবে তো? গত সপ্তাহেই অফিসে বসে আছি। শুনতে পেলাম নিচের রাস্তায় দুর্ঘটনা হয়েছে। একজন মা মারা গেছেন। অফিসের পাশের স্কুল থেকে মেয়েকে তুলে বাড়ি ফিরছিলেন, সিগন্যালে থেমে থাকা রিকশাকে এসে ধাক্কা দেয় নিয়ন্ত্রণ হারানো বাস। মেয়ে প্রাণে বাঁচলেও, বাঁচানো যায়নি মাকে। ওয়ারীর মতো একই ঘটনা ঘটেছে মিরপুরে। বিএন স্কুল থেকে মেয়ে নিয়ে ফেরার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন মা। রাজধানীসহ সারাদেশ থেকেই খবর আসে বিদ্যায়তনে যাওয়ার পথে বা ফেরার পথে শিক্ষার্থী, অভিভাবকের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর। এক পরিসংখ্যান বলছে- ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত যত মানুষ মারা গেছেন, তাদের ১১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ ছিল শিক্ষার্থী। প্রতিবছর ৮০০ শিক্ষার্থী সড়কে প্রাণ হারায়।
স্কুলে পড়া দিনের কথা মনে পড়ে। গত শতকের মধ্য আশিতে, এক সকালে শুনতে পাই, আমার স্কুলের দুই শিক্ষার্থী ও তাদের বাবা ৬ নম্বর রুটের বাসের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে। তেজকুনীপাড়া থেকে তারা ফার্মগেটে স্কুলে আসছিল। স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে আমরা মাস খানেক স্কুলের সামনে, ফার্মগেটে আন্দোলন করেছিলাম। ফলাফল ছিল, বাস প্রধান সড়ক দিয়ে না গিয়ে পরে আমাদের স্কুলের সামনে দিয়ে যাতায়াত শুরু করলো। অর্থাৎ ঝুঁকি বেড়ে গেলো আমাদের। আরো দুই একটি দুর্ঘটনা হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলন করার আর প্রণোদনা পাইনি। কারণ জেনে গিয়েছিলাম, পরিবহন মালিক- শ্রমিকেরাই জিতে যাবে শেষমেষ। এখন সন্তানকে বিদ্যায়তনে পাঠানোর কালে এসেও দেখছি শিক্ষার্থীদের মৃত্যু আমাদের কাছে অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। বিমান বন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘটেছিল ফ্লাইওভার থেকে নেমে আসা বাস চাপা দেওয়ায়। তারপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে পুরো দেশ জেগে ওঠে। ২০১৮ সালের পর ছোট আকারে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০২১ সালেও শিক্ষার্থীরা পথে নেমেছিল। কিন্তু সড়কে গণপরিবহনের গতিরোধ করা যায়নি। বেপরোয়াভাবে মহাসড়ক থেকে শুরু করে আবাসিক এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পরিবহন চলছে। শুধু যে গণপরিবহন চালকরা বেপরোয়া চলছে এমন নয়, ব্যক্তি ব্যবহৃত গাড়িরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরো বিশৃঙ্খলভাবে চলাচল করছে। ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটানোর পরেও প্রভাব খাটিয়ে রয়ে যাচ্ছে আইনের বাইরে। সড়কে যে পরিবহন চলছে। তার একটি বড় অংশই ফিটনেসহীন। চালকদের লাইসেন্স নেই। হালকা লাইসেন্সধারী চালক চালাচ্ছেন ভারী পরিবহন। এই পরিবহনগুলো দুর্ঘটনা ঘটালেও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিক্ষুব্ধ পথচারী, যাত্রীরা আগুন আর ভাংচুর করে হয়তো ক্ষোভ মেটাচ্ছে। কিন্তু পরিবহন মালিকরা প্রভাবশালী ও সংঘবদ্ধ হওয়াতে, বীরদর্পে সড়কে চলছে ত্রুটিযুক্ত গাড়ি ও লাইসেন্স বিহীন চালক। আর আমরা পথচারী বা সাধারণ যাত্রীর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে নামছি। পরিবারের সবাই সকালে নানা গন্তব্যে বের হলেও, রাতে সবাই বাড়ি ফিরছি, সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না সড়কের তদারকে থাকা কর্তৃপক্ষ। আসলে সড়কের দায়িত্ব কার? একথাও আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথিউরিটি (বিআরটিএ) , ট্রাফিক বিভাগ, সড়ক ও জনপথ, এদের মধ্যে কি সড়ক নিয়ে সমঝোতা সম্পন্ন হয়েছে? পরিবহন মালিকের স্বার্থের চেয়ে সাধারণ যাত্রী ও পথচারী কি রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার জায়গায় ঠাঁই পেলো? যদি নাই পাই, তাহলে উদ্বেগ ও দুঃখবোধকে চৈত্রের নোনা জলে ভাসিয়ে দিলাম।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

রক্তভেজা সড়ক

আপডেট সময় : ০৯:৫০:৫২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২ এপ্রিল ২০২২

তুষার আবদুল্লাহ : কুড়িল ফ্লাইওভারে উঠলেই পুত্র তার মাকে বলে- মা ভয় পাও, ভয় পাও। পুত্রের আবদারে মা ভয়ের অভিনয় করে যায়। মায়ের সঙ্গে পুত্রের খেলা এটি। ফ্লাইওভার থেকে নেমে যাওয়ার ঢালু পথে পুত্র মাকে অভয় দেয়-এখন আর ভয় নেই। নেমে পড়ছি। শুক্রবারও সেই পথে পুত্র আর তার মাকে নিয়ে গেলাম। কিন্তু পুত্র সেই খেলাটি খেললো না মায়ের সঙ্গে। চুপচাপ রয়ে গেলো। আমিই জানতে চাইলাম- বাপ, আজ যে মাকে ভয় দেখালে না? পুত্র বললো- আজ আমি নিজেই ভয় পেয়েছি বাবা। তুমি না বললে, এক আপু আজ এখানে স্কুটি নিয়ে যাওয়ার সময় মারা গেছে। আমি বললাম- ভয় পেও না। এটাতো দুর্ঘটনা। আমরা তিনশো ফুটের পথে নেমে যাই। পুত্র বলে- তুমিই তো বলেছিলে কাভার্ড ভ্যান চাপা দিয়ে চলে গেছে ওই আপুকে। আমি চুপ হয়ে আছি। চোখের সামনে তখন, আমার সহকর্মী অনুজদের ছবি। ওরা স্কুটি নিয়ে অফিসে আসে, বাড়ি ফিরে। দেখেছি ওরা ভালো চালায়। কিন্তু কাভার্ড ভ্যানটি যেভাবে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে চাপা দিয়ে গেলো, তাতে স্কুটি ভালো চালানোর পরও, সহকর্মী মেয়েরা যে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাবে সেই ভরসা নেই। পুরুষ সহকর্মীরাও মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন। তাদের নিয়েও উদ্বিগ্ন থাকি।
উদ্বিগ্ন থাকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কন্যার ফেরার। পুত্রকে স্কুল থেকে আনতে যে ওর মা গেলো, দুজনেই নিরাপদে ফিরবে তো? গত সপ্তাহেই অফিসে বসে আছি। শুনতে পেলাম নিচের রাস্তায় দুর্ঘটনা হয়েছে। একজন মা মারা গেছেন। অফিসের পাশের স্কুল থেকে মেয়েকে তুলে বাড়ি ফিরছিলেন, সিগন্যালে থেমে থাকা রিকশাকে এসে ধাক্কা দেয় নিয়ন্ত্রণ হারানো বাস। মেয়ে প্রাণে বাঁচলেও, বাঁচানো যায়নি মাকে। ওয়ারীর মতো একই ঘটনা ঘটেছে মিরপুরে। বিএন স্কুল থেকে মেয়ে নিয়ে ফেরার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন মা। রাজধানীসহ সারাদেশ থেকেই খবর আসে বিদ্যায়তনে যাওয়ার পথে বা ফেরার পথে শিক্ষার্থী, অভিভাবকের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর। এক পরিসংখ্যান বলছে- ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত যত মানুষ মারা গেছেন, তাদের ১১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ ছিল শিক্ষার্থী। প্রতিবছর ৮০০ শিক্ষার্থী সড়কে প্রাণ হারায়।
