বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন। হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, কিডনির ক্ষতি এবং দৃষ্টিশক্তিসহ বেশ কিছু গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার প্রধান ঝুঁকির কারণ এটি। এই ধরনের ঝুঁকি কমানোর জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা ও বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড গবেষণায় দেখা গেছে, বিষণ্নতা বা হৃদ্রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত এমন কিছু ওষুধ অজান্তেই রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখা আরও কঠিন হয়ে যায়।
গবেষণার জন্য ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন এক্সামিনেশনের জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন হার্ভার্ডের গবেষকেরা। তারা দেখেন যে উচ্চ রক্তচাপযুক্ত প্রায় প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন (১৮ দশমিক ৫ শতাংশ) এমন কিছু ওষুধ ব্যবহার করছেন, যা রক্তচাপ বাড়াতে পারে। এই ওষুধগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলÑ
বিষণ্নতা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ ভেনলাফ্যাক্সিন ও ট্রাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস।
স্টেরয়েডবিহীন প্রদাহ কমানোর ওষুধ আইবুপ্রোফেন ও ন্যাপ্রক্সেন স্টেরয়েড, প্রেডনিসন।
হরমোনাল ওষুধ জন্মনিরোধক ওষুধ বা হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি।
ডিকংজেস্টেন্টস বা হৃদরোগের ওষুধ সুডোএফেড্রিন বা ফেনাইলফ্রিন ধারণ করে।
ওজন কমানোর ওষুধ ফেনটেমিন ও সিবুট্রামিন।
এ ধরনের ওষুধগুলো রক্তচাপ বাড়াতে পারে। ফলে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের রক্তচাপ কমানো কঠিন হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ওষুধ সেবনকারী যতক্ষণ না পর্যন্ত রক্তচাপ কমানোর ওষুধও গ্রহণ করছিলেন, ততক্ষণ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিলেন না। এছাড়া যারা আগে থেকেই রক্তচাপ কমানোর পাশাপাশি রক্তচাপ বাড়ানোর সেই সব ওষুধ (বিষণ্নতা কমানোর, হরমোনাল ইত্যাদি ওষুধ) সেবন করছিলেন তাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও বেশি মাত্রার রক্তচাপ কমানোর ওষুধ নিতে হচ্ছিল।
গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ যে কারণে: অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। যার মধ্যে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কিডনি সমস্যা অন্তর্ভুক্ত। এই গবেষণার ফলাফলগুলো রক্তচাপের সঙ্গে বিভিন্ন ওষুধের পারস্পরিক প্রভাব বুঝে নেওয়ার গুরুত্বকে তুলে ধরে। বিশেষ করে যেসব ব্যক্তি একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলা করছেন তাদের জন্য।
উদাহরণস্বরূপ- আর্থরাইটিস বা বাতের রোগী যারা ব্যথা উপশমের জন্য ননস্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ড্রাগ (আইবুপ্রোফেন) ব্যবহার করেন, তাঁরা হয়তো জানেন না যে এই ওষুধগুলো রক্তচাপ কমানোর ওষুধের প্রভাবকে বিপরীত করতে পারে।
যদি আপনার উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তাহলে ওষুধ সেবনের ক্ষেত্রে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চলতে পারেনÑ
ওষুধ পর্যালোচনা করুন: যেসব ওষুধ সেবন করছেন তা নিয়ে চিকিৎসকেরা সঙ্গে আলোচনা করুন। তার মধ্যে অল্প মাত্রার ওষুধ এবং সাপ্লিমেন্টও অন্তর্ভুক্ত করুন। তাদের কাছে জানতে চান, কোনো ওষুধ আপনার রক্তচাপকে প্রভাবিত করতে পারে কি না।
ডাক্তারদের মধ্যে সমন্বয় করুন: যদি আপনি একাধিক চিকিৎসকের কাছে যান, তবে নিশ্চিত করুন যে প্রতিটি চিকিৎসক আপনার সমস্ত ওষুধের তালিকা জানেন।
রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ করুন: নিয়মিতভাবে আপনার রক্তচাপ পরীক্ষা করুন। বিশেষ করে নতুন কোনো ওষুধ শুরু করার পর। আর এই পরিমাপগুলো চিকিৎসকের সঙ্গে শেয়ার করুন।
বিকল্প ওষুধ বিবেচনা করুন: যদি কোনো ওষুধ আপনার রক্তচাপ বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন, তবে আপনার চিকিৎসকের কাছে নিরাপদ বিকল্প চাইতে পারেন। বিষয়টি চিকিৎসককে অবগত করুন। উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনার মাত্র একটি উপায় হলো ওষুধ। তবে জীবনধারাও এতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন একটি ডায়েট অনুসরণ করুন যাতে সোডিয়ামের পরিমাণ কম এবং ফল, সবজি ও পূর্ণ শস্যের পরিমাণ বেশি থাকে। রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে মেডিটেরানিয়ান বা ভূমধ্যসাগরীয় ডায়েট। এই ডায়েটের খাদ্যতালিকায় মাছ, বাদাম, এবং জলপাই তেল সহ বিভিন্ন উপাদান থাকে।
নিয়মিত শরীরচর্চা: হাঁটা, সাঁতার কাটা, বা সাইকেল চালানোর মতো শারীরিক কার্যকলাপ হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য উন্নত করতে এবং রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
উদ্বেগ কমানো: যোগব্যায়াম, ধ্যান, বা গভীর শ্বাস প্রশ্বাসের মতো চর্চাগুলো স্ট্রেস বা উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করতে পারে। উদ্বেগ উচ্চ রক্তচাপের একটি অন্যতম কারণ।
মদপান ও ধূমপান এড়ানো: এ দুটি অভ্যাস রক্তচাপ বাড়াতে এবং দীর্ঘ মেয়াদে হৃৎপিণ্ডের ও রক্তনালির ক্ষতি করতে পারে।
সঠিক ওজন বজায় রাখা: সামান্য ওজন কমানোও রক্তচাপের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক একজন ব্যক্তির সঠিক ওজন থাকা ভালো।
এই জীবনধারা পরিবর্তনগুলো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হতে পারে এবং দীর্ঘ মেয়াদে আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্যকেও উন্নত করতে পারে।
হার্ভার্ডের গবেষণাটি ড. টিমোথি অ্যান্ডারসন পরিচালনা করেছেন এবং এটি ‘জামা ইন্টারনাল মেডিসিন’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
সাবধানতার সঙ্গে ওষুধ গ্রহণ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো যায়। তবে সব সময়ই একটি চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। তথ্য সূত্র: নোরিডজ।