স্কুলে পড়া দিনের কথা মনে পড়ে। গত শতকের মধ্য আশিতে, এক সকালে শুনতে পাই, আমার স্কুলের দুই শিক্ষার্থী ও তাদের বাবা ৬ নম্বর রুটের বাসের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে। তেজকুনীপাড়া থেকে তারা ফার্মগেটে স্কুলে আসছিল। স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে আমরা মাস খানেক স্কুলের সামনে, ফার্মগেটে আন্দোলন করেছিলাম। ফলাফল ছিল, বাস প্রধান সড়ক দিয়ে না গিয়ে পরে আমাদের স্কুলের সামনে দিয়ে যাতায়াত শুরু করলো। অর্থাৎ ঝুঁকি বেড়ে গেলো আমাদের। আরো দুই একটি দুর্ঘটনা হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলন করার আর প্রণোদনা পাইনি। কারণ জেনে গিয়েছিলাম, পরিবহন মালিক- শ্রমিকেরাই জিতে যাবে শেষমেষ। এখন সন্তানকে বিদ্যায়তনে পাঠানোর কালে এসেও দেখছি শিক্ষার্থীদের মৃত্যু আমাদের কাছে অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। বিমান বন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘটেছিল ফ্লাইওভার থেকে নেমে আসা বাস চাপা দেওয়ায়। তারপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে পুরো দেশ জেগে ওঠে। ২০১৮ সালের পর ছোট আকারে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০২১ সালেও শিক্ষার্থীরা পথে নেমেছিল। কিন্তু সড়কে গণপরিবহনের গতিরোধ করা যায়নি। বেপরোয়াভাবে মহাসড়ক থেকে শুরু করে আবাসিক এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পরিবহন চলছে। শুধু যে গণপরিবহন চালকরা বেপরোয়া চলছে এমন নয়, ব্যক্তি ব্যবহৃত গাড়িরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরো বিশৃঙ্খলভাবে চলাচল করছে। ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটানোর পরেও প্রভাব খাটিয়ে রয়ে যাচ্ছে আইনের বাইরে। সড়কে যে পরিবহন চলছে। তার একটি বড় অংশই ফিটনেসহীন। চালকদের লাইসেন্স নেই। হালকা লাইসেন্সধারী চালক চালাচ্ছেন ভারী পরিবহন। এই পরিবহনগুলো দুর্ঘটনা ঘটালেও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিক্ষুব্ধ পথচারী, যাত্রীরা আগুন আর ভাংচুর করে হয়তো ক্ষোভ মেটাচ্ছে। কিন্তু পরিবহন মালিকরা প্রভাবশালী ও সংঘবদ্ধ হওয়াতে, বীরদর্পে সড়কে চলছে ত্রুটিযুক্ত গাড়ি ও লাইসেন্স বিহীন চালক। আর আমরা পথচারী বা সাধারণ যাত্রীর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে নামছি। পরিবারের সবাই সকালে নানা গন্তব্যে বের হলেও, রাতে সবাই বাড়ি ফিরছি, সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না সড়কের তদারকে থাকা কর্তৃপক্ষ। আসলে সড়কের দায়িত্ব কার? একথাও আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথিউরিটি (বিআরটিএ) , ট্রাফিক বিভাগ, সড়ক ও জনপথ, এদের মধ্যে কি সড়ক নিয়ে সমঝোতা সম্পন্ন হয়েছে? পরিবহন মালিকের স্বার্থের চেয়ে সাধারণ যাত্রী ও পথচারী কি রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার জায়গায় ঠাঁই পেলো? যদি নাই পাই, তাহলে উদ্বেগ ও দুঃখবোধকে চৈত্রের নোনা জলে ভাসিয়ে দিলাম।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী